নবীনের উদ্বোধন

‘আত্ম/পরিচয়’ প্রদর্শনী। ছবি: প্রথম আলো
‘আত্ম/পরিচয়’ প্রদর্শনী। ছবি: প্রথম আলো

বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর বটবৃক্ষ ও বটতলা নিয়ে সাংস্কৃতিক আহ্লাদ বস্তুনির্ভর নয়। তাই কলকাতার সাংস্কৃতিক স্ফূর্তিতে যখন ছাপাখানার বদৌলতে ‘বটতলা’র আবির্ভাব হলো, সেই নব উদ্বোধনের সূত্রে চিত্রজগতের বা ছাপাই ছবির জগতের যে পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়ে উঠল, তার মালমসলা এমনকি সৌন্দর্যজ্ঞান কোনোটাই শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে আপন বলে ধার্য হয়নি। একই কারণে নিউ মিডিয়া আর্ট, স্থাপনাশিল্প বা ডিজিটাল মাধ্যমের বদৌলতে জন্ম নেওয়া নবীন শিল্পকলা ‘আর্ট এস্টাবলিশমেন্ট’-এর কাছে অতটা আদরণীয় হয়ে ওঠেনি। প্রথম আলোর ১৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পত্রিকাটির আয়োজনে ‘আত্ম/পরিচয়’ শিরোনামের প্রদর্শনী এ কারণে অতি জরুরি এক উপস্থাপনা। এটি একনাগাড়ে নব ভাব ও স্থান নির্মাণের উদাহরণ।

.
.

প্রদর্শনীটি হয়েছিল ঢাকার জাতীয় জাদুঘরের বিশাল পরিসরে, ৪ থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত। তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান ও কেহ্‌কাশা সাবাহ। গত পাঁচ-দশ বছরে তরুণ প্রজন্মের যে প্রতিনিধিরা শিল্পে নতুন ভাষা ও ভাবমূর্তি তৈরিতে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন, তাঁদের প্রায় সবাই হাজির ছিলেন এখানে। সব মিলিয়ে ৪২ জন শিল্পীর পারফরম্যান্স ও কাজ প্রদর্শনী কক্ষে তাঁদের ‘পরিচয়’-এর বিবিধতা যেমন উপস্থাপন করেছে, একইভাবে হাজির থেকেছে শিল্পজ স্থান নির্মাণেও।

শিল্পী: হাবিবা নওরোজ ও সানজিদ মাহমুদ
শিল্পী: হাবিবা নওরোজ ও সানজিদ মাহমুদ

স্থানের পরিসরে আরও সাময়িক অবস্থানের পর্বও রয়েছে: অসিম হালদার, অতীশ সাহা, ইফাত রেজওয়ান রিয়া, ফারাহ নাজ মুন ও সনদ কুমারসহ আরও অনেকের পারফরম্যান্স এই প্রদর্শনীর মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি চরিত্রে মাত্রা যোগ করেছে। এ ছাড়া ভিডিও কর্নারে মোট ১১টি ভিডিও চিত্র লুপে চালু করা আছে—জিহান করিম, আবির সোমের মতো শিল্পীরা, যাঁদের স্থাপনা এই প্রদর্শনীর মর্ম ও কলেবর উভয়ের দিশা নির্ধারণ করেছে—তাঁরা ছাড়াও শুধু ভিডিও চিত্র নিয়ে হাজির হয়েছেন ‘ত্রিশুল’ শিরোনামের ইউটিউব শর্ট ফিল্ম নির্মাতা দম্পতি, কাজমিয়া সামি বা রফিকুল শুভর মতো পরিচিত ভিডিও চিত্রী।
নতুন শিল্প বা সাম্প্রতিক ভাষা মানেই আলোকচিত্র, ভিডিও চিত্র, কুড়িয়ে পাওয়া মিডিয়া ইমেজ ও ব্যবহার্য বস্তুর সমারোহ। রীতি অনুসরণে এমনটাই সাব্যস্ত হয়েছে। সব নির্মিত বস্তুই ভাবোদ্দীপক। কিন্তু যাপন ও ব্যবহারসূত্রে অতিপরিচিত হয়ে ওঠা ইমেজ বা বস্তু যে শিল্পের নয়া ভাব প্রকাশে সক্ষম, বর্তমান প্রদর্শনীর কিছু কাজে তা স্পষ্ট।
মিজানুর রহমান সাকিবের কাজে লক্ষ করা যায়, টাইম ম্যাগাজিনের কভার পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে বহুরৈখিক সময়ের গল্প—যাতে শব্দ (ম্যাগাজিনের নামসহ) ও নীরবতা, দৃশ্য ও অদৃশ্য—এই দ্বৈততার ভেতর দিয়ে সুরাহা করা হয়েছে বর্ণনার। অতীশ সাহা, যিনি আলোকচিত্রের নব তারকা, আত্মপরিচয়ের ছবি হাজির করেছেন একই মনোকাঠামোর আশ্রয়ে।

