বব ডিলান: কবি নাকি গায়ক

বব ডিলান: গানে-কবিতায় বারবার খুঁজেছেন মানুষের মুক্তির পথ
বব ডিলান: গানে-কবিতায় বারবার খুঁজেছেন মানুষের মুক্তির পথ
ঘটনাটি চমক-জাগানো। এ বছর সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন মার্কিন গায়ক ও গীতিকবি বব ডিলান। নানা আয়োজনে সংখ্যাটি সাজানো হয়েছে ডিলানকে নিয়েই

অবশেষে সাহিত্যে এ বছর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বব ডিলান। অবশেষে বললাম এই কারণে, গত এক দশক অনেকবারই তিনি নোবেল পাচ্ছেন এমন গুজব উঠেছে। কয়েক বছর আগে, আমেরিকার বিটনিক কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ডিলানকে নোবেল দেওয়ার দাবি তুলে রীতিমতো শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন।

আমেরিকান নিজস্ব ধাঁচের ফোক ও রক গানের এই শিল্পীর সঙ্গে আমাদের পরিচয় মুখ্যত গত শতকের ষাটের দশকে—তাঁর গাওয়া যুদ্ধবিরোধী সংগীতের হাত ধরে। সে সময়ে ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের প্রতিবাদ হিসেবে এবং নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সপক্ষে সেসব গান শুধু আমেরিকায় নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও সহর্ষে ও সানন্দে গীত হয়েছে। ১৯৬৩ সালে ওয়াশিংটনে মানবাধিকার ও মুক্তির দাবিতে লাখো মানুষের মিছিলে মার্টিন লুথার কিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে গান ধরেছিলেন ডিলান।

 ‘দ্য টাইমস দে আর এ চেঞ্জিং’, ‘ব্রিঙ্গিং ইট অল ব্যাক হোম’ বা ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’—এসব ছিল সে সময়ের তারুণ্যের ‘এন্থেম’, কোনো এক দেশের নয়—সব দেশের। প্রতিবাদী সেসব গানের প্রায় সবই তাঁর নিজের লেখা, কিন্তু কবিতা হিসেবে সেগুলো আমরা কেউ বিবেচনা করিনি। এর কারণও ছিল। ঠিক প্রথাগত কবিতা সেগুলো নয়, কবিতার প্রচলিত কোনো ফর্মও সেগুলো তারা মেনে চলে না। এমনকি এ কবিতাগুলোর নিয়মমাফিক কোনো অর্থ উদ্ধারও খুব সহজ নয়। গীত না হলে সে গানের আলাদা কোনো মূল্য রয়েছে, এ কথাও হয়তো অনেকে মানবেন না।

শুধু কবিতা হিসেবে ডিলানের গানের অর্থ উদ্ধার কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। হার্ভার্ডের ‘কবিতা অধ্যাপক’ ও নামজাদা সাহিত্য-সমালোচক ক্রিস্টোফার রিকস ২০০৪ সালে প্রকাশিত তাঁর ঢাউশ ডিলান’ সভিশনস অব সিন গ্রন্থে ডিলানের গানকে কবিতা হিসেবেই বিবেচনা করেছেন। তাঁর কথায়, এই কবিতা ইংরেজি সাহিত্যের প্রচলিত ধারা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা কিছু নয়; বরং এই ভাষার শ্রেষ্ঠ কাব্যকীর্তির সঙ্গে তা সম্পৃক্ত। ইংরেজি কাব্যের একটি অন্তর্গত অনিবার্য চেতনা খ্রিষ্টপ্রেম, কখনো সরাসরি—কখনো কাব্যিক-প্রতীকময়তায় প্রকাশিত হয় সে প্রেমরস। ডিলানের কবিতা এই চেতনা থেকে স্বতন্ত্র নয়। টি এস এলিয়ট অথবা ইয়েটসের মতোই ডিলানের কবিতার তিনটি প্রধান স্তম্ভ হলো—পাপবোধ, পুণ্য চেতনা ও ঈশ্বরের করুণা। অধ্যাপক রিকস ডিলানকে ইংরেজি কাব্য জগতের একজন সেরা ‘ছান্দসিক’—রাইমস্টার হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন।

