'অনুবাদ একটি সৃজনশীল শিল্প'

>
ডেবোরা স্মিথ। ছবি: আবদুস সালাম
ডেবোরা স্মিথ। ছবি: আবদুস সালাম

ম্যান বুকার পুরস্কারজয়ী অনুবাদক ডেবোরা স্মিথ। কোরিয়ান ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে খ্যাতিমান এই তরুণ অনুবাদক পুরস্কারটি পেয়েছেন এ বছর। ঢাকা লিট ফেস্টে অংশ নিতে কিছুদিন আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিনয় বর্মণ

বিনয় বর্মণ: হ্যান ক্যাঙের দ্য ভেজিটেরিয়ান ও হিউম্যান অ্যাক্টস অনুবাদ করেছেন আপনি। এই দুটো উপন্যাসকে সহজভাবে কীভাবে তুলনা করবেন?

ডেবোরা স্মিথ: দ্য ভেজিটেরিয়ান-এর চেয়ে হিউম্যান অ্যাক্টস অনেক বেশি কোরীয় প্রকৃতির। অর্থাৎ দ্বিতীয় উপন্যাসটি দক্ষিণ কোরিয়ার সত্যিকারের ঐতিহাসিক ঘটনানির্ভর। এর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট কেবল সে দেশের পাঠকের কাছেই পরিচিত। অন্যদিকে দ্য ভেজিটেরিয়ান যদিও কোরিয়ার পটভূমিতে লেখা, এর গল্পটি সর্বজনীন। এটি আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছে বেশি বোধগম্য।

বিনয়: হ্যান ক্যাঙের দ্য ভেজিটেরিয়ান অনুবাদ করে লেখকের সঙ্গে যৌথভাবে পেয়েছেন আন্তর্জাতিক ম্যান বুকার পুরস্কার। ভেজিটেরিয়ান-এর বুকার জেতার কারণ কী বলে আপনার মনে হয়?

ডেবোরা: এটি এক অসাধারণ উপন্যাস। এতে অস্তিত্বের সংকট, ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্নতাবোধ ও পারিবারিক সংঘাত এত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে যে উপন্যাসটি পেয়েছে দুর্দান্ত সাহিত্যকর্মের মর্যাদা। আমার বিবেচনায় এটি একটি মাস্টারপিস।

বিনয়: আপনার অনুবাদ নিশ্চয় পুরস্কারপ্রাপ্তিতে সহায়ক হয়েছে?

ডেবোরা: অনুবাদটি যথাসম্ভব সুচারুভাবে করার চেষ্টা করেছি আমি। বিচারকেরা নিশ্চয় উপন্যাসের বিষয়বস্তুর সঙ্গে এর ভাষাও দেখেছেন। দুটো মিলিয়েই এই পুরস্কার। লেখক ও অনুবাদক দুজনকে যৌথভাবে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এটুকু বলব, উপন্যাসটি অনুবাদ করতে পেরে এবং পুরস্কারপ্রাপ্তিতে কিছুটা অবদান রাখতে পেরে আমি ধন্য।

বিনয়: বেশ অল্প বয়সে আর্টস ফাউন্ডেশন অ্যাওয়ার্ড এবং আন্তর্জাতিক ম্যান বুকার পুরস্কার অর্জন করেছেন আপনি? কেমন লাগছে?

ডেবোরা: নিজেকে অবিশ্বাস্য রকমের ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। ক্যারিয়ারের শুরুতেই এ এক বিশাল প্রাপ্তি। অনুবাদে যাঁরা পথিকৃৎ হয়ে আমাকে পথ দেখিয়েছেন তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।

বিনয়: কোরিয়ান ভাষা শিখলেন কীভাবে? শেখার পেছনে কী ধরনের সাহিত্যিক প্রণোদনা ছিল?

