'মূলত নিজের আনন্দের জন্য পড়ি-লিখি'

>
মনজুরে মাওলা। ছবি: খালেদ সরকার
মনজুরে মাওলা। ছবি: খালেদ সরকার

লেখালেখি, সম্পাদনা, গ্রন্থ পরিকল্পনা—নানা কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন মনজুরে মাওলা। ছিলেন সচিব, হয়েছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক। সেই সময় পরিকল্পনা করেছেন ‘ভাষা-শহীদ গ্রন্থমালা সিরিজ’। এরপর রবীন্দ্রনাথ বিষয়েও প্রকাশ করেছেন একই রকম সিরিজ গ্রন্থ। সম্প্রতি তিনি টি এস এলিয়টের ওপর গবেষণা শেষ করেছেন। তাঁর মুখোমুখি হয়েছেন পিয়াস মজিদ

পিয়াস মজিদ: আপনার প্রথম বই নিমগ্ন, কি করে পারো প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালে, যখন আপনার বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। গড় বাঙালি কবির চেয়ে একটু বেশি বয়সেই প্রথম বইয়ের প্রকাশ...

মনজুরে মাওলা: মোটামুটিভাবে ১৯৫৮ কি তারপর থেকে লিখছি। কখনো বই করার কথা ভাবিনি। কখনো মনেই হয়নি যা লিখছি তা বই করার মতো কিছু হয়েছে। দ্বিতীয়ত, জানতামই না কী করে বই প্রকাশ করতে হয়। সে সময় জ্যেষ্ঠ বন্ধু অধ্যাপক আবদুল হাফিজ (যিনি তখন মুক্তধারার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন) জোর করলেন আমার বই করার ব্যাপারে। তাঁর আগ্রহ ও উৎসাহেই নিমগ্ন, কি করে পারো প্রকাশিত হয়।

পিয়াস: প্রথম বইয়ের প্রথম কবিতার নাম ‘রবীন্দ্রনাথ’ আবার অন্য কবিতায় বজ্রসেন ও শ্যামার সংলাপেও পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আগ্রহ কি তাহলে প্রথম তারুণ্যেই?

মাওলা: আগ্রহ তো অবচেতনে ছিলই। ১৯৬১-তে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে আমরা বন্ধুরা—আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, কাজী মুশতাক হোসেন প্রমুখ তৎকালীন বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতেও চেষ্টা করেছি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কিছু একটা করতে। সে সময়েই ঢাকাস্থ ভারতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ঠিক করল রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত বিভিন্ন কবির কবিতার একটি সংকলন প্রকাশ করবে। আমাকেও বলা হলো কবিতা লিখতে। তিন-চারবার চেষ্টা করেও এক স্তবকের বেশি লিখতে পারিনি। পরে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি স্তবক মিলিয়ে দাঁড়িয়ে গেল ‘রবীন্দ্রনাথ’ কবিতাটি।

পিয়াস: সুচিত্রা সেনের জন্য নামে আপনার একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালে। নামটি চমকে দিয়েছিল অনেককেই...

মাওলা: এই বইয়ের দুটো দিক সম্পর্কে বলার আছে। প্রথমত, এ বইয়ে আমি সাধারণ অক্ষরবৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করেছি। দ্বিতীয়ত, সুচিত্রা সেনকে আমাদের বিগত যৌবনের অবিস্মরণীয় অভিনেত্রী হিসেবেই দেখিনি শুধু—তাঁর রুচি, বলার ভঙ্গি, হাসি—যা আমাদের উজ্জীবিত করেছিল, সেগুলো কবিতার অনুভবে ধরতে চেয়েছি।

মনজুরে মাওলার উদ্যোগ ও পরিকল্পনায় ‘ভাষা-শহীদ গ্রন্থমালা সিরিজ’-এর একটি বই এবং তাঁর সম্পাদনায় রবীন্দ্রনাথের জন্ম–সার্ধশতবর্ষে প্রকাশিত ১৫১টি বইয়ের একটি
মনজুরে মাওলার উদ্যোগ ও পরিকল্পনায় ‘ভাষা-শহীদ গ্রন্থমালা সিরিজ’-এর একটি বই এবং তাঁর সম্পাদনায় রবীন্দ্রনাথের জন্ম–সার্ধশতবর্ষে প্রকাশিত ১৫১টি বইয়ের একটি

