ব্রিটেনের রহস্যপোন্যাসের রানি

ড্যাফনি দ্যু মারিয়েই
ড্যাফনি দ্যু মারিয়েই
বিশ শতকের জনপ্রিয় ব্রিটিশ নারী লেখক ড্যাফনি দ্যু মারিয়েই। খ্যাতনামা পরিচালক আলফ্রেড হিচকক রেবেকা নামে যে বিখ্যাত সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন, সেটি ড্যাফনির উপন্যাস অবলম্বনে। তাঁর ছোটগল্প ‘দ্য বার্ডস’-এরও চলচ্চিত্রায়ণ করেন হিচকক। রুল ব্রিটানিয়া উপন্যাসের মাধ্যমে এই লেখকই ১৯৭২ সালে প্রথম দিয়েছিলেন ব্রেক্সিটের আভাস। খুব সম্প্রতি তাঁর আরেকটি উপন্যাস মাই কাজিন র‍্যাচেল অবলম্বনে রজার মিচেল বানিয়েছেন সিনেমা। এসব মিলিয়ে গেল ১৩ জুন ড্যাফনি দ্যু মারিয়েইর ওপর বিবিসি প্রকাশ করেছে লুসি শোলের একটি নিবন্ধ। অনুবাদ করেছেন তানভীর আহসান

রজার মিচেলের নতুন সিনেমা মাই কাজিন র‍্যাচেল। এখানে নাম ভূমিকায় র‍্যাচেল ওয়েইজ অভিনয় করেছেন এবং স্যাম ক্ল্যাফিন অভিনয় করেছেন ফিলিপ নামের এমন এক যুবকের ভূমিকায়, যে এই নারীর মনোলোভা আকর্ষণ আর তার অশুভ দুষ্কর্ম নিয়ে সন্দেহের দোটানায় ছিন্নভিন্ন হতে থাকে। প্রশংসনীয়ভাবেই ড্যাফনি দ্যু মারিয়েই ১৯৫১ সালের একই শিরোনামের (মাই কাজিন র‍্যাচেল) উপন্যাসের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন। তারপরও এমনকি অসাধারণ অভিনয়, দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফি এবং ঐতিহাসিক নির্ভুলতা সত্ত্বেও, আমি একরকম হতাশই হয়েছি বলতে হবে।

মূল রচনার ভয়াবহতাই এখানে অনুপস্থিত। আর শব্দটি আমি বেশ সচেতনভাবেই ব্যবহার করছি। ‘দ্য মিনেস’ নামের তাঁর ছোটগল্পেই ড্যাফনি দ্যু মারিয়েই ব্যাখ্যা করছেন, ‘চলচ্চিত্রের ভাষায়, এবং বিশেষত নারীদের মধ্যে, “ভয়ংকর” অর্থ একজন হার্টথ্রব, একজন প্রেয়সী, একজন যার কাঁধ প্রশস্ত এবং নিতম্বনিহারী।’ এটা এমন এক শব্দ, যা তার যৌন আবেদনের দিকেই নিয়ে যাবে। দ্যু মারিয়েইর জীবনীকার মার্গারেট ফস্টার ‘ভয়ংকর হওয়াকে’ ব্যাখ্যা করছেন ‘অপর কোনো ব্যক্তির কাছে আকর্ষণীয়’ হয়ে ওঠাকে। বিপদ আর ঝুঁকির রঙে মাখামাখি হয়ে থাকা এই যৌন আবেদন র‍্যাচেলের প্রতি ফিলিপের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। আলামত বলছে, র‍্যাচেল তার স্বামী, ফিলিপের প্রিয় চাচা, অ্যামব্রোসকে খুন করেছে। ফিলিপের সন্দেহ কি সংগত? র‍্যাচেল কি দোষী না নির্দোষ? ফিলিপের মতোই পাঠকও কখনোই পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারে না।