ডেবোরা: আমি কোরিয়ান ভাষা শিখেছি মূলত অনুবাদক হওয়ার জন্যই। কোরিয়ান ভাষা শেখার পেছনে অবশ্যই সে ভাষার সাহিত্য পাঠের উদ্দেশ্য আমার মধ্যে কাজ করেছে। প্রথমে নিজে নিজে বই পড়ে ভাষাটি শিখেছি। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সে ভাষায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছি। আমি এখন যে অনুবাদের কাজ করছি, তার জন্য একটি ভালো রকম পূর্বপ্রস্তুতি ছিল বলতে পারেন।

বিনয়: হ্যান ক্যাঙের প্রতি আকৃষ্ট হলেন কীভাবে? অন্য কোনো কোরিয়ান লেখক নয় কেন?

ডেবোরা: আসলে দ্য ভেজিটেরিয়ানই আমার পড়া প্রথম কোরিয়ান উপন্যাস। আমার সৌভাগ্য যে একটি ভালো উপন্যাস আমার হাতে এসেছিল। এটি পড়ে এতই চমৎকৃত হয়েছি যে অনুবাদই করে ফেললাম। ক্যাঙের বইটি আমার হাতে আসার পর মনোযোগ দিয়ে পড়েছি, পরে অনুবাদ করেছি। এটা একধরনের কাকতালীয় ব্যাপারও বটে। কোরিয়ান সাহিত্যে হ্যান ক্যাঙ কিন্তু মূলধারার লেখক নন, বিশেষ করে তিনি যখন দ্য ভেজিটেরিয়ান লেখেন তখন তো ছিলেনই না। অন্য কোরিয়ান লেখকদের চেয়ে তিনি ভিন্ন, স্বভাব ও শৈলীতে। এই ভিন্নতাই তাঁকে বিশিষ্ট করে তুলেছে।

বিনয়: আপনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন...

ডেবোরা: কেমব্রিজে আমি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছি, এটা সত্য। তবে এই পড়াশোনা তেমনভাবে উপভোগ করিনি। পড়তে হয়েছে গাদা গাদা সিলেবাসবদ্ধ বই, সেগুলোর বেশির ভাগই পুরোনো আমলের। কিন্তু আমার আগ্রহ বরাবর বর্তমান সময়ের সাহিত্যে। শিক্ষকেরাও জানতেন আমার আগ্রহের কথা। কিন্তু তাঁরা সিলেবাসের বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারেন না। কেমব্রিজ একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান, এটি তার ঐতিহ্যে অটল। নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষ হিসেবে আমি এর পরিবেশের সঙ্গে ঠিক খাপ খাওয়াতে পারিনি। এখানকার পড়া শেষে স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে পড়েছি। সেখানে আমার দিনগুলো অবশ্য কেমব্রিজের মতো একঘেয়ে ছিল না। আধুনিক ভাষা ও সাহিত্য শেখার উৎকৃষ্ট জায়গা এটি। আমিও মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছি পড়াশোনায়, গবেষণায়।

বিনয়: টিল্টেড অ্যাক্সিস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠা করেছেন আপনি? এর কাজ কী?

ডেবোরা: এটি একটি প্রেস। এর কাজ বই প্রকাশ করা। বিশেষ করে এশিয়া অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষার বই অনুবাদ করে প্রকাশ করা, যাতে এগুলো বিশ্বে বৃহত্তর পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারে।

বিনয়: বাংলাদেশের কোনো বই কি ‘টিল্টেড অ্যাক্সিস’-এর তালিকায় যুক্ত হয়েছে?

ডেবোরা: না, এখন অব্দি বাংলাদেশের কোনো বই নিয়ে কাজ শুরু করিনি আমরা। তবে আমার বাংলাদেশের বই প্রকাশ করার ইচ্ছা আছে। আমার লিট ফেস্টে আসার অন্যতম উদ্দেশ্য এ ব্যাপারে অনুসন্ধান চালানো। আমি খুব উচ্ছসিত। দেখি কিছু হয় কি না।

বিনয়: আপনার মতে মৌলিক লেখালেখি ও অনুবাদকর্মের মধ্যে পার্থক্য কী?