পিয়াস: রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এত লিখেছেন!—রবীন্দ্রনাথ: কবিতায় ছবি, একটি কবিতা: এলিয়ট, রবীন্দ্রনাথ ও আরও দুইজন, অল্প একটু রবীন্দ্রনাথ, একজন কবি বিষয়ে, গ্রহণ করেছো যত, রবীন্দ্রনাথ: রোগশয্যায়, আমি কবি ইত্যাদি আপনার প্রবন্ধের বই। দুই খণ্ডে সম্পাদনা করেছেন রবীন্দ্রনাথের নির্বাচিত কবিতা। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এতসব লেখার সূত্রপাতের সূত্রটি বলবেন...

মাওলা: বলতে গেলে অনেকটা বাধ্য হয়েই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লিখতে শুরু করি। তোমার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আবদুল মান্নান সৈয়দের কথা খুব মনে পড়ে গেল। ও যখন চারিত্র নামের পত্রিকা সম্পাদনা করত তখন একদিন এসে বলল, মওলা ভাই, আপনাকে রবীন্দ্রনাথের ওপর লিখতে হবে। আমি বললাম, পাগল নাকি! আমি রবীন্দ্রনাথের কী জানি? মান্নান জোর করল, আপনাকে লিখতেই হবে। মূলত তার এই তাগাদাতেই রবীন্দ্রনাথের ওপর চারিত্র পত্রিকায় লিখলাম। প্রকাশের পর অনেকেই বলল, মন্দ হয়নি। যাই হোক, এই লেখার পর আরও লেখার ফরমাশ আসতে থাকে। আবুল হাসনাত তখন সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনা করত। প্রতি পঁচিশে বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণে লেখা চাইত। এই করে করে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে অনেক লেখা হয়ে গেল আমার।

পিয়াস: এই প্রশ্নের সূত্র ধরে বলি: রবীন্দ্রনাথ-নজরুল নিয়ে লিখতে গেলে আমাদের এখানে তাঁদের সমাজ-রাজনীতিক ভূমিকার কথা এতটা প্রবলভাবে আসে যে সাহিত্য-সমালোচনা সম্ভব হয় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ভক্তিবাদের প্রাবল্য। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য...

মাওলা: দেখো, আমি রবীন্দ্রনাথসহ সব কবি-লেখকরই নিজের মতো করে দেখি। তাঁদের কোনো বই পড়তে ইচ্ছা করলে এবং ভালো লাগলেই তবে পড়ি। ভালো না লাগলে বা ইচ্ছা না হলে তা সে যত ভালো বই-ই হোক, যত বিখ্যাতই হোক, পড়তে পারি না। আমি মূলত নিজের আনন্দের জন্য পড়ি-লিখি। ওই যে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে লিখতে অনুরুদ্ধ হলাম, তারপর তাঁর সৃষ্টি ভবনে-ভুবনে প্রবেশ করে যে আনন্দাভিজ্ঞতা অর্জন করলাম, তা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছি। রবীন্দ্রনাথকে আমি তাঁর সমাজ-রাজনীতিকসহ বহু পরিচয়েই অল্পস্বল্প জানি। এ-ও জানি যে তিনি শুধু কবি নন, আরও অনেক কিছু। তবে আমি তাঁকে কবি হিসেবেই দেখতে চেয়েছি, দেখতে চাওয়ার আনন্দে।

পিয়াস: যত দূর জানি, সম্প্রতি টি এস এলিয়টের ওপর গবেষণা সম্পন্ন করেছেন আপনি। সে সম্পর্কে জানতে চাই...

