'ইসরায়েলের সমাজব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় সমস্যা ভয়'

ডেভিড গ্রোসম্যান
ডেভিড গ্রোসম্যান
সম্প্রতি ম্যান বুকার পুরস্কার পেয়েছেন ইসরায়েলের ঔপন্যাসিক ডেভিড গ্রোসম্যান। ২০১৬ সালে বের হওয়া আ হর্স ওয়াকস্ ইন্টো আ বার উপন্যাসের জন্য এ বছর তিনি পেলেন পুরস্কারটি। গেল বছরের জুনে ফ্রান্সভিত্তিক সংবাদ সংস্থা ইউরোনিউজের সঙ্গে এই উপন্যাস নিয়ে বিশদ কথা বলেন তিনি। ইসাবেলা কুমারের নেওয়া সেই সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন তুষার তালুকদার

ইসাবেলা কুমার: আপনার নতুন উপন্যাস আ হর্স ওয়াকস্ ইন্টো আ বার-এর প্রধান চরিত্র দোভেল একদিকে যেমন প্রচণ্ড মানবতাবাদী একটি বার্তা দেয়, অন্যদিকে মানব চরিত্রের নানা কদর্য দিকও উন্মোচন করে পৃথিবীর সামনে। তবে কি ধরে নেব চরিত্রটি ইসরায়েলের প্রতি আপনার বৈপরিত্যমূলক কিংবা মিশ্র অনুভূতির রূপকায়ন করছে?

ডেভিড গ্রোসম্যান: চরিত্রটি একেবারেই সাহিত্যের খাতিরে নির্মিত। হ্যাঁ, দোভেলের চরিত্রের নানা স্তর রয়েছে। সে সঙ্গে আছে তার ভেতরকার নানা দ্বন্দ্ব। এসব মিলিয়ে জীবন্ত হয়েছে চরিত্রটি। চৌদ্দ বছর বয়সে ঘটে যাওয়া ঘটনা তার জীবনকে ভিন্ন বাঁকে নিয়ে যায়। এক-আধবার মনে হয়, ইসরায়েলে যে কারও ভাগ্য যেন নির্ধারণ করা আছে। বিগত বছরগুলোতে রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল একটি ছোটখাটো সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছে। আর তখন থেকেই আমাদের জীবন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করেছে।

ইসাবেলা: তার মানে উপন্যাসটিতে অনেকগুলো জরুরি বার্তা দিতে চেয়েছেন আপনি। এসবের মধ্যে কোনো একটিকে কি বিশেষ প্রয়োজনীয় মনে হয় আপনার কাছে?

গ্রোসম্যান: যে গল্পটি আমি বলেছি তা একেবারেই দোভেলের। এটি এক সন্ধ্যার গল্প। পুরো গল্পটি ইসরায়েলের ছোট একটি শহরের একটি নৈশ ক্লাব থেকে বলা। এ ক্লাবে মানুষকে কৌতুক শোনায় দোভেল। মূলত সে একজন মঞ্চ কৌতুকাভিনেতা (স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান)। কৌতুক শোনাতে শোনাতে তার জীবনে ঘটে যাওয়া পাশবিকতার গল্প বলে সে। দোভেল খুবই ভঙ্গুর প্রকৃতির মানুষ। শৈশবকাল থেকে খুব আবেগপ্রবণ ও সৃজনশীল। চৌদ্দ বছর বয়সে তাকে সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যা আমূল বদলে দেয় তার জীবনকে। আদতে ইসরায়েলে আমরা প্রায় সবাই চৌদ্দ কিংবা পনেরো বছর বয়সে একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাই। ক্যাম্পে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বাবা-মায়ের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে থাকা জীবন ছিল তার। হঠাৎই তাকে যেন নির্বাসনে পাঠানো হলো। একদিন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণকালে একজন নারী সৈন্য এসে বলে, ‘দোভেল কে?’ ‘সে বলে, আমি।’ ও নারী বলে, ‘তাড়াতাড়ি আমার সঙ্গে এসো। তোমাকে চারটার মধ্যে জেরুজালেমে শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যেতে হবে।’ কথাটি শুনে খুব মর্মাহত হলো দোভেল। ‘কিন্তু কার শেষকৃত্য? বাড়ি থেকে আসার সময় শেষকৃত্য সম্পর্কে কেউ তো কিছু বলেনি আমাকে।’ ভাবতে লাগল সে।