ডেবোরা: আমার দৃষ্টিতে দুটোর মধ্যে একটি বড় পার্থক্য হলো, মৌলিক লেখালেখিতে ‘রাইটার্স ব্লক’ বা চিন্তাশূন্যতা তৈরি হয়, কিন্তু অনুবাদে কোনো রকম ‘রাইটার্স ব্লক’ নেই। একজন লেখক লিখতে লিখতে আটকে যেতে পারেন। কিন্তু একজন অনুবাদক বিরতিহীনভাবে কাজ চালিয়ে যেতে পারেন।

বিনয়: অনেকেই বলে থাকেন গুরুত্বের দিক থেকে অনুবাদ দ্বিতীয় কাতারের জিনিস। আপনার অভিমত কী?

ডেবোরা: কেউ কেউ এমনটি ভাবেন বটে, হয়তো এর মধ্যে যুক্তিও আছে। প্রথমে একটি জিনিস সৃষ্টি হবে, পরে তার ভাষান্তর হবে। দুটোর মূল্য দুই রকমের। প্রথমটি আসে লেখকের শিল্পচেতনা থেকে। আর দ্বিতীয়টি আসে বৃহত্তর পরিসরের চাহিদা থেকে। এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় অনূদিত না হলে পৃথিবীর অনেক মহৎ সাহিত্যের মূল্যায়নই হতো না। অনুবাদক হওয়া নিয়ে হীনন্মন্যতার কিছু নেই। মৌলিক সৃষ্টি অবশ্যই বড়, কিন্তু অনুবাদও কোনো অংশে কম নয়। অনুবাদক হামবড়া ভাব নিয়ে থাকবেন না, তাঁকে বিনয়ী হতে হবে। তিনি মৌলিক কিছু পাঠ করবেন এবং তার তারিফ করবেন। মৌলিক সৃষ্টির মধ্যে মহৎ কিছু আবিষ্কার করলে তবেই অনুবাদক অনুবাদে হাত দেবেন। সেদিক থেকে অনুবাদককে মানতেই হবে, লেখকের স্থান তাঁর ওপরে। অনুবাদ আসে দ্বিতীয় পর্যায়ে, কিন্তু এটি দ্বিতীয় শ্রেণির কাজ নয়। অনুবাদক লেখকের চেয়ে বড় নন, আবার ছোটও নন।

বিনয়: অনুবাদে ভাষা, বিষয় ও সংস্কৃতি—এসবের তুলনামূলক গুরুত্ব কী?

ডেবোরা: অনুবাদে ভাষা ও বিষয় তো থাকবেই। এগুলো প্রাথমিক উপাদান। এরপরেই গণ্য হবে সাংস্কৃতিক উপাদান। এটি সূক্ষ্ম ও গভীরতর বিষয়। সংস্কৃতির বিষয়টি বইভেদে পৃথক হয়। কোনো কোনো বই সংস্কৃতির দিক থেকে বেশ ভারী, কোনোটি আবার হালকা। বেশি ভারী হলে অনুবাদে অসুবিধা হয়। সাংস্কৃতিক উপাদান কম থাকলে তার অনুবাদ সহজ হয়। যেমন, দ্য ভেজিটেরিয়ান উপন্যাস সাংস্কৃতিক উপাদানে অতটা ভারী নয়। ফলে এর অনুবাদও সহজ হয়েছে।

বিনয়: এ পর্যন্ত আপনি কেবল কথাসাহিত্য অনুবাদ করেছেন। কখনো কি কবিতা অনুবাদের চিন্তা মাথায় এসেছে?

ডেবোরা: না, আমি উপন্যাসে যতটা আগ্রহ বোধ করি, কবিতায় ততটা নয়। আমার পাঠ্যতালিকায় প্রধানত কথাসাহিত্যই থাকে। তবে ইদানীং কিছু কিছু কবিতা পড়ি। কোরিয়ান ভাষায়। ভবিষ্যতে হয়তো এগুলো অনুবাদ করতে পারি।

বিনয়: অনুবাদের ক্ষেত্রে কী কৌশল অবলম্বন করেন আপনি—শব্দ, বাক্য নাকি অনুচ্ছেদ ধরে ধরে অগ্রসর হন?