মাওলা: এটা অনেক দীর্ঘ গল্প। পরিস্থিতির অভিঘাতে আমাকে এলিয়টের মার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রাল বাংলায় অনুবাদ করতে হয়। চারপাশে অনেক হুল্লোড়ের মাঝে আমার নির্জন খাতা একদা ভরে উঠল এলিয়টের গির্জা, খুন, রক্তময় জগতে। তারপর এর ভূমিকা হিসেবে একটা দীর্ঘ লেখা দাঁড়িয়ে গেল। এলিয়টের এই অসাধারণ বইয়ের বিচিত্র বেশ কিছু সংস্করণ আমার আগ্রহ ও আলোচনার বিষয় ছিল। বন্ধুদের কারও কারও কাছে তা গবেষণাকর্ম বলে মনে হলো। কিন্তু আমার কাছে তা একান্তভাবেই ছিল আনন্দকর্ম।

পিয়াস: সুধীন্দ্রনাথ দত্তের একটি বই দশমীর কবিতাগুচ্ছ নিয়ে নষ্ট নীড় নামে গোটা একটি বই লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথের পর তিরিশের কবিদের মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ আপনাকে এতটা আকর্ষণ করল কী কারণে?

মাওলা: সুধীন দত্ত আমাকে আকর্ষণ করেন নানাভাবেই। তাঁর ‘সংবর্ত’ কবিতায় সে সময়ের রাজনৈতিক অবস্থা যেভাবে শিল্পিত-সুষমায় ফুটে উঠেছে, তা অবিস্মরণীয়। আজও তো পৃথিবীতে বহু আন্তর্জাতিক সংকট রয়েছে। সংকটের ছায়া কবিতার কায়ায় সফলভাবে ফুটিয়ে তোলার দৃষ্টান্ত সুধীন দত্তের মতো খুব একটা চোখে পড়ে না এখনো। তাঁর প্রতিটি শব্দ-বাক্য-পঙ্‌ক্তির ব্যবহার পরিমিত ও চিন্তাপ্রসূত। ঝট করে ভাবলাম আর লিখে ফেললাম এমনটি নয়। তাঁর কবিতায় শব্দেরা ব্যবহারিক অর্থের বাইরে গিয়ে ভিন্নমাত্রাও নির্দেশ করে। ‘যযাতি’ কবিতাটিও তীব্র সম্মোহক।

পিয়াস: আপনার অনেক পরিচয়ের পাশাপাশি গল্পের গোয়েন্দা, পড়তে চাই গোয়েন্দাগল্প—এই বইগুলোর লেখক হিসেবেও আপনি বিখ্যাত। গোয়েন্দা গল্পের ইতিহাস রচনার বিষয়টি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক, তাই না?

মাওলা: গোয়েন্দা গল্পের জগৎও আমার কাছে ভীষণ আকর্ষণীয়। গোয়েন্দা গল্প ভালো লাগে দুটো কারণে। এক. এতে যে রহস্য থাকে তা যৌক্তিকভাবে সমাধান করতে হয়। পাঁচজন লোকের মাঝে খুনটি কে করেছে তা বের করতে হয়। দুই. কোনো কোনো গোয়েন্দা গল্পে—যেমন শরদিন্দুর ব্যোমকেশ-এ সমকালীন সমাজ এত চমৎকারভাবে এসেছে যে বিস্ময় মানতে হয়। আর্থার কোনাল ডোয়েলের শার্লক হোমস চরিত্রকে টি এস এলিয়টের মতো আমারও মনে হয় একজন জ্যান্ত মানুষ, যে আমাদের আশপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে, রোমহর্ষক রহস্যের নিপুণ সমাধান করছে।

পিয়াস: ইবসেন নিয়েও কাজ করেছেন আপনি। বিশেষভাবে বলা যায়, ব্র্যান্ড নাটকের বাংলা পুনঃসৃষ্টির কথা...