তারপরও ডিলান শুধু একজন গায়ক ও গীতিকার নন, তিনি একজন কবিও—এই তর্ক একদম ফুরোয়নি। ফোক ঐতিহ্যে অনেক গায়কই গান লিখেছেন, তাঁদের কাউকে আমরা কখনো কবি হিসেবে আলাদা সম্মান দেইনি। তাহলে ডিলান কেন? আমেরিকার প্রাক্তন পোয়েটলরিয়েট বিলি কলিন্স বলেছেন, সুর ছাড়া শুধু কথায় কোনো গীতিকবিতা অর্থপূর্ণ হয় না। কিন্তু এই নিয়মের এক ব্যতিক্রম ডিলান, হারমনিকা ও গিটার ছাড়াও তাঁর গান কবিতার মর্যাদা পায়।

২০১৬ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জনের ভেতর দিয়ে কবি হিসেবে ডিলানের এই স্বীকৃতি আরও পোক্ত হলো। সুইডিশ একাডেমি তাদের নোবেল পুরস্কার ঘোষণায় বলেছে, ডিলান আমেরিকান সাংগীতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে এক নতুন কাব্যিক প্রকাশ অর্জন করতে পেরেছেন।

‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’–এ জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে তরুণ বব ডিলান, ১ আগস্ট ১৯৭১। ছবি: সংগৃহীত
‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’–এ জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে তরুণ বব ডিলান, ১ আগস্ট ১৯৭১। ছবি: সংগৃহীত

এই প্রথম একজন গীতিকার নোবেলে ভূষিত হলেন এমন নয়। বাঙালির রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গীতাঞ্জলির ইংরেজি ভাবানুবাদ সংগস অফারিং-এর জন্য এক শ বছরেরও আগে এই একই স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। তবে সংগস অফারিং যে আদতে বাংলা গান—কথাটি জানা ছিল না নোবেল কমিটির। এই বইটিকে তারা ইংরেজি সাহিত্যধারার অংশ হিসেবেই পুরস্কৃত করেছিল। এর ফলে বব ডিলানই প্রথম গীতিকার, যাঁর লেখা গান সাহিত্য হিসেবে এমন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করল।

ডিলানের বয়স এখন ৭৫। তাঁর জীবনের ৬০ বছরই তিনি কাটিয়েছেন গায়ক ও গীতিকার হিসেবে। তা সত্ত্বেও কোনো অভিন্ন এক মোড়কে তাঁকে বাঁধা যাবে না। অনবরত বদলেছেন ডিলান, নিজেকে গড়েছেন নতুন করে। জন্মেছিলেন ইহুদি পরিবারে, রবার্ট জিমারম্যান হিসেবে। সত্তর দশকের শেষভাগে এসে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে হন ‘বর্ন এগেইন ক্রিশ্চিয়ান’। আশির দশকে এসে আবার ফিরে গেলেন ইহুদি ধর্মে।

গানের ক্ষেত্রেও বদলেছেন মত ও পথ। মার্কিন লোকশিল্পী ও চারণকবি উডিগাথরি ছিলেন তাঁর প্রথম অনুপ্রেরণা, প্রথম জীবনে গাথরির লেখা ও গীত সংগীতকে মালার মতো জড়িয়ে ধরেছিলেন। সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন আমেরিকান দক্ষিণের কালো মানুষের গান ব্লুজ। অ্যাকুস্টিক গিটারে তোলা ডিলানের সে গান পৃথিবীকে চমকে দিয়েছিল বটে। কিন্তু খ্যাতির চূড়ায় উঠেই অ্যাকুস্টিক ছেড়ে ইলেকট্রিক গিটার ধরলেন, ফোক ছেড়ে চলে গেলেন রক অ্যান্ড রোলে।

