আবহমান ও সমকালের রাখিবন্ধন

‘মেমরি অব দ্য হলি অর্টিজান ট্র্যাজেডি’, শিল্পী: সৈয়দ ইকবাল
‘মেমরি অব দ্য হলি অর্টিজান ট্র্যাজেডি’, শিল্পী: সৈয়দ ইকবাল

গ্যালারিতে পা রাখতেই চোখে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী শাহাবুদ্দিনের বৃহদাকৃতির ক্যানভাসে আঁকা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধার বলিষ্ঠ পেশির ক্ষিপ্রতা, গতি আর তেজোদীপ্ত মুষ্ঠিবদ্ধ হাত—ছবিটি যেন নতুনভাবে উদ্দীপ্ত করে আমাদের। এরপর খানিকটা এগোলেই দেখা যায় ‘পাললিক জীবন-১’। কালিদাস কর্মকারের আঁকা এ ছবির জমিনে শিল্পী সেঁটে দিয়েছেন বাঙালির প্রধান খাদ্য চাল। আবার গোটা চিত্রকর্মে বাংলা বর্ণ ‘অ’-এর পাশাপাশি পলিমাটির নরম ও রুক্ষ রূপের রং লেপন করে, গোলাকার ও চৌকো ক্ষেত্র বিভাজনের মাধ্যমে সাজিয়েছেন নিজস্ব অনুভূতির কম্পোজিশন। বাংলার মাটি ও বাঙালি—এই দুই বিষয়কে প্রতীকায়িত করেছেন তিনি।
কেবল শাহাবুদ্দিন বা কালিদাস নন, গ্যালারি কসমসে চলমান আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে বাংলাদেশি বরেণ্য শিল্পীদের অধিকাংশ শিল্পকর্মে পাওয়া যায় এই বঙ্গের মাটি-মানুষ-নিসর্গের রূপ-গন্ধ, বাঙালি চেতনার জয়গান। আছে সমসাময়িক নানা প্রসঙ্গও। এখানে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও কানাডার ২৮ জন শিল্পীর ৪০টি শিল্পকর্ম।
স্পেনপ্রবাসী মনিরুল ইসলামের ক্যানভাসজুড়ে আছে বর্ষা। ছবিতে তিনি দেখিয়েছেন বাংলার প্লাবিত ভূমির রূপ। পক্ষান্তরে সমুদ্র ও ভূমির সহাবস্থান রেখে জ্যামিতিক ফর্মে রঙের কম্পোজিশনে সাজিয়েছেন বীরেন সোম। মাকসুদা ইকবালের ছবিটি টেক্সচারবহুল। এখানে শিল্পী এমনভাবে রং লেপন করেছেন, যেন চিত্রপৃষ্ঠে আছড়ে পড়ে সবুজ বাংলার ধানখেত; কখনোবা এই ধানখেতকে সবুজ ঘাসযুক্ত মাঠও মনে হতে পারে।
বাস্তবানুগ ধারায় নদীদৃশ্য, সাজানো নৌকার বহর—এভাবেই আবহমান বাংলার নদী-নৌকার অপরূপ শোভা তুলে ধরেছেন অলকেশ ঘোষ।
জামাল আহমেদের ক্যানভাসে বাঙালি নারীর এবং কনকচাঁপা চাকমার ছবিতে আদিবাসী রমণীর একান্তে বসে থাকার দৃশ্যের মধ্যে যে স্নিগ্ধতা আছে, তাতে মন ছুঁয়ে যায় নিমেষেই। অন্যপক্ষে ‘শিরোনামহীন’ চিত্রে নাজিয়া আন্দালিব প্রীমা বর্ণিল রঙের বিভাজনে প্রস্ফুটিত করেন বসন্তের অপরূপ রূপের জয়গান।