মাওলা: নাটক নিয়ে আগ্রহ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনেই। তখন তো শেক্‌সপিয়ারসহ ইংরেজি নাটক পড়েছি, অন্যান্য ভাষার নাটকও পড়া হয়েছে। কামালউদ্দীন নীলুর আহ্বানে তাঁদের দল সিএটির জন্য ইবসেনের ব্র্যান্ড নাটকটি আবার নতুন করে পড়লাম। অনুবাদও করে ফেললাম। বলতে আনন্দ হয় যে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রধান মঞ্চ উদ্বোধনের পর প্রথম বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয় ব্র্যান্ড-এর মঞ্চায়ন দিয়ে। এ প্রসঙ্গে মজার একটি ঘটনাও মনে পড়ছে। একবার নীলুকে মফস্বলের কোনো সংগঠন প্রস্তাব দিল ইবসেনের একটি নাটক নিয়ে সেখানে যেতে। ওরা অন্য একটি নাটকের কথা বলেছিল কিন্তু সেই সংগঠনের লোকেরা জোর দিয়ে বলল, ‘আমরা ব্র্যান্ড-ই চাই’। আমি মজা করে বললাম, ‘হ্যাঁ, ব্র্যান্ডি যদি দাও তাহলে আগে আমাকেও কিছুটা দিয়ে যেও।’

পিয়াস: শ্রাবণ নামে একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্র সম্পাদনা করতেন এক সময়ে—১৯৮৬-৮৭ সালের দিকে। আপনার সম্পাদনায় আমরা নতুন কোনো সাহিত্যপত্র পাব কি?

 মাওলা: শ্রাবণ প্রকাশের সময়ে আমাদের নীতি ছিল আমরা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াব না, ব্যবসায়িকভাবে সফল হব। সফল হয়েছিলামও কিছুটা। পত্রিকার সব ব্যয় নির্বাহ করে লেখকদের সম্মানী দিয়েও সেই সময়ে আমরা অন্তত পাঁচ শ টাকা লাভ করতে পেরেছি। তারপরও পত্রিকাটি চালাতে পারিনি বেশি দিন। ইচ্ছা হয় আবার নতুন করে একটা কাগজ করি। কিন্তু সময় এতটাই পাল্টে গেছে যে এখন আমার পক্ষে তা করা খুব মুশকিল।

পিয়াস: সিরিজ কাজের প্রতি আপনার আগ্রহ অনেক দিনের। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক থাকাকালে সাহিত্য-সমাজ-বিজ্ঞান-রাজনীতি-অর্থনীতিসহ বিচিত্র বিষয়ে ‘ভাষা-শহীদ গ্রন্থমালা সিরিজ’-এ ১০১টি বই প্রকাশের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?

মাওলা: এই সিরিজ গ্রন্থমালা প্রকাশের বড় কৃতিত্ব দিতে হয় একাডেমির গবেষণা, সংকলন ও ফোকলোর বিভাগের তৎকালীন পরিচালক (বর্তমান মহাপরিচালক) শামসুজ্জামান খানকেই। আমার তৃপ্তির জায়গা এই যে এই সিরিজে এমন অনেকে আমাদের জন্য লিখেছেন, যাঁদের প্রথম বই ছিল ওইটি; এবং আরও ভালো লেগেছে যে এঁদের অনেকেই পরে লেখালেখিতে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। একাডেমি একটা সূত্র ধরিয়ে দিয়েছে মাত্র।

পিয়াস: রবীন্দ্র জন্ম–সার্ধশতবর্ষে ‘মূর্ধন্য’ নামে একটি প্রকাশনী থেকে আপনার পরিকল্পনা ও সম্পাদনায় ১৫১টি রবীন্দ্রবিষয়ক বই প্রকাশিত হলো। এত বড় একটি কাজ বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

