Thank you for trying Sticky AMP!!

মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছিল কবিতা ও গান

একাত্তরে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকদের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু এ দেশের কবি–সাহিত্যিক নন, লিখেছেন পশ্চিমবঙ্গের কবি–সাহিত্যিকেরাও। বিপুল পরিমাণ গদ্যের পাশাপাশি কবিতার মধ্য দিয়েও বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন তাঁরা। কোন অনুভবে জারিত হয়েছিল সেই সময়ের পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের কবিতা? বিজয় দিবস সামনে রেখে এক অনালোচিত অধ্যায়ের উন্মোচন।

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে ১৯৭২–এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী-সাহিত্যিকেরা বাংলাদেশের সহায়তায় এগিয়ে এসেছিলেন। সে সময় পশ্চিমবঙ্গের এমন কোনো পত্রিকা পাওয়া যাবে না, যেখানে প্রতিদিন বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু না লেখা হয়েছে। সাহিত্যিকেরা কবিতা, গদ্য, ভাষ্য—কী না লিখেছেন। এখানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমরা চেষ্টা করব মুক্তিযুদ্ধকালে পশ্চিমবঙ্গের কবি–সাহিত্যিকেরা কী ভাবছিলেন, কবিতায় কীভাবে যুদ্ধ ও বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তাঁদের আবেগ প্রকাশ করেছিলেন, তা তুলে ধরতে।
বলা হয়ে থাকে, জীবনে একবারও কবিতা লেখেনি, এমন বাঙালির সংখ্যা খুব কম। ফলে এপার বাংলায় যুদ্ধাবেগে সবাই যখন ভেসে যাচ্ছে, তখন ওপারে প্রতিদিনই বাংলাদেশ নিয়ে কবিতা ছাপা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি যেসব কাগজপত্র দেখেছি, তাতে দেখা যাচ্ছে, গদ্যকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি পদ্য।
কলকাতার কাগজগুলোতে শুরুর দিকে অনেকে কবিতা লিখেছেন। এরপর আর লেখেননি। অন্নদাশঙ্কর রায় বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তুলনামূলকভাবে বেশি গদ্য লিখেছেন। সেই তুলনায় পদ্য বা কবিতা হয়তো কয়েকটি।
তবে বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, গোলাম কুদ্দুস, অন্নদাশঙ্কর রায় থেকে শুরু করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, বীরেন্দ্র রক্ষিত, কবিতা সিংহ, দিনেশ দাস প্রমুখ কবি এই সময়ে কবিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতি তাঁদের সমর্থন ব্যক্ত করেন। আনন্দবাজার পত্রিকা, অমৃতবাজার, কালান্তর, দেশসহ তাঁদের এসব কবিতা ছাপা হয়েছে সেই সময়ের নানা ছোট কাগজ ও বুলেটিংয়ে। পরিচয় পত্রিকা এ সময় (১৩৭৭–৭৮ বঙ্গাব্দ) একটি সংখ্যা বের করে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে কবিতা রচনা করেন কলকাতার ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ দশকের কবিরা। এখানেই বীরেন্দ্র চট্টপাধ্যায় লেখেন ‘আমার জন্মভূমি’ নামে কবিতাটি। শঙ্ঘ ঘোষের কবিতার নাম ছিল ‘দেশহীন’। এর প্রথম চরণটি এমন:
‘আজ তোমার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে চাই জয়।’
ওই একই সংখ্যায় ‘ঠুলি’ নামের কবিতায় কবিতায় প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছিলেন:
‘আজ হঠাৎ পিশাচদের বেয়োনেট,
আর কামান বন্দুকে জানলাম
তা বিদীর্ণ রক্তাক্ত
আমারই হৃদয়।’
এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মফস্বলে বা কলকাতার বাইরের কাগজগুলোতেও নিয়মিত ছাপা হয়েছে কবিতা। এসব লেখায় লেখকদের কাঁচা আবেগের প্রতিফলন থাকলেও ভালোবাসার কমতি ছিল না। লক্ষণীয় যে অধিকাংশ কবিতা ছাপা হয়েছে যুদ্ধের শুরুর দিকে, আবেগ যখন উচ্চমাত্রায়।

বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, অন্নদাশঙ্কর রায় মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে কবিতা লিখেছিলেন একাত্তরে

আবার যাঁরা ঔপন্যাসিক বা গল্পকার হিসেবে পরিচিত, এ সময় তাঁরাও কবিতা লিখেছেন। প্রতিষ্ঠিতরাও তো বটেই, অপরিচিত বা অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত লেখকেরাও কবিতায় প্রকাশ করেছেন নিজেদের অনুভব। যেমন কথাসাহিত্যিক বনফুল বা নরেন্দ্রনাথ মিত্র—তাঁরা কবিতা লিখবেন, এটা কেউ ভাবেননি। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বনফুল ও নরেন্দ্রনাথ মিত্র কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন নিজেদের আবেগ। বনফুল—যিনি গোটা পশ্চিমবঙ্গও হয়তো দেখেননি ভালো করে, পূর্ববঙ্গ তো বহুদূর, এ সময় তাঁর কবিতায় জায়গা করে নেন মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদী নেতা শেখ মুজিব। তিনি লিখেছেন:
‘আমি বাংলার কবি তাই বন্ধু ছুটিয়া এলাম
মুজিবুর রহমান লহ সহস্র সেলাম।’
নরেন্দ্রনাথ মিত্র লিখেছেন:
‘নিরীহ চাষির রক্ত শস্যে ঘাসে
কামান–বন্দুক হাতে পিপাকে থেকে।’
বন্দুক হাতে থাকে, কামান তো হাতে নেওয়া যায় না। কিন্তু আবেগ তো আবেগই।
ত্রিশের কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের বাড়ি নোয়াখালী। মুনসেফি করার কারণে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেছেন তিনি। তাঁর দুটি কবিতা পেয়েছি। এর মধ্যে ‘বাংলাদেশ’ কবিতায় তিনি জানিয়েছেন:
‘যেথা আমি তুমি প্রতিবেশী
পরস্পর বন্ধুতার নিবিড় আশ্লেষ,
বাংলাদেশ, বাংলাদেশ
ঘনিষ্ঠ গরিষ্ঠ বাংলাদেশ।’
এ ছাড়া ‘মুক্তি মৈত্রী’ নামে এ সময় একটি দীর্ঘ কবিতাও তিনি লিখেছিলেন। এখানে তাঁর যা মনে হয়েছিল, তা–ই উগরে দিয়েছেন:
‘চাচা আপন বাঁচা বলে লেজ গুটালো
মামু হামি হবার তাকৎ পেল না।
চোদ্দ দিনে যুদ্ধ শেষ
মদ্য শেষ।
স্তব্ধ সব আস্ফালন—আস্ফুট।’
মুক্তিযুদ্ধাবস্থায় অচিন্ত্যকুমারের মতো এমন আরেকটি দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন অমিয় চক্রবর্তী। ‘বাংলার ডায়েরি’র মতো দীর্ঘ কবিতা তিনি আগে আর কখনো লিখেছেন বলে মনে হয় না। এখানে উপমহাদেশের ইতিহাস বিধৃত করে শেষে লিখেছেন:
‘ক্ষমা চাই, সেরা পাপিদের শাস্তি চাই
মহাজাতি বিচারসভায়,
করুণার বীর্যে যেন মাতৃভাষা অমৃত বন্ধনে
বাঁধা পড়ি আনন্দে গৌরবে—
রবীন্দ্রনাথের বাংলা যেন জেগে ওঠে,
জেগে থাকে।’
নামী কবিদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসুর দুটি কবিতা উল্লেখ করা যায়। যুদ্ধের সময় বাইরে ছিলেন ঢাকায় জন্ম নেওয়া বুদ্ধদেব। তাঁর সম্পর্কে অনেকে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তেমন উৎসাহিত ছিলেন না তিনি। বাংলাদেশ নামটির ব্যাপারেও তাঁর আপত্তি ছিল। কিন্তু এসবের কোনো ছাপ নেই এপ্রিলে রচিত তাঁর কবিতা ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২৮’-তে। নস্টালজিক এ কবিতা বেশি পরিচিত। কারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অনেক ছাত্র তখন জীবিত। ফলে বুদ্ধদেবের মতো তাঁদেরও ছিল সে প্রশ্ন:
‘প্রান্তরগুলো কবরের মতো হাঁ করে আছে
যৌবন আর স্বাধীন মন আর
সুন্দর মহান প্রাচীনতাকে
গ্রাস করার জন্য।
সত্যি? এ কি সত্য হতে পারে?’
তাঁর লেখা ‘এক নবদম্পতির উদ্দেশে চট্টগ্রাম’ কবিতাটি কিন্তু ততটা পরিচিত নয়। এটিও এপ্রিলে লেখা। মাহমুদ শাহ কোরেশী লিখেছেন, এ কবিতা তাঁর ও তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে লেখা। লিখেছেন তিনি, ‘আগরতলায় থাকতে দেশ পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসুর একটি কবিতা বেরিয়েছিল আমাদের উদ্দেশে, নাজমা অর্থাৎ আমার স্ত্রী নাসরিন ও শামসুদ্দিন, অর্থাৎ আমার নামের পরিবর্তিত রূপ...। সাব–রুম থেকে লেখা আমার চিঠি পেয়ে তিনি (বুদ্ধদেব বসু) তাঁর একান্ত অনুগত সহকর্মী ড. নরেশ গুহকে আমার দেখভাল করবার কথা বলেছিলেন।’ (মাহমুদ শাহ কোরেশী, মুক্তিযুদ্ধের মিশন: আমার জীবন, ঢাকা, ২০১৭)
একটা কথা বলা দরকার, একাত্তরে পশ্চিমবঙ্গের যেসব সাহিত্যিক কবিতা লিখেছন, তাঁদের মধ্যে ওই বাংলায় জন্ম নেওয়া লেখকদের চিত্রকল্প ছিল ভিন্ন রকম। আর একসময় যাঁরা পূর্ববঙ্গে ছিলেন, কিন্তু পরে পশ্চিম বাংলার বাসিন্দা হয়েছেন, তাঁদের কবিতায় এসেছে নস্টালজিয়া—এসেছে নদীর কথা। অবশ্য যাঁরা পূর্ববঙ্গ দেখেননি, তাঁদের কবিতায়ও নদী এসেছে। কারণ, বাংলাদেশের পরিচয়ই তো পদ্মা-মেঘনা-যমুনা।