নির্মাণ ও প্রতিনির্মাণ—এই প্রক্রিয়া নতুন শিল্পীদের কাজের মধ্যে শিল্প ও অশিল্পের (বা বস্তুর উপস্থিতির মধ্য দিয়ে অর্থহীনতার) খোঁজ দেয়। আমাদের সজাগ করে চিহ্নের প্রচলিত মানে ও তার বিপর্যয় ঘটিয়ে নতুন অর্থ উৎপাদনের সম্ভাবনা বিষয়ে। পলাশ ভট্টাচার্যর তিন চ্যানেলের ভিডিও চিত্রে বক্তা-বক্তব্য-অর্থ—এই কাঠামোর স্বাভাবিক এক রৈখিকতার বিপর্যয়কে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই শিল্পী বাস্তবের দুনিয়াতে দুনিয়াদারির যে মহোৎসব চলছে তার দিকে নির্দেশ করছেন। ফলে তিনটি টিভিতে চলতে থাকা একই বক্তার (শিল্পী নিজে) এক প্রকার মনোবৈকল্য ধরা পড়ে। যেন চেতনে বা অবচেতনে বক্তা যোগাযোগ, অপযোগাযোগ ও যোগাযোগহীনতার কবলে পড়ে আজ ব্যক্তিত্বহীন ও ইগোসর্বস্ব। জিহান করিমের ভিডিও চিত্রেও মনোবৈকল্যের আভাস আছে—টুথব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজার দৃশ্য এডিটের গুণে কিছুটা দূরবর্তী হয়ে উঠলেও স্বাভাবিক গার্হস্থ্য কার্যক্রমের মধ্যে স্কিৎসফ্রিনিয়ার খোঁজ দেয়।

শিল্পী: রাজীব দত্ত
শিল্পী: রাজীব দত্ত

সুমন ওয়াহিদও বাংলা সিনেমার ইমেজের সমারোহে আত্মপ্রতিকৃতির উপস্থাপন করেছেন। এতে উপস্থিতি ও নির্মাণই একমাত্র উপজীব্য ও উপভোগ্য বিষয়। এই দ্বিতীয় প্রস্থ বিষয় অর্থাৎ অঙ্কন ও চিত্রায়ণ উপভোগের দিকটি বাংলাদেশের বহু শিল্পীর কাজকে প্রতিকৃতি বা আকৃতি ও দক্ষতার মধ্যে আটকে রেখেছে।
আকৃতির মধ্যে ভাঙন বা বিনির্মাণের প্রয়োগ ঘটিয়ে রিপন সাহা আলোচ্য প্রদর্শনীতে ভয়াবহতার দৃশ্যায়ন সম্ভব করে তুলেছেন। অন্যদিকে রাজীব দত্ত একই বিষয় ইনফরমাল ম্যুরালের মধ্যে আরও বড় পরিসরে সম্পন্ন করেছেন। যদিও প্রদর্শনীর প্রবেশদ্বারে আঁকা এই ম্যুরাল তাঁর শৈল্পিক গুরুত্ব হারায় স্থানের কারণে।
শিল্পীর হাতে কাল-চেতনা নানান মাত্রার প্রতীক হয়ে উপস্থিত এই প্রদর্শনীতে। আরিব সোমের ভাঙা বাসনের ছবি ও ফ্লোরে সত্যিকার ভাঙা বাসন, মার্জিয়া ফারহানার দুই ধরনের দুটি স্থাপনা—যার একটিতে ম্যাগাজিনে ছাপা মুখে সাদায় ঢেকে মুখ বা দেহের ভগ্নাংশের সিরিজ, অন্যটিতে পেইন্টারলি ধরনে আঁকা কাটা গরুর ক্যানভাস চিত্রের সঙ্গে প্লাস্টিকের চেয়ার টেপ দিয়ে জুড়ে দেওয়া; ইশিতা মিত্রের বৈতালিক ভাস্কর্য, যেখানে প্লাস্টিক ধাতুর বস্তু, খেলনা জটলা, কিংবা সুমনা আক্তারের কসাইয়ের হাতে গোলাপ কাটার ভিডিও চিত্র; যা মেঝেতে ছোট করে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। সবই সময়ের কড়চামতন। যে হিসাব গণমাধ্যম দিতে অক্ষম, সেই সময়ের অপচয় এবং পরিচয় ও পরিণতিবিষয়ক বিভ্রম শিল্পীদের কাজে সরল-গরল এমনকি গোলমেলে উপায়ে প্রকাশ পাচ্ছে। জগৎ ও জীবন পুঁজিবাদের অন্তিম পর্বে যদি অপরিচিত হয়ে উঠছে বলে বুঝতে পারা যায়, শিল্পের ভাষাও তার বিপরীতে খাপছাড়া কম্পোজিশন, বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্ত চিহ্ন বা বিষয়বস্তুনির্ভর হয়ে উঠছে কখনো কখনো। অর্থাৎ ভাব-ভাষা-বস্তুর—এই ফ্রেম বাস্তবে যে ভেঙে পড়েছে, তা শিল্পীর নজরে পড়েছে। শ্লেষ, অতিশয়োক্তি দিয়ে কেউ কেউ এর উত্তর হাজির করছেন; কেউ বা শিল্প গড়ার পদ্ধতি হিসেবে এমন উপায় বের করছেন, যা আসলে আর্ট বলে যে আর্কাইভ করার উপযোগী বস্তু তা নাকচ করার মধ্য দিয়ে সম্ভব হয়ে উঠছে।

