কান পাতো, কবিতার স্বর শোনার জন্য

‘কার জন্যে এই কবিতাগুচ্ছ?

...যে তোমার স্পর্শে ফোটে

আমার কত ভোরের শেফালি

...এর উপমারা হতে পারত তোমার একার

তোমার চুলের বিনুনি হতে পারত তারা’

শেষ পর্যন্ত চুলের বিনুনি হতে পেরেছে কি না, কে জানে! কিন্তু এই কবিতা হতে পারে প্রেমিকাকে দেওয়া এক প্রেমিকের অঞ্জলি। শুরুর এই কবিতাটির মতো বেশির ভাগ কবিতাই হৃদয়বিশ্লেষী, প্রেমের, অথবা প্রেমানুসন্ধানের।

সতেরোটি দীর্ঘ-নাতিদীর্ঘ কবিতা নিয়ে আলী রীয়াজের আমি নেই, আমার না থাকা আছে কাব্যগ্রন্থের নামটিতে চমৎকার একটি প্যারাডক্স আছে। সক্রেটিসের বিখ্যাত উক্তি ‘আমি জানি যে, আমি কিছুই জানি না’র মতো এই বাক্যটিও বিভ্রান্তিময়। আর এই বিভ্রান্তিময়তা কবিতার সেই সত্যের কাছে পৌঁছে দেয়, যা বলে, কবিতার সত্য আসলে এই যে কবিতায় কিছুই মিথ্যে নয়। কারও না থাকাও এখানে সাবলীলভাবে থাকতে পারে। আবার কারও উপস্থিতিও হয়তো অস্বীকার করা যেতে পারে অবলীলায়।

‘পাখি হব/ আর জন্মে পাখি হব/ পাখিরাই করতলে খুঁজে পায় খুঁদকুড়ো/ পার্কের নিঃসঙ্গ বেঞ্চে তোমার স্পর্শ/ মমতার সবটুকু তাঁদের দিয়েছ তুমি’; ‘কী আনবে আমার জন্যে?/...গাঢ় অন্ধকার এনো, গাঢ় অন্ধকার।’—এমন অনেক পঙ্‌ক্তি, অনেক স্তবক পাওয়া যাবে প্রেমের। ছোট্ট একটি প্রেমের কবিতা পড়ে প্রেমের প্রসঙ্গ থেকে সরে যাই—Ñ

কবি সে, লিখতে চেয়েছে ‘আমি ভালোবাসি তোমাকে’

ল্যাপটপে ভেসে ওঠে, ‘ভালোবাসি তমাকে’

তবে কি ধাতব যন্ত্র জানে কৈশোরের স্মৃতি?

প্রাণহীন যন্ত্র বোঝে হৃদয়ের ভাষা?

‘ধাতব যন্ত্র জানে?’ শিরোনামের এই কবিতাটিই বলে দেবে প্রেমের কবিতায় আলী রীয়াজের কবজি ও হৃদয় কতটা শক্তিশালী, নিবেদিত; কতটা অন্বেষী তাঁর চোখ প্রেমের গাঢ় অন্ধকারে! অথচ শুধু প্রেমে তরল হয়ে গাঢ় অন্ধকারের সঙ্গে মিশে গিয়ে তিনি ঘুমিয়েও পড়েননি, পৃথিবীর বুকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ, কনুইয়ে কনুই মেশানো মৌন, বাক্যহীন মানুষদের প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন তিনি, ‘শিরদাঁড়া সোজা করে/ উঁচু করে মাথা/ শেষ কবে বলেছ, ‘আসো/ দাঁড়াই সবাই মিলে/ সাহসের বর্ম পরে বুকে?’—এই গাঢ় অন্ধকারে এবং অন্ধকারের বাইরেও আলাদা যে জগৎ আছে সেখানে আলী রীয়াজের বিচরণ প্রান্তরে ছুটন্ত কোনো জেব্রার মতন, যে শুধু প্রান্তরের ঘাসগুলো সম্পর্কেই অবগত নয়, অবগত এর প্রতিটি ধূলিকণার সঙ্গে, এমনকি ছুটে যাওয়া বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গেও।

‘শেয়ারবাজার, অর্থনীতি, খেলাধুলা, সমরাস্ত্র ভাসিয়ে দিয়ে একজন আয়েশা বেগম কী নিষ্পাপ শিশু কোলে

 দাঁড়ায় চোখের পাতায়।’

আমি নেই, আমার না থাকা আছে
আমি নেই, আমার না থাকা আছে
আমি নেই, আমার না থাকা আছে
আলী রীয়াজ
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
প্রকাশক: সমাবেশ, ঢাকা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৭
দাম: ৪৫০ টাকা।

কখনো স্যাটায়ারের ভঙ্গিতে, কখনো বিদ্রোহীর ভূমিকায়, কখনোবা নতজানু হয়ে কবি শেষপর্যন্ত মানুষের কথা বলতে চেয়েছেন কবিতায়। এখনো তিনি রোরুদ্যমান অপরের ব্যথায়, চিৎকাররত।তাঁকে তীব্রভাবে স্পর্শ করে বন্ধুর মৃত্যু, অসীম নীরবতা, ভবনের নিচে চাপা পড়া বোনের অঙ্গার হওয়া শরীর, বাংলাদেশের দিকে উদ্যত একটি পা। খুব সহজ ভঙ্গিতে রীয়াজ বলেন গভীর কথা, আর পাঠকের বুকে আলগোছে সেঁধিয়ে দেন পনিরের নরম ছুরি। সেই ছুরিতে মানুষ যতটা না রক্তাক্ত হয় তার চেয়ে বেশি টের পায় কবির রক্তাক্ত হওয়ার যন্ত্রণা। বাধ্য হয় সে যন্ত্রণায় কুঁচকে যেতে। টের পায় কবির প্রার্থনা। আশ্চর্যজনকভাবে সে প্রার্থনা যন্ত্রণা লাঘবের নয়, বরং সে প্রার্থনা নাগরিক জটিলতা ও যান্ত্রিকতা ছুড়ে ফেলে বিমানভর্তি শরতের সকাল, নদীর কল্লোল, প্রিয় সব মানুষের ভালোবাসার।

কবি আলী রীয়াজ প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসারই পিয়াসী। কখনো ভালোবাসা চেয়েছেন নিজের জন্য, কখনো শহীদজননীর জন্য। বারবার তাঁর আকুতি টের পাওয়া যায় মানুষের কাছাকাছি আসার জন্য: ‘প্রতিটি কণ্ঠ আজ শহীদজননী/...কান পাতো, যত দূরে থাকো।’

আলী রীয়াজের যে পরিচয়ে আমরা অভ্যস্ত, সেই পরিচয় তিনি অবলীলায় সরিয়ে রেখে লিখেছেন কবিতা, এসেছেন চমকরূপে। সেসব কবিতা এবং চমক পাঠ করতে করতে মনে হয় আমরাও কান পাতি। কান পাতি লাঞ্ছিতা বোনের স্বর শোনার জন্য, কান পাতি নিদ্রাহীন রাতে নিজস্ব নিবাস থেকে নিজেকে আড়াল করে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়া মানুষটির কান্না শোনার জন্য।