ভয়ংকরের অনুভূতি আবাহনে দ্যু মারিয়েই সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁর প্রতিটি ভয়াবহ এবং হিমশীতল ছোটগল্পেই অন্ধকার ঘনিয়ে আছে। আর তাঁর প্রতিটি উপন্যাসেই জড়িয়ে-পেঁচিয়ে আছে অন্ধকার। তারপরও বেশির ভাগ সময়ই তাঁকে একজন চটুল ঐতিহাসিক রোমান্স ঔপন্যাসিক বলেই ধরে নেওয়া হয়। মাই কাজিন র‍্যাচেলকে আচ্ছন্ন করে রাখা ভীতি ধরতে মিচেলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, এবং স্বভাবত নাটকীয়তার বাঁক অতিক্রমণে তাঁর ব্যর্থতাই—দ্যু মারিয়েইর লেখনী সম্পর্কিত ব্যাপক ভ্রান্তিকে পাঠকের সামনে তুলে আনে। চলচ্চিত্র সমালোচক ডেভিড টমসন যেমন স্বীকার করে নিচ্ছেন, ‘রোমান্সের বিষয়টি প্রায়শই অনেকখানি ভয়াবহতার দিকে মোড় নেয়।’—যদিও শেষের বিষয়টিকে প্রায়-ক্ষেত্রেই এড়িয়ে যাওয়া হয়।

একজন অসাধারণ লেখিকা, দ্যু মারিয়েইর লেখালেখি ১৯৩০ থেকে ১৯৮৯ সাল—৮১ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত সচল ছিল। সব মিলিয়ে ১৬টি উপন্যাস লিখেছেন তিনি। এবং আরও লিখেছেন ছোটগল্প, নাটক, জীবনী, আত্মকথা, এবং তাঁর প্রিয় স্থান ‘কর্নওয়াল’ নিয়ে একটি বই, যেখানে তিনি দীর্ঘ সময় বাস করেছেন এবং যে স্থানটির প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছে তাঁর অনেক বইয়ের কাহিনি।

রজার মিচেলের চলচ্চিত্র মাই কাজিন র‍্যাচেলের দৃশ্য। ছবিগুলো পাওয়া গেছে বিবিসির সৌজন্যে
রজার মিচেলের চলচ্চিত্র মাই কাজিন র‍্যাচেলের দৃশ্য। ছবিগুলো পাওয়া গেছে বিবিসির সৌজন্যে

দুঃখজনক ব্যাপার হলো, তাঁর বেশির ভাগ কাজই অবমূল্যায়িত হয়েছে। অনেকের কাছেই তিনি রেবেকা নামের অস্বস্তিকর মনস্তাত্ত্বিক রোমাঞ্চোপন্যাসের লেখক হিসেবে পরিচিত, যে উপন্যাসে একজন অনামা নারী বর্ণনা করে কীভাবে সে তার চেয়ে বয়স্ক, সম্পদশালী ম্যাক্সিম দ্যু উইন্টারের সঙ্গে বিয়ের পরে তার স্বামীর পূর্বতন সুন্দরী এবং মৃত স্ত্রীর দম–বন্ধ-করা ছায়ার আড়ালে নিজের বেঁচে থাকাকে দেখতে পায়।

দ্যু মারিয়েইরের ঐতিহাসিক রোমান্স উপন্যাস ফ্রেঞ্চম্যান’স ক্রিক এবং জ্যামেইকা ইনও একই সুরে বাঁধা—সমুদ্রে জলদস্যুদের অভিযানের এবং কর্নিস মুরে চোরাচালানির বর্ণিল কাহিনি আছে এতে। কিন্তু আমার সন্দেহ আছে, কতজন জানেন যে দ্যু মারিয়েইর বিজ্ঞান কল্পকাহিনিতেও হাত ছুঁইয়েছেন?

বিজ্ঞানীদের অদ্ভুতূড়ে ‘জৈব-পদার্থবিদ্যা’ গবেষণার ফলে সময় পরিভ্রমণ তাঁর ১৯৬৯ সালের উপন্যাস দ্য হাউস অন দ্য স্ট্র্যান্ড–এর কেন্দ্রে রয়েছে; মেডিকেল পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভয়াবহতা তাঁর ছোটগল্প ‘দ্য ব্লু লেন্স’ এবং ‘দ্য ব্রেকথ্রু’–তেও প্রতীয়মান। প্রথমটিতে এক নারী তার চোখের সার্জারির পরে আবিষ্কার করে যে সব মানুষের কাঁধে একটা করে জন্তুর মাথা দেখছে সে। অন্যটিতে দেখা যায় এক মৃত্যুপথযাত্রী বালকের আত্মাকে বেঁধে রাখার চেষ্টা চলছে।

এমনকি ‘দ্য মিনেস’ এ-ও ‘দ্য ফিলিস’ নামের নতুন ধরনের সিনেমা অভিজ্ঞতার ফিউচারিস্টিক প্রযুক্তির উপস্থিতি দেখতে পাই, যেখানে অভিনেতাদের যৌন আবেদনকে সরাসরি প্রবিষ্ট করা হয় দর্শকের ভেতরে। একই রকম একটি ধারণা আমরা আলদ্যুস হাক্সলের ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ডেও পাই।