ডিলানের সঙ্গে আমাদের যখন প্রথম পরিচয়, সে সময় গানকে তিনি ব্যবহার করছিলেন সমকালীন রাজনীতির কমেন্টারি হিসেবে। এখানে তাঁর কণ্ঠস্বর তীর্যক, ক্রুদ্ধ ও প্রতিবাদী; তাঁর ব্যবহৃত ভাষা ও কাব্য-কাঠামো সরল। এই পর্যায়ের একটি জনপ্রিয় কবিতা/গান ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’। ১৯৭১-এর ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে এ গান দিয়েই পরিবেশনা শুরু করেছিলেন এই তারকা।

‘কতটা পথ হাঁটা শেষ হলে তুমি

একজন মানুষকে মানুষ বলবে?

কত সাগর উড়াল দিয়ে

       অবশেষে শ্বেতপায়রা

       বালুতে ক্ষান্তি পাবে?

কতবার কামানের গোলা

       দাগা হলে

তাকে নিষিদ্ধ করা হবে?

এ প্রশ্নের জবাব, বন্ধু আমার,

    এখন ভাসছে বাতাসে

বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে

    সেই জবাব।’

তাঁর অধিকাংশ গান/কবিতার মতো এইটির উৎসও ‘ট্রাডিশন’-এ। তিনি নিজে বলেছেন, গানটি সংগ্রহ করেছেন নিগ্রোস্পিরিচুয়াল ‘নো মোর অকশন মোর’ থেকে, ডিলান এখানে নতুন যা করেছেন তাহলো অ্যাকুস্টিক গিটারে সে কথার সাংগীতিক বিন্যাস। নিগ্রোস্পিরিচুয়ালটি ছিল দাসপ্রথার বিরুদ্ধে, ডিলানের হাতে তা হয়ে গেল যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদ-সংগীত। এই কবিতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ডিলানের কথা, যে প্রশ্নের জবাব আমরা খুঁজছি তা যেকোনো প্রসঙ্গেই হতে পারে—তার উত্তর সন্ধানে মোটা মোটা বই অথবা কোনো ফিল্ম দেখার দরকার নেই। সে উত্তর বাতাসেই আছে। সমস্যা হলো, ওই উত্তরের জন্য সবাই কান পাতে না, অথবা উড়ন্ত হাওয়া থেকে তা কুড়িয়ে নেয় না।

এই রাজনৈতিক ডিলান আরও তীব্রভাবে প্রকাশিত হন ১৯৬২-তে কিউবায় সোভিয়েত আণবিক অস্ত্র মোতায়েন প্রশ্নে আমেরিকার সঙ্গে ভয়াবহ যুদ্ধের আশঙ্কার পটভূমিকায় লেখা ‘এ হার্ড রেইন ইজ এ গনা ফল’ গানটিতে: ‘আমার নীল-নয়ন পুত্র, তুমি কোথায় ছিলে?/ আমার বাপধন, তুমি/ কোথায় ছিলে?/ আমি পা হড়কে পড়েছি বারোটা কুয়াশাঘেরা পাহাড়ের পাশে/ আমি হামাগুড়ি দিয়ে চলেছি কুটিল বারোটি মহাসড়কে/ আমি পা গলিয়ে ঢুকেছি বিষণ্ন সাত অরণ্যে/ আমি এসে দাঁড়িয়েছি এক ডজন মৃত মহাসাগরের সম্মুখে/ দশ হাজার মাইল পেরিয়ে আমি পৌঁছেছি এক মহাশ্মশানের মুখে/ তবুও বলছি, এবার একটি প্রবল, তীব্র, নির্দয় বৃষ্টি নামবেই নামবে।’

শুধু কবিতা হিসেবে পাঠ করলে এই ‘নির্দয় বৃষ্টি’ আদৌ বোধগম্য হবে না। অথচ কিউবান সংকটের আলোকে এই গান শুনলে তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর মোটেই অগম্য থাকে না আমাদের কাছে। গীতাঞ্জলির অনেক গানও শুধু কবিতা হিসেবে পুরোপুরি অর্থপূর্ণ হয় না, বোধের অসম্পূর্ণতা মেটাতে চাই তার গায়ন।

