শহর-চিন্তনের ছাপ

‘জটিলতা’, িশল্পী: আনিসুজ্জামান
‘জটিলতা’, িশল্পী: আনিসুজ্জামান

বাংলাদেশের ছাপচিত্র নিয়ে আমরা যখন কথা বলি, স্বাভাবিক নিয়মেই চলে আসে নানা কালপর্ব। একেকটি অধ্যায় গড়ে ওঠে একেকজনকে ঘিরে। বয়সের বিবেচনায় নবীন হলেও আমাদের ছাপচিত্রে আনিসুজ্জামানের অবদান উল্লেখযোগ্য। কাঠখোদায় বা উডকাট মাধ্যমে তিনি যে ‘টেকনিক’ ব্যবহার করেন, সেটি তিনি পেয়েছেন তাঁর জাপানি অধ্যাপক ফুমিয়াকি ফুকিতার কাছ থেকে। আমরা যখন ফুকিতার কাজ দেখি এবং তাঁর টেকনিক অবলোকনের পর আবার ফিরে আসি আনিসের কাছে, আমাদের মনে হয়, অন্তত টেকনিকের মুনশিয়ানায় আনিস হয়তো ফুকিতাকে অতিক্রম করে গেছেন। আর এর ফলাফল হিসেবে আমরা আরও দেখি যে বর্তমানে ছাপচিত্রের যেসব নবীন কাঠখোদায় ব্যবহার করেন, তাঁদের একটা বড় অংশ অনুসরণ করেন আনিসের করণকৌশল। তবে টেকনিকের মুনশিয়ানা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমরা যে আলোচনা থেকে দূরে থাকি, তা হলো আনিসের চিত্রভাষা ও চিন্তাজগৎ প্রসঙ্গ।

আনিসুজ্জামান কেন আমাদের কাছে আলোচিত, শুধুই কি তাঁর করণকৌশলের জন্য? অবশ্যই না, বরং এই চিত্রকরের ভাষাও একটি ভিন্ন অবস্থান তৈরি করেছে চিত্রশিল্পে। সে কারণে তিনি যখন জলরং করেন, তখন আমাদের দৃষ্টি হোঁচট খায়। চেনা বস্তুর রংগুলো তৈরি করে আলাদা আমেজ। সেই আমেজও বুঝি চেনা পৃথিবীর বাইরের কোনো বস্তু, যাকে ছোঁয়া যাবে না, ধরা যাবে না, চোখের পলক পড়লেই যেন মিলি ইতি ঘটবে স্বপ্নের। কিন্তু এই জলরংগুলো কি তাঁর চিন্তাকে ধারণ করে? অনেকে বলবেন, ‘না’। আবার আমার মতো কেউ কেউ বলবেন, ‘হ্যাঁ’। কীভাবে হ্যাঁ, সেই সমীরণে একটু পরে আসছি।

আগে ছাপাই মাধ্যমে আনিসুজ্জামানের চলমান প্রদর্শনী ‘শহুরে নির্মাণের গল্পগাথা’ সম্পর্কে কিছু কথা বলে নিই।

শহরজুড়ে চলছে হাতুড়ির শব্দ। যানজটে আটকে থাকা যানবাহন। স্থবির চারপাশ। এর ভেতরে উলম্বভাবে স্থাপনার নির্মাণ চলছে, গাঁথুনি চলেছে আকাশপানে। মাঝে মাঝে তারা থমকে যায় চারকোণা বৃত্তের আবর্তে। কিন্তু এর মধ্যে আছে মানুষের যাপিত জীবন, ভালোবাসার ঘর, হিংসা, লোভসহ কত কিছু, নানা ঘটনা। আনিসের ছবিতে দেখা যায়, এই ঘটনাগুলো কখনো জট পাকানো চুলের মতো জড়িয়ে আছে শহরের বিদ্যুতের খুঁটিতে, কখনো-বা সারি সারি ঝুলে থাকা কাপড়ের নড়াচড়ায় গল্প হয়ে তারা কথা বলে আমাদের সঙ্গে।

আনিস তাঁর ছাপাই মাধ্যেমে নগরকে তুলে ধরেন আমাদের সামনে। নগর অসহ্য, দুর্বিষহ; তবে কোনো এক আকর্ষণ যেন আমাদের বারবার টেনে নিয়ে আসে নগরে। ঠিক এই ব্যাপারটি আমরা লক্ষ করি আনিসের কাজে।

আনিস আঁকছেন আমাদের বিরক্তি উদ্রেককারী উপাদান আর আমরা বিমোহিত হয়ে দেখছি সেগুলো; মন্ত্রমুগ্ধের মতো বুঁদ হয়ে আছি তাতে। এমন কী ঘটেছে তাঁর কাজগুলোয়, যা আমাদের বিমোহিত করে আর আদর-যত্নে এগুলোকে ঘরে রাখি আমরা—এটি অবশ্যই আলোচ্য শিল্পীর ভাষার দক্ষতা। ছবি থেকে তিনি হয়তো খুব সুচিন্তিতভাবেই বাদ দিয়েছেন ধ্বনি ও কোলাহল। আমরা আনিসের ছবি দেখি। চলমান গতিপথ স্থবির হয়ে যাওয়াকে আনিস যখন জড়িয়ে যাওয়া তারের প্রতীকে প্রতীকায়িত করেন, বুঝতে পারি, কী মুনশিয়ানায় শিল্পী এড়িয়ে গেছেন ঘাম, ট্রাফিক জ্যাম আর কান ফাটানো হর্নের আর্তনাদ।

শুরুতে বলেছিলাম, আনিসুজ্জামানের জলরং ও কাঠখোদায় একসুরে গাঁথা। কারণ, এরা আমাদের চিরচেনা হয়েও অনেক দূরের। সেই বিবেচনায় এরা একধরনের বিমূর্ত স্বপ্ন রচনা করে।

চিত্রশিল্পী পিয়েত মন্দ্রিয়ানের কাজে, উলম্ব গঠনের মধ্যে পাওয়া যায় বিমূর্ত আধ্যাত্মিকতা—স্পেস (জমিন) ও ভয়েডের (ফাঁকা স্থান) মধ্যে এক ধরনের সুরের খেলা পাওয়া যায়। তারই প্রতিধ্বনি আছে আনিসের মূর্ত কাজগুলোতে। ফলে আনিসুজ্জামানের ছবি দেখার পর আমাদের চিন্তায় ভেসে ওঠে নতুন এক নগর, সে নগর আকর্ষণ করে আমাদের। ১২ নর্থ অ্যাভিনিউ গুলশানস্থ ‘ইডজ গ্যালারি’তে ৭০টি নানা মাধ্যমের শিল্পকর্ম নিয়ে ২১ মে শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি চলবে ২৩ জুন পর্যন্ত।