ডেবোরা: আমি সচরাচর বাক্য ধরে ধরে অগ্রসর হই। পুরো অনুচ্ছেদ শেষ হলে আবার বাক্যগুলো দেখি। কোনো শব্দ অপ্রয়োজনীয় মনে হলে ফেলে দিই। আবার কোনো শব্দ হয়তো যোগ করি, ভাব ও বক্তব্যের প্রয়োজনে। একটি বইয়ের সব শব্দের গুরুত্ব সমান নয়। মূল বিষয়ের ক্ষতি না করে শব্দ যোজন-বিয়োজনে বাধা নেই। অনুবাদ একটি সৃজনশীল শিল্প। এ প্রক্রিয়ায় একটি নতুন টেক্সট তৈরি হয়। তবে তা যতটা মূলানুগ হয় তত ভালো।

বিনয়: অনুবাদ করার সময় আপনি কি মূল লেখকের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন বোধ করেন?

ডেবোরা: মাঝেমধ্যে এটি জরুরি হয়ে পড়ে। হ্যান ক্যাঙের বই অনুবাদ করার সময় তাঁর সঙ্গে আমি কথা বলেছি। চিঠি চালাচালি করেছি। অস্পষ্ট বিষয় পরিষ্কার করার জন্য এটি দরকার। অনুবাদ একটি কোলাবোরেটিভ প্রসেস, যাতে লেখক-অনুবাদক দুজনেরই ভূমিকা থাকে।

বিনয়: ব্রিটিশ জীবন ও দক্ষিণ কোরীয় জীবনের মধ্যে কোনো ধরনের পার্থক্য লক্ষ করেছেন?

ডেবোরা: প্রধান পার্থক্য হলো দক্ষিণ কোরিয়া মাল্টিকালচারাল সোসাইটি নয়। নৃতাত্ত্বিকভাবে সমজাতীয়। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য হলো মাল্টিকালচারাল। এখানে নানা জাতির লোকের বাস। আমি ব্রিটিশ জীবনযাপনে অভ্যস্ত। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়াতে থাকতে কোনো অসুবিধা হয়নি। তাদের খাবারদাবার চমৎকার। ব্যবহার চমৎকার। যখন দক্ষিণ কোরিয়ায় যাই, তখন সেখানে আমি একজন বিদেশি। বিদেশিদের সেখানে কোনো অমর্যাদা হয় না।

বিনয়: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

ডেবোরা: অনুবাদ চালিয়ে যাওয়া। আমার হাতে আটটি বই আছে। এর মধ্যে সাতটির কাজ শেষ হয়েছে। বি সুয়া নামে আরেক দক্ষিণ কোরিয়ান লেখকের দুটি বই আছে। হ্যান ক্যাঙেরও একটি বই আছে।

বিনয়: বাংলাদেশ আপনার কেমন লাগছে?

ডেবোরা: বাংলাদেশে আমার এই প্রথম আসা। খুব ভালো লাগছে। ঢাকা লিট ফেস্ট উপভোগ করছি। বিভিন্ন সেশনে কথা বলেছি, দর্শকসারিতে বসে অন্যদের কথা শুনেছি। জমজমাট আসর। বাইরে গিয়ে রিকশায় চড়েছি। বেশ মজা। সময়-সুযোগ পেলে আবারও বাংলাদেশে আসব।

বিনয়: বাংলাদেশি কোনো লেখকের লেখা পড়েছেন আপনি?

ডেবোরা: খুব বেশি নয়, কিঞ্চিৎ পড়েছি। অনুবাদে। তবে ভারতের বাঙালি লেখকদের লেখার সঙ্গে আমি বেশি পরিচিত।