তারপর দ্রুতই তাকে তোলা হলো সেনাবাহিনীর একটি গাড়িতে। জেরুজালেম যেতে পাক্কা চার ঘণ্টা লাগবে। তবে কে মারা গেছে? এই প্রশ্নটি সে-ও কাউকে করেনি আবার কেউ তাকে এ সম্পর্কে কিছু বলেওনি। বাবা-মায়ের কেউ একজন? এই চার ঘণ্টা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে পীড়াদায়ক সময়। শেষকৃত্যে পৌঁছানোর পর সব কিছু জানতে পারে সে। এমন উদাসীনতার মানে কি? মাঝেমধ্যে মনে হয়, উদাসীনতা নিষ্ঠুরতার সবচেয়ে বড় বহিঃপ্রকাশ।

ইসাবেলা: দোভেল খুব নির্জনতম একটি চরিত্র। সবার মধ্যে থেকেও যেন নেই। কেন যেন মনে হয় দোভেলের ভেতর আপনার নিজের জীবনের কাহিনি কোথাও লুকিয়ে আছে। দোভেলের মতো আপনাকেও প্রত্যাখ্যান করেছে আপনার দেশের অনেক মানুষ। আপনার বিশ্বাস কিংবা ধারণার জন্য আপনাকে তারা দেশদ্রোহী বা বিশ্বাসঘাতক বলে ভাবে? আপনার কি কখনো মনে হয়নি আপনি আপনার নিজ দেশে পরবাসী?

গ্রোসম্যান: আমার চিন্তা ভিন্ন ধরনের। আমি বুঝতে পারি, আমার দেশের বেশির ভাগ মানুষ প্রতিবাদ করা ভুলে গিয়ে কঠিনতম বাস্তবতাকে এড়িয়ে চলতে শিখে গেছে। তারা সহজ সরল পথ বেছে নিয়েছে। তারা রাজনৈতিক সমাধানের কঠিন অথচ যৌক্তিক পথকে ত্যাগ করে আরও বেশি ধর্মীয় উন্মাদনা ও মৌলবাদের দিকে এগিয়েছে।আমার কথাগুলো দু-দেশের—ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন—উভয়েরÑবেলায়ই প্রযোজ্য। তাই সমাধানের পথ অবরুদ্ধ হয়ে আছে। হ্যাঁ, দোভেলের মধ্যে কোথাও না কোথাও আমি থাকতেই পারি।

ইসাবেলা: কিন্তু আমরা তো প্রতিবাদী মানুষজনের কথাও জানি, যারা গড়পড়তা ইসরায়েলিদের মতো স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন না। তবে সেই সব কণ্ঠস্বরকে সরকার রুদ্ধ করে দেয়। যেমনÑশুনেছি আপনার মতো লেখকেরা সরকারের কোনো অনুদান পান না। কারণ, আপনারা ইসরায়েল বর্তমান সরকারের প্রতি অনুগত না। আসলে আনুগত্য বলতে তাঁরা কি বোঝাতে চাইছেন?

আ হর্স ওয়াকস্ ইন্টো আ বার
আ হর্স ওয়াকস্ ইন্টো আ বার

গ্রোসম্যান: আপনি বরং তাঁদেরকেই জিজ্ঞেস করেন আনুগত্য বলতে তাঁরা কী বোঝাতে চান...আমার আনুগত্যের প্রমাণ তাঁদেরকে দিতে হবে বলে মনে করি না আমি। ইসরায়েলে আমার জন্ম। আমি এ রাষ্ট্রের সমাজ, জীবন ও সংস্কৃতির সক্রিয় অংশ। আনুগত্যের যে প্রশ্ন সরকার তোলে তা একেবারেই স্বৈরাচারমূলক। এটি গণতন্ত্রের অধঃপতনের ইঙ্গিত দেয়। আমার আনুগত্য আমার শিল্প, লেখালেখি ও আমার বইতে যেসব বিষয় লিখেছি সেসবের প্রতি।

ইসাবেলা: আ হর্স ওয়াকস্ ইন্টো আ বারে ইসরায়েলের বর্তমান সমাজব্যবস্থার নানা দিকও উঠে এসেছে। এ প্রসঙ্গে যদি কিছু বলতেন...