কলকাতার কাগজগুলোতে শুরুর দিকে অনেকে কবিতা লিখেছেন। এরপর আর লেখেননি। অন্নদাশঙ্কর রায় বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তুলনামূলকভাবে বেশি গদ্য লিখেছেন। সেই তুলনায় পদ্য বা কবিতা হয়তো কয়েকটি। তবে বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, গোলাম কুদ্দুস, অন্নদাশঙ্কর রায় থেকে শুরু করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, বীরেন্দ্র রক্ষিত, কবিতা সিংহ, দিনেশ দাস প্রমুখ কবি এই সময়ে কবিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতি তাঁদের সমর্থন ব্যক্ত করেন।

প্রয়াত সম্পাদক আবুল হাসনাত জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালে কবি বিষ্ণু দের ‘কবিতা সৃজনে ব্যাপক ও বিস্তৃত স্থান অধিকার করেছিল বাংলাদেশ। তাঁর দুটি মাত্র প্রবন্ধের বই বের হয়েছে এই সময়ে, কবিতাগ্রন্থ একটিও নয়। তিনি কি নিষ্ফলা ছিলেন? এতটুকুও না। তাঁর ভেতর বাংলাদেশ নিয়ে একটা ক্ষত তৈরি হয়েছিল। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে তিনি সম্যকই উপলব্ধি করেছিলেন।’ অনুসন্ধানে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখা বিষ্ণু দের অন্তত দুটি কবিতা পাওয়া যায়, যার একটি ছাপা হয়েছিল পরিচয়–এ। তা ছাড়া তাঁর সম্পাদনায় মনীষা গ্রন্থালয় থেকে বেরিয়েছিল বাংলাদেশের কবিতা: এক স্তবক। ওই সংকলনের সম্পাদকীয়তে বিষ্ণু দে লিখেছিলেন, ‘১১ই মার্চ মাসের শেষ কয় সপ্তাহের পর থেকে যে মানবেতিহাসে তুলনাহীন অমানুষিক অত্যাচার পূর্ব বাংলায় চলছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের গত বছরের সংকলন চিন্তাটাই কেমন যেন অবান্তর নয়, কিন্তু গৌণ, খঞ্জ হয়ে গেল। আর মন তো উন্মুখ হয়ে আছে ভবিষ্যতের ত্বরিত আশায়, যদিও এত দূর থেকেও এই যন্ত্রণাবোধ আজ মর্মান্তিক “এ আমার এ তোমার পাপ।”
‘পূর্ব বাংলার, অর্থাৎ নবজাতক বাংলাদেশের বন্ধুদের কাছে আমাদের আত্মগ্লানির নিবেদন—তাঁরা যেন মৈত্রীর সহিষ্ণু চোখে এই অক্ষম অসম্পূর্ণ সংকলনটি গ্রহণ করেন।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় কবিতা অনেকে লিখেছেন, ভালো কবিতাও। তবে ১৯৭১–এ লেখা একটি কবিতাই আজ ৫০ বছর পর সবার কাছে পরিচিত—বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা অন্নদাশঙ্করের কবিতা:
‘যত কাল রবে পদ্মা যমুনা
গৌরী মেঘনা বহমান
ততক্ষণ রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।’
অন্নদাশঙ্কর নির্দিষ্টভাবে কখনো বলেননি, কবে তিনি এটি লিখেছেন। কিন্তু তাঁর এক সাক্ষাৎকার থেকে তারিখটি অনুমান করছি—৭ আগস্ট। কারণ, ওই দিন পশ্চিমবঙ্গে ‘মুজিব দিবস’ পালিত হয়েছিল। (১৯৭৫–এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করা হয়। তাই অনেকের ধারণা, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তিনি কবিতাটি লিখেছিলেন, যদিও ধারণাটি সঠিক নয়।) অন্নদাশঙ্কর বলেছেন, তিনি শুনলেন পাকিস্তানের কারাগারে মুজিবকে হত্যা করা হতে পারে। এতে তাঁর মন খারাপ হয়ে যায়। ‘ভাবলাম, এত বড় এক মহান নেতা ও