ইমরান সোহেলের কাজে বিদেহী আপনজনের পরিচিত পোশাক-আশাকের ছোট স্তূপ ও দেয়ালের ওপরে ক্ষয়ের চিহ্ন একত্রে অনুপস্থিতির বাস্তব আখ্যান গ্যালারিতে নিয়ে আসে।

নব প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে গোলকায়ন ও এ-সংক্রান্ত বিপর্যয়ের সমকালীন চিত্র উঠে আসে নিয়াজউদ্দিন আহমেদের খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্রে। এতে ‘সাবজেক্ট’ বা স্বয়ংক্রিয় ব্যক্তিত্বের সংকট ও প্রযুক্তিনির্ভর সমাজের প্যাথলজি নিউ মিডিয়া সূত্রে হাজির আছে। উপস্থাপিত প্রতীকসমূহ উপস্থাপনার ধরনের কারণে অভিব্যক্তির শক্তি বাড়ায়—কারণ মিডিয়ার সরঞ্জাম, অর্থাৎ তারের আয়োজন একধরনের কম্পোজিশনের জন্ম দেয়, যার সুরাহা জরুরি ছিল।

নতুন শিল্পে আলো একটি মাধ্যম। মিহির মশিউর তৈরি করেছেন একটি ইনডেক্স বা সারণি—যাতে হলি আর্টিজানে মৃতদের নাম আলোতে ফুটে আছে। মধ্যপ্রাচ্যের নব সংগঠিত জঙ্গিগোষ্ঠীর দেশীয় অনুসারীদের হত্যাযজ্ঞ তিনি স্মৃতি হিসেবে পুনরুৎপাদন করতে ভয়াবহতা থেকে দূরে থেকে সমাধির স্থিরতা ব্যবহার করেছেন। তাঁর কাজে একমাত্র সচল উপাদান হলো লেজার রশ্মি—যার ব্যবহার পরিমিত।

বাঙালির আত্মপরিচয়ের রাজনীতি স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় সম্ভব করেছে। ভবিষ্যৎ নির্মাণ আত্মপরিচয়ে নির্মাণের সঙ্গে শামিল। ‘আত্ম/পরিচয়’ শিরোনামের প্রদর্শনীতে শিল্পের ভবিষ্যৎ জারি আছে। নতুন চিহ্ন ও আঙ্গিক নতুন অর্থ উৎপাদনে সহায়ক। তেমনই নতুনতর উপায়ে পুরোনো, পরিচিত উপাদান সাজিয়ে নতুন পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করে নতুনতর ভাষ্য জন্ম দেওয়া যায়। এই প্রদর্শনীর নানান কাজে এমন প্রক্রিয়ার আলামত বর্তমান। মোদ্দা কথা, প্রদর্শনীটির শিক্ষা হলো, যাঁরা আকার, সাকার ও নিরাকার—এই তিনের মধ্য থেকে শিল্প গড়া ও ভাঙার প্রক্রিয়ায় আছেন, তাঁরাই দিগন্তে নতুন চিহ্ন যোগ করতে পেরেছেন।