বিশ্বজিৎ গোস্বামীর ক্যানভাসে সারিবদ্ধ চৌকো ফর্মের ভেতর প্রতিধ্বনিত হয় একটি শব্দ—‘মা’। বলা ভালো, এখানে অধিকাংশ বাংলাদেশি শিল্পীর কাজে বাংলার ভূমি, মাঠ, জল ও নিসর্গ উদ্ভাসিত হয়েছে তাঁদের নিজস্ব ঢঙে।
অন্যদিকে সমকালীন বিভিন্ন বিষয়কেও উপস্থাপন করেছেন কেউ কেউ। যেমন সৈয়দ ইকবাল হলি আর্টিজানের ট্র্যাজেডির স্মৃতির ভয়াবহতাকে উপস্থাপন করেছেন প্রতীকী অবয়বে—তাঁর ‘মেমরি অব দ্য হলি অর্টিজান ট্র্যাজেডি’ শীর্ষক কাজে। এখানে দৃশ্যমান হয়েছে রক্তচোষা মুখোশধারী। অন্যদিকে রফিকুন নবীর কাঠ খোদাই চিত্রে পাওয়া গেল উদ্ধারকাজে ঐক্যবদ্ধ কাকদের সমন্বিত শক্তির জয়গান। এই ছবিতে দেখা যায়, বাচ্চা কাকের আর্তচিত্কারে এগিয়ে এসেছে একদল কাক। গোটা চিত্রে কম্পোজিশনের মুনশিয়ানায় শিল্পী হয়তো আমাদের সমন্বিত শক্তির প্রতিই ইঙ্গিত দিয়েছেন।
নিসার হোসেনের ‘নরকের দিনপঞ্জিকা’ শীর্ষক চিত্রে আছে নানা তরঙ্গ। ছবিটির ভয়াল রক্তিম জমিনে যেমন অশুভ সংকেত দেখা যায়, একইভাবে সাদাকালো বিক্ষিপ্ত রেখার মধ্যে দেখতে পাই পশুর অবয়ব। সব মিলিয়ে নিসারের চিত্র যেন আমাদের দুঃসময়ের ভয়াবহতার প্রতিই ইঙ্গিত করে।
আফরোজা জামিলের ক্যানভাসে অ্যাসিডদগ্ধ নারীর বিকৃত মুখের মধ্যে যে আকুতি খেলা করে, দর্শককে সেটি স্পর্শ করে সহজেই। তবে আকাশচুম্বী শহরের পরিবেশদূষণের বিষয়টি যখন দেখতে পাই রোকেয়া সুলতানার চিত্রে, মনে হয়, সমকালীন সময়কে কতভাবেই না তুলে ধরেছেন শিল্পীরা! সমসাময়িক বিভিন্ন ঘটনানির্ভর এসব ছবি দর্শকের চেতনায় তোলে অভিঘাত।
প্রদর্শনীতে সমকালীন বাস্তবতা এবং অতীতের স্মৃতিবিজড়িত গ্রামবাংলা, নগর, মানুষের সুখ-দুঃখ, শুভ-অশুভের কাহিনি চিত্রণের পাশাপাশি বিদেশি শিল্পী—নেপালের কিরণ মানানদারের চওড়া তুলির আঁচড়ে হলুদ-সবুজ রং আর কালো রঙের রেখায় নারীর অভিব্যক্তি; ভারতের অভিজিৎ রায়ের চারকোলে আঁকা ক্ষিপ্র ষাঁড়ের রোষান্বিত ভঙ্গি ভাবিয়ে তুলবে দর্শকে। কানাডার আসমা মাহামুদের ‘স্মৃতি’ শিরোনামের রঙের কম্পোজিশন ও শাহাদ রাসামের ‘শিরোনামহীন’ চিত্রেও ভাবনার খোরাক পাবেন অনেকে। অন্যদিকে ক্যালিগ্রাফি, পুরোনো শহরের দৃশ্য, পাখি ও নারীর মুখাবয়ব—এসব অবলম্বন করে পাকিস্তানি চিত্রকরেরা যে চিত্র এঁকেছেন, তা-ও মনোহর।
প্রদর্শনীটি মূলত আবহমান ও সমকালের রাখিবন্ধন। ২৭ নভেম্বর শুরু হয়ে এটি শেষ হয়েছে ২৬ ডিসেম্বর।