দেশপ্রেমিককে হত্যা করা হবে? এ সময় একদিন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় আমাকে এসে শেখ মুজিবকে হত্যা করার আশঙ্কার কথা ফের বললেন। তিনি জানালেন, এ ব্যাপারে কলকাতা মাঠে এক জনসভার আয়োজন করা হয়েছে। আমাকে সেখানে যেতে হবে। আমি রাজি হয়ে যাই। সভার দিন আমাকে বাসা থেকে নিয়ে গেলেন অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায় ও তাঁর স্বামী নির্মল কুমার বসু। আমি গিয়ে দেখি প্রচণ্ড ভিড়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তারস্বরে বক্তৃতা করছেন। আমি ওই দিন বাড়িতে ফিরে এসেই শেখ মুজিবকে নিয়ে কবিতাটি লিখে ফেলি।’
পশ্চিম বাংলার আরেক কবি গোলাম কুদ্দুস বলেছিলেন, তাঁর কবিতা ‘নিরস্ত্র অন্ধকারে যে ধ্রুব নক্ষত্রটি জ্বলে আকাশে/ ভালোবাসার মতো, বিবেকের মতো/ সে আজ নেমে এল মাটিতে...’ বিভিন্ন সভা–সমাবেশে আবৃত্তি করা হতো। তিনি আরও বলেন, ‘ভারতের বিখ্যাত উর্দু কবি পারভেজ শাহেদির কথা এখনো মনে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য তিনি লিখেছিলেন কবিতা। সেসব উর্দু কবিতা কলকাতায় উর্দুভাষী এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল অবাঙালি মুসলমানদের প্রতি সমর্থন আদায়ের জন্য।’
এ লেখায় কবি বা কবিতার মূল্যায়ন আমার লক্ষ্য নয়, আমি কবিদের আবেগের কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরেছি মাত্র। পরিচিত কবিদের পাশাপাশি এই প্রজন্মের কাছে এখন খানিকটা অপরিজ্ঞাত, এমন লেখকদেরও পঙ্ক্তিমালা চয়ন করার মাধ্যমে এখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ওপার বাংলার লেখকদের সহমর্মিতার রূপটি বোঝার চেষ্টা করেছি।
মুক্তিযুদ্ধকালে পশ্চিমবঙ্গে লেখা হয়েছে অনেক কবিতা। কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে এত কবিতা, এত ছড়ার মধ্যে দুটি কবিতা যেন কালোত্তীর্ণ—এখনো আবৃত্তিকারদের মুখে মুখে ঘোরে। এর একটি শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা, আর অন্য কবিতাটি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। ‘যদি নির্বাসন দাও’ নামে একাত্তরের জুলাইয়ে রচিত কবিতাটিতে তিনি চিত্রিত করেছিলেন যুদ্ধকালের বাংলাদেশকে:
‘বিষণ্ন আলোয় এই বাংলাদেশ...
এ আমারই সাড়ে তিনহাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াব
আমি বিষপান করে মরে যাব।’
স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর প্রান্তে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের এই সাহিত্যিকদের কবিতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সাহিত্যের অন্য এক অধ্যায়কে মনে করায়, তেমনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁদের উত্তাপটিও আমরা বুঝতে পারি।
লেখার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকালে লেখা কলকাতার দুই কথাসাহিত্য বনফুল ও নরেন্দ্রনাথ মিত্রের কবিতা দুটি এখানে পত্রস্থ হলো। বনফুল কবিতাটি লিখেছিলেন ১৯৭১–এর ২০ এপ্রিল, আর নরেন্দ্রনাথ মিত্র কবিতাটি কবে লিখেছিলেন, তা জানা যায় না।

