অনুভূতির জ্যামিতি

অনন্তের এই লীলাভূমে প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে রূপ, রস ও গন্ধ। স্থির থাকছে না মানুষের অনুভূতিও। এই যে মুখচ্ছবির অভিব্যক্তি কিংবা দেহভাষায় মূর্ত হয় আমাদের জীবন উপলব্ধ সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হতাশা-উচ্ছ্বাস। শিল্পীরা এই সব অনুভূতি ধরে রাখেন তাঁদের ক্যানভাসে। যেমন রণজিৎ দাস এই বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার অভিব্যক্তি পরিমাপ করতে চেয়েছেন তাঁর ক্যানভাসে, রং-তুলিতে। দীর্ঘ দিনের ছবি আঁকার চর্চায় নিজের ক্যানভাসে একটা ভাষা তৈরি করেছেন তিনি। এ ভাষা বর্ণনামূলক ও আখ্যাননির্ভর নয়, সেটি বরং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্ত বা সমাজের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক বিশেষ কোনো চেতনারই বহিঃপ্রকাশ। আদতে কথাটি বললাম রণজিতের ‘জার্নি অ্যান্ড ইমেজেস’ (ভ্রমণ ও প্রতিমূর্তিগুলো) শিরোনামের প্রদর্শনী দেখার সূত্রে। উত্তরার গ্যালারি কায়ায় এটি শুরু হয়েছে ১১ মার্চ।
রং-রেখা, টেক্সচার, জ্যামিতিক ফর্ম, বিভিন্ন প্রতীক ও বর্ণমালা ব্যবহার করে চিত্রজমিন তৈরি করেন রণজিৎ, যেখানে তৈরি হয় বিমূর্ত ও অর্ধবিমূর্ত আবহ। এর সঙ্গে মানুষের নানা অভিব্যক্তির মুখাবয়ব, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, কখনো-বা পূর্ণাঙ্গ ফিগার (শরীর) আঁকেন তিনি। ক্যানভাসে অঙ্কিত এসব উপাদান কারও কারও কাছে মনে হতে পারে কোলাজের মতো। তবে শুধু রণজিৎ নন, দেশের অনেক শিল্পীই বর্ণনামূলক ফিগার উপস্থাপন ছেড়ে কোলাজধর্মী খণ্ডিতাংশ ফিগার উপস্থাপনকে আধুনিকতার মানদণ্ডের একটা পরিমাপক হিসেবে উপস্থাপন করে আসছেন।
তাহলে এখানে রণজিতের কৃতিত্ব কোথায়? মুখাবয়ব রচনায় তাঁর দৃষ্টি যতটা অভিব্যক্তি সৃষ্টিতে মনোযোগী, বাস্তবধর্মী লাবণ্য তৈরিতে ততটা নয়। চওড়া ব্রাশে সাদা রঙের টান-টোনে মুখাবয়বগুলো মাটির প্রতিমার আদল মনে হয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে। তাঁর নিজের প্রতিকৃতির আদলও এসেছে বারবার।
চিত্রে ব্যবহৃত মানুষের শরীর, মুখাবয়ব, জ্যামিতিক গড়ন (ফর্ম), রেখার ধরন, টেক্সচারের পুনারবৃত্তি দেখে ছবিগুলো একই সিরিজচিত্রের মনে হতে পারে। কিন্তু বিষয়টি তেমন নয়; বরং ‘স্টিল লাইফ’ সিরিজচিত্রের চারটি ছবি ছাড়া সব ছবিরই শিরোনামই ভিন্ন ভিন্ন বিষয় ও অভিজ্ঞতার আলোকে আলাদাভাবে নির্দিষ্ট করতে চেয়েছেন শিল্পী। এ ছাড়া প্রদর্শনীতে রয়েছে ১১টি ড্রয়িং। এগুলোর বিষয়বস্তু, বক্তব্য ও অনুভূতিও ভিন্ন। ছবির ক্যানভাসে জ্যামিতিক ও শারীরিক ভাবভঙ্গির রসায়নে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, পারিপার্শ্বিক ও ব্যক্তি-অনুভূতির নানান বিষয় এবং অভিজ্ঞতার মুহূর্তগুলো মূর্ত করে তুলেছেন রণজিৎ। জীবন চলার নানা বাঁকে বাঁকে মানুষের মুখাবয়বে যে বিচিত্র অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে, সেটিই উঠে এসেছে ক্যানভাসে, প্রদর্শনীতে।
সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, ম্রিয়মাণ আশা, আমুদে মুহূর্ত, নতুন জীবনের আশা, নৈরাশ্য, একাকিত্ব, মানসিক ট্রমা, অন্তর্দৃষ্টি প্রভৃতি বিষয়কেন্দ্রিক অনুভূতির অভিব্যক্তি যখন পরিপূর্ণভাবে চিত্রজমিনে ফুটে ওঠে, মনে হয় জীবনের বহুমুখী বাস্তবতা যেন স্থির হয়ে আছে চোখের সামনে।
‘জাদুকরি চেতনা’, ‘নব জীবনের আশা’, ‘এক নারীর আত্মকথন’ প্রভৃতি বিষয় শিরোনামের চিত্রে দেখা যায় পূর্ণাঙ্গ নারী শরীরের উপস্থিতি। তবে এ শরীর পুরোপুরি বাস্তবধর্মী ব্যাকরণনির্ভর কৌশলে আঁকা নয়। সাদা রঙের আধিক্য মুখাবয়বে তৈরি হয়েছে একধরনের ঢং। ‘স্টিল লাইফ’ সিরিজচিত্রে ঝুড়িভর্তি আপেল, পটারি, শিল্প-উপকরণ প্রভৃতি জড় বস্তুর ছবি শিল্পী এঁকেছেন জ্যামিতিক ফর্ম ও চিহ্নের সহাবস্থান কম্পোজিশনে। আবার ড্রয়িং সিরিজের ৯টি কাজ কালি ও ২টি করেছেন চারকোলে। আর এসব কাজের বিষয়ে একদিকে অনেকটা অলংকরণধর্মী উপস্থাপনায় ধরা আছে নারী ফিগারের প্রাধান্য, অন্যদিকে রয়েছে দৈনন্দিন ঘটনাসৃষ্ট অনুভূতির বিশেষ মুহূর্তগুলো।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ছবি দেখে যথার্থ আনন্দ লাভ করবে কে—দিব্য চোখ না শিল্পবিষয়ে শিক্ষিত চোখ? নাকি দর্শকমাত্রই কবিতা, গল্প, উপন্যাসের অলংকরণে ব্যবহৃত মূর্ত-বিমূর্ত শরীরের খণ্ডিতাংশের উপস্থাপন ও জ্যামিতিক অলংকরণের প্রচলিত ধারার সঙ্গে খানিকটা মিলিয়ে দেখবেন প্রদর্শনীর ছবিগুলোকে? প্রশ্নের সমাধান হয়তো দর্শকভেদে ভিন্নই হবে। প্রদর্শনী চলবে ২৫ মার্চ পর্যন্ত।