আলফ্রেড হিচকক পরিচালিত রেবেকা চলচ্চিত্রের দৃশ্য
আলফ্রেড হিচকক পরিচালিত রেবেকা চলচ্চিত্রের দৃশ্য

সম্ভবত আরও কম জানা একটি সত্য হচ্ছে,১৯৭২ সালেই দ্যু মারিয়েই একটি ভবিষ্যদর্শী কাল্পনিক উপন্যাস (রুল ব্রিটানিয়া) লেখেন, যেখানে একরকমভাবে ব্রেক্সিটের পূর্বানুমান রয়েছে। রুল ব্রিটানিয়ায় এমন এক যুক্তরাজ্যকে দেখানো হয়েছে যে প্রথমে কমন মার্কেটের (ইউরোপীয় ইউনিয়নের পূর্বসূরি, যার সঙ্গে ব্রিটেন আদতেই পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯৭৩ সালেই যুক্ত হয়) সঙ্গে যুক্ত হয় এবং পরবর্তীকালে এক গণভোটের মাধ্যমে যাকে পরিত্যাগ করে। ফলে নৈরাজ্য, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ বেকারত্ব জেঁকে বসে। আর এসবের পরিণতিতে সামাজিক অসন্তোষ ও ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের যুগপৎ প্রভাবে দেশজুড়ে ঘোষণা করা হয় জরুরি অবস্থা। সাততাড়াতাড়ি যুক্তরাষ্ট্র, ‘বন্ধুসুলভ’ আগ্রাসনে কর্নওয়ালের সৈকতে মেরিন সৈন্যদের নামাতে থাকে এবং ইউএসইউকে নামে এক নতুন পরাশক্তির সৃষ্টি করা হয়। কর্নিশ জনতা অবশ্য এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

দ্যু মারিয়েইর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ খুব সম্ভবত তাঁর দুটি ছোটগল্প। বেশির ভাগ মানুষই এই দুই গল্পের চলচ্চিত্র রূপ সম্পর্কেই বেশি পরিচিত। প্রথমটি হচ্ছে আলফ্রেড হিচককের ‘আইকনিক’ দ্য বার্ডস, যেখানে পাখির ঝাঁক উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার অধিবাসীদের ওপর ভীতিকর আগ্রাসন চালায়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে নিকোলাস রোয়েগের কাল্ট হরর চলচ্চিত্র ডোন্ট লুক নাও। এটি ভেনিসের প্রেক্ষাপটে কন্যার মৃত্যুকে উপজীব্য করে এবং শোকাহত এক দম্পতিকে নিয়ে এক শিরশিরে, অতিপ্রাকৃত কাহিনি; যার শীর্ষ ভূমিকায় অভিনয় করেছেন জুলি ক্রিস্টি ও ডোনাল্ড সাদারল্যান্ড। উল্লেখ্য, ছবিটি এবং যেটি অংশত এর অস্বস্তিকরভাবে বিস্তারিত যৌন দৃশ্যের জন্য খ্যাত।

যদি তাঁর কাজ সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকে, তাহলে এই দুটি হিমশীতল কাহিনি এবং যে ঐতিহাসিক রোমাঞ্চের জন্য তিনি যতটা বিখ্যাত—এ দুটির মধ্যে যোগসূত্রটি হারিয়ে ফেলা খুবই সহজ। যা নিয়ে নিজেও আক্ষেপ করেছন দ্যু মারিয়েই: ‘আমার উপন্যাসগুলোকে জনপ্রিয় বলা হয় আর সেগুলো বেশ বিক্রিও হয়, কিন্তু আমি ঠিক সমালোচকদের প্রিয় নই, আদতে আমাকে বেস্টসেলার হিসেবে বাতিল করে দেওয়া হয় এবং মোটেই আলোচনার চেষ্টাটিও করা হয় না।’