যুদ্ধদিনে লেখা কলকাতার কথাসাহিত্যিকদের কবিতা

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

বনফুল

কোথায় আবার

রক্ত হয় রক্তজবা।
রক্ত হয় রক্তকমল
কোথায় শেষে।
কোথায় আবার?
বাংলাদেশে, বাংলাদেশে।
কুসুমসম কোমলপ্রাণ
বজ্র হয় গর্জমান।
কোথায় শেষে।
কোথায় আবার?
বাংলাদেশে, বাংলাদেশে।
চিরশ্যামল মাঠের তলায়
অগ্নিগিরির খবর মেলে।
কোথায় শেষে।
কোথায় আবার?
বাংলাদেশে, বাংলাদেশে।

নরেন্দ্রনাথ মিত্র
জয় বাংলা

সুজলা সুফলা দেশ রক্তে ভাসে
মুটে মজুরের রক্ত তাঁতি জেলে ছুতোরের
নিরীহ চাষির রক্ত শস্যে ঘাসে
কামান বন্দুক হাতে পিশাচ হাসে।
শ্যামলা সুফলা দেশ রক্তে ভাসে
গুণী জ্ঞানীদের রক্ত, যুবা বৃদ্ধ শিশু বনিতার
পবিত্র রক্তের বন্যা চক্ষে ভাসে
বোমারুর আস্ফালন নীল আকাশে।
সুজলা সুফলা দেশ রক্তে ভাসে
সহস্র বীরের রক্ত জন্মভূমির
সমস্ত কলুর গ্লানি নিমেষে নাশে
জয়ধ্বনি মুখরিত শ্বাসে প্রশ্বাসে।