মাওলা: এই কাজের জন্য কারও কাছে হাত পাতিনি। কারও কাছে কোনো বিষয়ে সাহায্য নিলে তার ইচ্ছেমতোই চলতে হয় অনেকটা। সবাইকে বলেছি, বইগুলো যেন সংগ্রহ করে। তবে এ কাজে স্বতঃপ্রণোদিত সহায়তায় যাঁরা এগিয়ে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে ফজলে হাসান আবেদ এবং ঢাকা ক্লাবের নাম উল্লেখ না করে পারছি না। একেবারেই শূন্য থেকে কাজটি শুরু করি। আমার ভাবনা ছিল এই কাজে প্রাজ্ঞ-প্রবীণ থেকে তরুণ রবীন্দ্রচিন্তকদের ভাবনাগুলোর সমন্বয় সাধন। ‘ভাষা-শহীদ গ্রন্থমালা’র মতো এই সিরিজেও এমন অনেকে লিখেছেন, যাঁদের প্রথম পূর্ণাঙ্গ রচনা হয়তো এই সিরিজের বই। ভালো-মন্দ যা-ই হোক, এত বড় একটি কাজ যে আমরা সম্পন্ন করতে পারলাম, এখন ভাবলে নিজের কাছে নিজেই বিস্ময় মানি।

পিয়াস: এসব কাজে নির্ধারিত সময়-পরিধি বাধা থাকে বলে তাড়াহুড়োর কথাও বলেন কেউ কেউ। আপনার অভিমত কী?

মাওলা: দ্রুত না হলে অনেক সময় নানা জটিলতায় এ ধরনের কাজ আর শেষ করা হয় না। শুধু লক্ষ্য রাখা দরকার যে কাজের উদ্দেশ্য যেন অক্ষুণ্ন থাকে।

পিয়াস: অমর একুশে গ্রন্থমেলা সমাগত। আশির দশকের মাঝামাঝি—১৯৮৪ সালে এই মেলার নতুন রূপদানে আপনার ভূমিকার কথা আমরা জানি। গ্রন্থমেলা সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন...

মাওলা: আগে ছিল ‘বাংলা একাডেমি বইমেলা’ পরে হলো ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। দুটোর মধ্যে পার্থক্য দুস্তর। বাংলা একাডেমি বইমেলা বলতে একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মেলাকে বোঝাত। আর যখন এটি অমর একুশে গ্রন্থমেলায় রূপান্তরিত হলো, তখন এতে মৌলিক একটি পরিবর্তন এল। একুশের আবেগকে ধারণ করে এটি হয়ে উঠল সবার প্রাণের মেলা।

পিয়াস: বাংলা কবিতার একটি সংকলন করার পরিকল্পনা শুনেছিলাম আপনার...

মাওলা: হ্যাঁ ছিল। আবু সয়ীদ আইয়ুব ও হীরেন্দ্রনাথ দত্তের যে আধুনিক বাংলা কবিতা তাতে হয়তো অনেক অপূর্ণতা আছে। এই সংকলনে আহসান হাবীব, আবুল হোসেন, ফররুখ আহমদ—এঁদের কবিতা নেই, না থাকার কোনো সংগত কারণই নেই। তবু এসব অপূর্ণতার মধ্যেও সংকলনটির ইতিবাচক দিক আছে। এর মধ্য দিয়ে তখনকার কবিতা সম্পর্কে একটি মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু চল্লিশের দশক থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের কবিতাসমুদ্রে যে বিপুল বৈচিত্র্যের জোয়ার এসেছে, তা ভালো কোনো সংকলন না থাকায় পাঠকের পক্ষে উদ্ধার করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে চিন্তা থেকে সংকলনটি করার কথা ভেবেছি।

পিয়াস: সমকালীন সাহিত্য—বিশেষত কবিতা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

মাওলা: কী অসাধারণ বৈচিত্র্য এসেছে আমাদের তরুণদের লেখায়, ভাবলে বিস্ময় জাগে! এখন তারা অনায়াসে কবিতায় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছে, ছন্দ ভেঙে দিচ্ছে, লোকগাথার ব্যবহার করছে। অনেক কবিতায় প্রথাগত অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না কিন্তু কবিতা হিসেবে তা উত্তীর্ণ। আবার অনেকে পুরোনো অব্যবহৃত শব্দকে নতুন ব্যঞ্জনায় ব্যবহার করছে। সব মিলিয়ে জীবনের নানা বৈচিত্র্য যেভাবে তরুণদের কবিতায়, সাহিত্যে ভাস্বর হয়ে উঠছে তা পড়ে পাঠক হিসেবে আমার আনন্দের কোনো শেষ নেই।