ডিলান নিজে এই গান/কবিতা লেখার পটভূমি বর্ণনা করেছেন এভাবে—‘কিউবান সংকটের সময় আমি থাকতাম নিউইয়র্কের ব্লিকার স্ট্রিটে। রাতে আমরা সবাই বাক্হীন হয়ে ভাবতাম, তাহলে কি সবই শেষ? নিশ্চিত ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে আমরা কী করতে পারি? এটি ছিল সেই ভীতি ও উদ্বেগের বিবরণ, সর্বগ্রাসী সেই অর্থহীনতাকে বোঝার এক চেষ্টা।’

ষাটের দশকের শেষ ভাগে, সত্তর দশকের গোড়ার দিকে তাঁর গান বা কবিতার যুদ্ধবিরোধী ভাষ্য বদলে যায়, হয়ে পড়েন অন্তর্মুখিন, কবিতার বিষয়বস্তু এবার আত্মজৈবনিক। ১৯৭৪-এ রেকর্ডকৃত ‘ইডিয়ট উইন্ড’ গানটির কথা ধরা যাক। এখানেও শোনা যায় ‘হাওয়ায় উড়ে আসা কণ্ঠ’, কিন্তু এর পরিপ্রেক্ষিতটি বদলে গেছে সম্পূর্ণ। সেই সময় ডিলান তাঁর প্রথম স্ত্রী সারা লৌন্ডসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন বিবাদে, বিচ্ছেদের কথা ভাবছেন। নিজের মুখে বলেছেন এই কবিতাটি মোটেই নিজেকে নিয়ে নয়, কিন্তু এর সুরটি যে ব্যক্তিগত, তা অস্বীকার করার জো নেই। বাতাসকে একসময় ডিলান পরিবর্তনের—এমনকি আশা ও সম্ভাবনার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এখন ব্যক্তিগত সংকটের মুখোমুখি হয়ে সে বাতাস হয়ে পড়ে বেদনার সাক্ষ্যভাষ্য: ‘নির্বোধ হাওয়া/ তুমি মুখ নাড়লে বয় এই হাওয়া/ পেছনের দক্ষিণমুখো রাস্তায়/ বয় সে নির্বোধ হাওয়া/ এমনকি তোমার দাঁত নড়লে নড়ে ওঠে সে/ তুমিই নির্বোধ, হে প্রিয়ে!’

পরবর্তী সময়ে লেখা ‘লোনসামব্লুজ’ কবিতাতেও দেখি সেই বাতাস, হতাশার প্রতীক হিসেবে যে আরও তীব্র ও প্রত্যক্ষ মূর্তিতে উপস্থিত: ‘কাল রাতে কানে কানে কথা বলেছিল বাতাস/ কী কথা বুঝিনি/ নিজেকে বোঝাই, হয়তো একটা পরিবর্তন আসছে/ কিন্তু হায়, কখনোই আসে না সে।’

ব্যক্তিগত সংকট ও অনিশ্চয়তা গোড়া থেকেই ধরা পড়ে তাঁর কবিতায়। পরিণত ডিলানের কবিতায় এর সঙ্গে যুক্ত হয় ধর্মচেতনা, তাঁর ইহুদি-খ্রিষ্টীয় ইতিহাসবোধ ও নৈতিক প্রবজ্যা। এই ধারার সেরা কাজ ১৯৭৯-এ প্রকাশিত অ্যালবাম স্লো ট্রেইনকামিং। তত দিনে অবশ্য খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছেন ডিলান, সে ধর্মের কোনো কোনো আচার-আচরণে আকর্ষিত হচ্ছেন। এমনকি একধরনের খ্রিষ্টীয় নীতিবোধেও হচ্ছেন সংক্রমিত, যার প্রভাবে এমন অবাক দুটি বাক্য এই অ্যালবামের নাম গানে পাই আমরা: ‘নিজেকে উৎসর্গ করো/ হোক সে শয়তান অথবা প্রভু/ কারো না কারোর কাছে, নিজেকে উৎসর্গ করো।’

ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিষ্টানদের কাছে এই গান যিশুর সেবায় উৎসর্গের আহ্বান হিসেবে স্বাগত হয়েছিল, অথচ একই গানের শেষ চরণে এসে ডিলান ভিন্ন আরেক অর্থের সঙ্গে পরিচিত করান আমাদের: ‘অর্থনীতি নিয়ে আমার নেই উদ্বেগ/ উদ্বেগ নেই গ্রহতত্ত্ব নিয়ে/ শুধু উদ্বেগ প্রীয়জন যখন ক্রীড়নক হয়/ তবে জানি, বাঁক পেরিয়ে ধীরগতির ট্রেনটি ঠিকই আসছে।’

 ‘আমার প্রিয়জনেরা ক্রীড়নকে পরিণত হচ্ছে, তা দেখে আমি পীড়িত’—ডিলানের এই কাতর উচ্চারণ শেষে ঘোষণা, ‘বাঁক পেরিয়ে ধীরগতির ট্রেনটি আসছে’—সে কথার অর্থ যে ধর্মের জামা গায়ে যাঁরা অভিনয় করেন, তাঁদের বিষয়ে সতর্কবার্তা, সেটি বোঝাও কঠিন নয়।

এই প্রতীকময় দ্ব্যর্থবোধকতাই ডিলানের কাব্যের প্রাণ। ‘অল অ্যালং দ্য ওয়াচটাওয়ার’ গানটির কথা মনে করা যাক। পথচলতি এক ভাঁড় ও তস্করের মধ্যে কথোপকথনের ভিত্তিতে নির্মিত এ গান যেন তাঁর যাপিত সময়ের ধারাবিবরণী। ডিলান এখানে নিজেকেই ভাঁড় বলে উপহাস করছেন, তাঁর লক্ষ্য প্রচলিত জীবনাভিজ্ঞতার অর্থহীনতার চিহ্নায়ন। অথচ এই প্রবল ব্যক্তিগত কবিতাটিও হয়ে উঠেছিল আমেরিকার ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধীদের প্রতিবাদ সংগীত। তাঁর এই লাইনের জন্য: ‘দেয়ার হ্যাজ টু বি সাম কাইন্ড অব ওয়ে আউট অব হেয়ার—এখান থেকে বেরুবার একটা পথ চাই।’

জোয়ান বায়েজ ও বব ডিলান—অন্তরঙ্গ বন্ধু। ছবি: সংগৃহীত
জোয়ান বায়েজ ও বব ডিলান—অন্তরঙ্গ বন্ধু। ছবি: সংগৃহীত

অথবা তাঁর বহুশ্রুত ‘মি. ট্যাম্বুরিনম্যান’ কবিতাটির কথা ভাবুন। প্রথম পাঠে অধিকাংশের কাছে এই কবিতা মাদকসেবন অভিজ্ঞতার বিবরণ মনে হতে পারে। তবে বাইরের খোলসটি ভেঙে ফেললে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অর্থ মেলে কবিতার। কোনো ছায়ার পেছনে নয়, প্রকৃত সুরের পশ্চাতে ছুটছেন তিনি, যে সুরের প্রতীক এই ট্যাম্বুরিনবাদক। সেই বাদকের কাছে কবির আকুতি, দয়া করে আমার জন্য একটি গান তুমি বাঁধো, আমাকে তোমার ঐন্দ্রজালিক ঘূর্ণি-জাহাজে নিয়ে চলো। তাহলে ধোঁয়াটে আঁধার কাটিয়ে সত্যকে ছুঁতে পারব, পাব মুক্তি। সে জন্যই তাঁর এই আর্তস্বর: ‘টু ড্যান্সবিনিথ দ্য ডায়মন্ড স্কাই উইথ ওয়ান হ্যান্ডওয়েভিং ফ্রি/সিলুএটেড বাই দ্য সি।’