গ্রোসম্যান: আমাদের সমাজের বাস্তবতাকে ফিকশনে অনেকটা হুবহুই নিয়ে আসতে হয়। আমি দেখিয়েছি ইসরায়েলের সমাজব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় সমস্যা ভয়। এ ভয় দ্বারা শাসিত সমাজ। যেসব সন্তানেরা সেনাবাহিনীতে যায় তাদের জন্য ভয়, রাস্তায় হাঁটতে গেলে ভয়—সর্বত্র ভয়ের রাজত্ব। আর সরকারপক্ষ ও ডানপন্থীরা এই ভয়কে পুঁজি করছে। আমি বিশ্বাস করি, যে সমাজ কেবল ভয় দ্বারা শাসিত তার অধঃপতন আসন্ন। এই সমাজের মজ্জাগত কোনো শক্তি নেই। তাই এর বিকশিত হওয়ার ক্ষমতাও নেই।

ইসাবেলা: আপনার উপন্যাসে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের ইঙ্গিতও রয়েছে কিছুটা। ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে—এটি আপনার জীবদ্দশায় কি দেখে যেতে পারবেন?

গ্রোসম্যান: আমি আশাবাদী মানুষ। ফিলিস্তিনের মানুষের জন্য আমার সংগ্রাম কেবল তাদের বাড়ি, দেশ কিংবা আত্মমর্যাদার জন্য নয়, আমি চাই তারা যেন কোনো দখলদারির প্রক্রিয়ার মধ্যে জীবন যাপন না করে। তাদের জীবনের ওপর কোনো ছায়া পড়ুক আমি তা চাই না। অন্যের জীবনকে ছায়াচ্ছন্ন করা মানে নিজের জীবনকেও ছায়াবৃত করা।

ইসাবেলা: আপনার কাছে একজন জানতে চেয়েছেন, ইসরায়েলকে কি কেবল ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চান নাকি ইহুদি, আরবসহ অন্য ধর্মাবলম্বীদেরও জায়গা হওয়া উচিত এখানে?

গ্রোসম্যান: ইসরায়েল কেবল ইহুদি রাষ্ট্র হোক তা আমি কখনোই চাই না। অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ও সেসব ধর্মের সংখ্যালঘুদের জন্যও একটি সুখকর জায়গা হোক ইসরায়েল—এ আমার প্রত্যাশা।

ইসাবেলা: প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুর প্রতি একধরনের ভালোবাসা আছে আপনার। তবে সম্প্রতি আপনি এ-ও বলেছেন, তিনি চোখ বন্ধ করে দেশ চালাচ্ছেন। এ দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছেন?

গ্রোসম্যান: আমি বুঝি না তাঁর মতো একজন মেধাবী মানুষ কীভাবে বাস্তবতাকে এড়িয়ে যান। ইসরায়েল কেবল ক্ষমতার দম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে—এই সত্যকে তিনি কীভাবে এড়িয়ে যান তা আমার বোধগম্য নয়। ঈশ্বর না করুন, এভাবে চললে ইসরায়েলের পতন কেউ ঠেকাতে পারবে না। শুধু ক্ষমতার ওপর নির্ভর করলে একদিন আমাদের পরাজয় হবে। একদিন আমাদের চেয়েও ক্ষমতাশালী কেউ আমাদের জায়গাটি দখল করে নেবে।

নেতানিয়াহু শান্তি বিনষ্টকারী। বহু বছর যাবৎ শান্তি প্রতিষ্ঠার সব সম্ভাবনাকে তিনি এড়িয়ে যাচ্ছেন। ইসরায়েলকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছেন তিনি। ধরুন, একজন মানুষকে বারবার অত্যাচার করে বিনিময়ে তার কাছে ভালোবাসা চাইবেন তা তো হতে পারে না।

ইসাবেলা: আবারও ফিরে আসি আ হর্স ওয়াকস্ ইন্টো আ বার-এর কথায়। এতক্ষণ যা বললেন সেসব কি প্রতীকায়ন করার চেষ্টা করেছেন এ উপন্যাসে?