১৯৩৮ সালে প্রকাশের পর রেবেকা বেস্টসেলার ছিল কিন্তু টাইমস লিটারারি রিভিউয়ের এক সমালোচক এটিকে, ‘নিম্নমানের গল্পের মধ্যম মানের সমাপ্তি’ এবং রোমান্টিক ‘মাদক’ বলে তির্যক মন্তব্য করেছিলেন। সিকি শতাব্দী পরে, সেই একই পত্রিকায় একটি নিবন্ধে স্বীকার করে নেওয়া হয়, ‘ব্যাপক জনপ্রিয়তার’ সঙ্গে সঙ্গে দ্যু মারিয়েইরের কথাসাহিত্য ‘অসাধারণ সাহিত্যমানসম্পন্নও’ বটে; তার ‘অশুভ নায়ক/নায়িকারা’—এইসব ‘ভয়ংকরেরা’—ইংরেজি সাহিত্যের সেই সমৃদ্ধ ধারাকেই বহন করে চলেছে; যেটিকে জন মিলটনের সেই স্যাটান চরিত্রে পাওয়া যায়। রেবেকা ‘দেশজুড়ে সবচেয়ে প্রিয় উপন্যাসের’ তালিকা তৈরির জন্য ২০০৩ সালে অনুষ্ঠিত বিবিসি বিগ রিড পোলে ১৪তম স্থান পেয়েছে।

দ্য বার্ডস চলচ্চিত্রের দৃশ্য
দ্য বার্ডস চলচ্চিত্রের দৃশ্য

১৯৬২-তে টিএলএস (টাইমস লিটারারি সাপ্লিমেন্ট)-এ পুনর্মূল্যায়িত হওয়ার বছরেই স্পেক্টেটরের একটি নিবন্ধ, আমার মতে প্রথমবারের মতো শার্লোট ব্রন্টির মাস্টারপিস এবং দ্যু মারিয়েইরের নিজেরটির ভেতরের সম্পর্ককে তৈরি করে, যেখানে রেবেকাকে ‘জেন আয়ারের একটি কর্নিও গথিক পুনর্গঠন’ বলে মূল্যায়ন করা হয়েছে। এই তুলনামূলক মূল্যায়নের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে রেবেকা শেষ পর্যন্ত সাহিত্য আসরে স্থান করে নিল, এভাবেই একসময়ের ‘ভালোবাসা ও রোমাঞ্চের বিশ্ব-জননন্দিত বেস্টসেলার’ বলে অবমূল্যায়িত উপন্যাস বিশ শতকের নারীবাদী গথিক টেক্সটে রূপান্তর লাভ করে: ব্রন্টির চিলেকোঠার পাগল নারী রেবেকার অশরীরী উপস্থিতিতে বদলে যায়, প্রত্যেক নারীই এক একজন ছোট্ট নোংরা গোপনীয়তা, যাকে কোনো না কোনোভাবে তার স্বামীর সামলাতে হয়।

গথিকের ওপর যৌনতার প্রলেপে তাঁর সিদ্ধতা থেকে সহজেই ধারণা করা যায় কেন হিচকক দ্যু মারিয়েইর কাজের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। দ্য বার্ড–এর সঙ্গে সঙ্গে তিনি জ্যামেইকা ইন (১৯৩৯) এবং রেবেকার (১৯৪০) চলচ্চিত্রায়ণ পরিচালনা করেছেন। আপাতভাবে যদিও তিনি হিচককের রেবেকাকে পছন্দ করেছিলেন, ফরস্টারের মতে তিনি দ্য বার্ডসকে ভীষণ অপছন্দ করেছিলেন এবং বুঝে উঠতে পারেননি, কেন হিচকক তাঁর গল্পটিকে এতটা বিকৃত করেছিলেন। যখন ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো হিচককের কাছে জানতে চান যে মূল গল্পটি তিনি কতবার পড়েছেন, হিচকক স্বীকার করে নেন সেটা মাত্র একবারই। ‘আমার যদি মূল চিন্তাটি পছন্দ হয়, তাহলে আমি বইটিকে ভুলে যাই আর সিনেমা বানাতে শুরু করি’।—ব্যাখ্যা করেছিলেন তিনি। দ্যু মারিয়েই বরং রোয়েগের ডোন্ট লুক নাও–কে অনেক বেশি পছন্দ করেন, এবং পরিচালককে চিঠিতে লেখেন যে তিনি ‘চমৎকারভাবে সফল’, এবং আদতে ‘অবচেতন চিন্তায় আরও কিছু যোগ করার’ জন্য লেখিকা তাঁর প্রশংসা করেন, ‘যেগুলো তাঁর নিজেরও হতে পারত!’ আসলে এই অবচেতনেই দ্যু মারিয়েইরের ভয় মূল বিস্তার করে। টমসন যেমন তাঁর প্রতিভার উৎস সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন, তিনি ‘খুব সাধারণ অস্বস্তিকে নিতে পারতেন এবং সেখান থেকেই গড়ে দিতে পারতেন ভীতি।’