 বস্তুত, ডিলানের গান/কবিতার দুর্বোধ্যতার একটি উৎস তাদের গঠনগত চেতনাপ্রবাহ। নিজেই তিনি তাঁর কবিতাকে বলেছেন ‘চেইনস অব ফ্লাসিং ইমেজেস’। এই শৃঙ্খলিত চিত্রকল্পের ঝলকানি পরিকল্পিত নয়, স্বতঃস্ফূর্ত। একে বুঝতে হলে খুলে রাখতে হবে কল্পনার জানালা, ঠিক পাবলো পিকাসোর ‘কিউবিস্ট’ পর্বের ছবি আমরা যেভাবে দেখি। সামনে থেকে দেখলে তার অর্থ একরকম, পাশ ফিরে তাকালে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটি মোটেই কাকতালীয় নয় যে ১৯৬১-তে নিউইয়র্কে প্রথমবারের মতো পিকাসোর ছবি দেখে ডিলানের মনে হয়েছিল, এই শিল্পী একজন বিপ্লবী। আত্মজৈবনিক বই ক্রনিকলস-এ ডিলান লিখেছেন, সে ছবি দেখে তিনি চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, ‘আমি ঠিক এই পিকাসোর মতো হতে চাই।’

 টারানচুলা—এই নামে ডিলানের একমাত্র প্রকাশিত গদ্য কবিতার বই, যাকে কখনো কখনো উপন্যাস হিসেবেও বর্ণনা করা হয়, সে কথারই আরেক প্রমাণ। ফরাসি কবি আর্তুর র‍্যাঁবোকে নিজের কাব্যের প্রধান প্রভাব হিসেবে বর্ণনা করেছেন ডিলান। সম্ভবত এই বইটি র‍্যাঁবোর অনুসরণে বহুস্তরভিত্তিক ছায়াময় এক অসম্ভব স্বপ্নের বিবরণ। অসংলগ্ন কাহিনি ও অসম্পূর্ণ বাক্যের বিরতিহীন চেতনাপ্রবাহের কারণে এই পুস্তকের গঠনগত চরিত্রকে পরাবাস্তব হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন কেউ কেউ। কিন্তু ডিলানের গানে কথা ও সুরের মিশ্রণ যেভাবে সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতারূপে ধরা দেয়, টারানচুলায় সেটি আমরা পাই না। এই অপূর্ণতার জন্য পরে নিজেই বইটির বিষয়ে তাঁর অস্বস্তির কথা বলেছেন।

আরও একটি গদ্যের বই লিখেছেন তিনি, ২০০৪ সালে প্রকাশিত তাঁর আত্মজৈবনিক রচনা ক্রনিকলস। সন-তারিখ গুণে প্রথাগত স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী এটি নয়, নয় তাঁর কবিতার মতো দ্ব্যর্থবোধকও। বিস্ময়কর রকম সরল, নিরাভরণ ও একরৈখিক এই বই ডিলানের ‘রকস্টার’ হয়ে ওঠার নিম্নকণ্ঠ বিবরণ। এখানে খুব কম ক্ষেত্রেই নিজেকে পুরোপুরি উন্মোচন করেন তিনি, অথবা তাঁর কবিতা ও গানের অন্তর্গত বৈপরীত্য বুঝতে সাহায্য করেন আমাদের। আবার আকস্মিকভাবে এমন একটি কথাও সবাইকে জানান যে—আছে অথচ নেই, এমন অভিজ্ঞতাকে নিকটতর করার তীব্র অথচ নিভৃত তাগিদ থেকেই তিনি গান লেখা শুরু করেছিলেন।

কী সেই অভিজ্ঞতা, যা আছে অথচ নেই, সেটি জানতে হলে বব ডিলানের গানের কাব্যশক্তিকেই আমাদের উদ্ধার করতে হবে।