গ্রোসম্যান: এই প্রচেষ্টা তো কিছুটা আছেই। এর উত্তরে প্রসঙ্গক্রমে আবারও দোভেলের গল্প বলি। ইসরায়েলের মানুষকে কৌতুক শুনিয়ে খানিকটা আনন্দ দিতে পারলে দোভেল সার্থক। যে সমাজের মানুষ যন্ত্রণা, পীড়া, ভয় প্রভৃতি নেতিবাচক দিকগুলোর ভেতর দিয়ে জীবনযাপন করছে, কিছুটা আনন্দ পাওয়া তাদের কাছে পরম আরাধ্য বিষয়। কিন্তু যে আপনাকে আনন্দ দিচ্ছে সে-ও তো আপনার সমাজেরই মানুষ। প্রশ্ন থেকে যায়, সে কতক্ষণ কষ্ট ভুলে আপনাকে আনন্দ দেবে? আমি দেখিয়েছি, মানুষ তো কেবল আনন্দ চায় অথচ যে আনন্দ দিচ্ছে তার জীবনের পেছনের গল্পে যে কোনো আনন্দ নেই তা শুনতে চায় না। দেখবেন, লোকজন একসময় বিরক্ত হয়ে ক্লাব ছেড়ে চলে যায় কারণ দোভেল কৌতুক শোনাতে শোনাতে তার নিজের অতীতে ফিরে যায়, যেখানে রাজত্ব করছে শুধু ভয় আর পীড়া। আসলে মানসিক ক্ষতকে এড়াতে পারে এমন মানুষ ইসরায়েলে পাওয়া ভার। হ্যাঁ, দোভেল চেষ্টা করে শ্রোতাদের কল্পনার (ফ্যান্টাসি) জগতে নিয়ে যেতে, কিন্তু শেষ নাগাদ পারে না। তবে সে যখন তার বিষাদময় গল্প শুরু করে তখনো কিছু শ্রোতা অবশিষ্ট থাকে। আর তাদের একজন থাকে দোভেলের পূর্বপরিচিত। শেষমেশ তার জবানিতেই আপনাদের শুনতে হবে দোভেলের অতীত জীবনের গল্প, যার সঙ্গে মিলে যায় প্রায় প্রতিটি ইসরায়েলির জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো না কোনো ঘটনা। ফলে তার গল্পে আছে সেনাবাহিনী জীবনের যন্ত্রণার কথা, রয়েছে ভয় দেখানো রাষ্ট্রযন্ত্রের কথা, আছে ব্যক্তিজীবনের অম্ল স্মৃতিগুলোর কথা। মূলত প্রত্যেকের জীবনে একটা অতীত বা পেছনের গল্প থাকে, যা মধুর নয়। দোভেল সেই পেছনের গল্পকে (ব্যাকস্টোরি) রূপকায়ন করেছে।

ইসাবেলা: আপনার এই উপন্যাসে অনেক কৌতুক রয়েছে। এসবের মধ্যে কি কোনো বিশেষ কৌতুক আপনার পছন্দ?

গ্রোসম্যান: এ বই কৌতুকে ঠাসা। কৌতুকের একটি নিরন্তর প্রবাহের কারণে উপন্যাসটি লিখতে ভালো লেগেছে আমার। উপন্যাসের শিরোনামের সঙ্গে মিল রয়েছে এমন একটা কৌতুক শোনাই আপনাদের: একটি ঘোড়া মদের দোকানে প্রবেশ করে এক পেগ ভদকা চাইল। দোকানি অবাক হয়ে তাকাল ঘোড়াটির দিকে। তারপর ভদকা ঢেলে দিল গ্লাসে। ঘোড়াটি গ্লাসটা নিল ও পান করল। তারপর জিজ্ঞেস করল, কত? দোকানি বলল, ৫০ ডলার। ঠিক আছে, ঘোড়াটি দাম দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। পেছন পেছন দৌড়ে এসে দোকানি বলল, মি. হর্স একটু থামুন,Ñকথা বলছে এমন ঘোড়া কখনো দেখিনি আমি। ঘোড়াটি তার দিকে তাকিয়ে বলল, এমন দাম হলে আর কখনোই দেখবেন না।

বাস্তবতার পাশাপাশি এমন রসদ আপনাদের স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে সাহায্য করবে। এদিকে কৌতুক, অন্যদিকে বেদনা—এ নিয়েই আ হর্স ওয়াকস্ ইন্টো আ বার উপন্যাসের এগিয়ে চলা।