বিচক্ষণ প্রশ্ন, প্রাণবন্ত উত্তর

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথে িবমানে তাঁর পাশে ছিলেন ভারতীয় কর্মকর্তা ভেদ মারওয়া। এ নিয়ে ইতিহাসের সত্য সন্ধানে: বিশিষ্টজনদের মুখোমুখি বইয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তিনি। ছবি: সংগৃহীত
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথে িবমানে তাঁর পাশে ছিলেন ভারতীয় কর্মকর্তা ভেদ মারওয়া। এ নিয়ে ইতিহাসের সত্য সন্ধানে: বিশিষ্টজনদের মুখোমুখি বইয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তিনি। ছবি: সংগৃহীত

একজন বা দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তির, বিশেষত কবি-সাহিত্যিক-রাজনীতিক-লেখকের সাক্ষাৎকার বা কথোপকথনের সংকলনগ্রন্থ মোটেই দুর্লভ নয়। তবে ইতিহাসের সত্য সন্ধানে: বিশিষ্টজনদের মুখোমুখি বইয়ে স্থান পেয়েছে ৩৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির ৩৭টি কথোপকথন। বিচিত্র বিষয়ে এতসংখ্যক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার-সংকলন খুব কমই দেখা যায়। যেকোনো মহৎ ব্যক্তির অনেক খুঁটিনাটি বিষয় উঠে আসে একান্ত কথোপকথনের মধ্য দিয়ে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, না-বলা কথা, অপ্রকাশিত নানা তথ্য, নিজের দর্শন, জানাবোঝার পরিধি—এককথায় ব্যক্তির সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গির চিত্র ফুটে ওঠে একান্ত কথোপকথনের মধ্য দিয়ে। এ ক্ষেত্রে কোন ধরনের ব্যক্তি লেখকের পছন্দ, লেখকের বিষয় নির্বাচন, তাঁর জিজ্ঞাসার ধরন প্রভৃতি দেখে সাক্ষাৎকারগ্রহীতার রুচিরও পরিচয় পাওয়া যায়। বইটির সূচিপত্রে বিষয়ভিত্তিক বিন্যাস দেখলেও তাঁর শৈল্পিক রুচির পরিচয় মেলে। এর অবশ্য কারণও আছে।

লেখক কলেজজীবনে প্রবেশের অব্যবহিত পর, ষাটের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে এবং পরে কমিউনিস্ট পার্টিতে সক্রিয় ছিলেন। সেই সময় সম্পর্কে লেখকের ভাষ্য প্রণিধানযোগ্য, ‘আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতিটি কর্মসূচিতে কর্মমুখর থেকেছি। গত পাঁচ দশক ধরে নানা কাজের মধ্য দিয়ে দেশের সেরা চিন্তাবিদ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সাংস্কৃতিক সংগঠক এবং কবি-লেখক-শিল্পীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ হয়েছে। মূলত ষাটের দশক থেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি এবং তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখার চেষ্টা করেছি। তাঁদের সান্নিধ্য এবং ঘনিষ্ঠভাবে মতবিনিময়ের সুযোগ পেয়ে আমার ভাবনা-চিন্তার জগৎ যেমন প্রসারিত হয়েছে, তেমনি সমৃদ্ধও হয়েছে আমার জীবন।’

উৎসুক পাঠক মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের সময় বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী, বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতির সাম্প্রতিক প্রবণতা—সরকারি ও বিরোধী দলের রাজনীতিচর্চা, গণতন্ত্রের সম্ভাবনা ও সংকট, পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের সময় ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে কমিউনিস্ট রাজনীতির চিত্র, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে অনেক প্রশ্নের মীমাংসা খুঁজে পাবেন। কারণ, সাক্ষাৎকারগ্রহীতা মতিউর রহমান দেশ-বিদেশের রাজনীতিবিদ, সমাজচিন্তাবিদ, অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ, মানবাধিকারকর্মী, কূটনীতিক, ক্রিকেটার, সংগীতশিল্পী, অভিনয়শিল্পীসহ রুশ বুদ্ধিজীবী-লেখকদের সঙ্গে বিচক্ষণতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে আলাপচারিতাকে করে তুলেছেন প্রাণবন্ত। ফলে অনেক বিচিত্র ও জটিল চিন্তাভাবনার সাবলীল ভাষ্য উঠে এসেছে গ্রন্থভুক্ত আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে।

এ ছাড়া সত্তরের দশক থেকে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে বেছে নেওয়া, বিচিত্র বিষয়ে জানাশোনার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষার কারণও লেখককে দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সান্নিধ্য পেতে সাহায্য করেছে। তাই ‘অভিজ্ঞ সাংবাদিকের নির্বাচিত প্রশ্ন’ এবং বিশিষ্টজনদের বিচক্ষণ ও ‘খোলামেলা উত্তর’-এ সাক্ষাৎকারগুলো হয়ে উঠেছে সুখপাঠ্য।

বাংলাদেশের রাজনীতি বিষয়ে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, রাজনীতিক ও আইনজীবী কামাল হোসেন, রাশেদ খান মেনন ও জোহরা তাজউদ্দীনের একান্ত আলাপচারিতা।

ইতিহাসের সত্য সন্ধানে: বিশিষ্টজনদের মুখোমুখি
ইতিহাসের সত্য সন্ধানে: বিশিষ্টজনদের মুখোমুখি
ইতিহাসের সত্য সন্ধানে: বিশিষ্টজনদের মুখোমুখি
মতিউর রহমান
প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী,
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৭
৪২৩ পৃষ্ঠা
দাম: ৬০০ টাকা

সমাজ-রাষ্ট্র-উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান, ইতিহাসবিদ সালাহ্উদ্দীন আহমদ, ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইউনূস, বামপন্থী নেতা অজয় রায় প্রমুখের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে আলাপ করেছেন বাংলাদেশে ভারতের প্রথম কূটনীতিক জে এন দীক্ষিত, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সঙ্গী ভেদ মারওয়া ও গবেষক-শিক্ষক এনায়েতুর রহিমের সঙ্গে। এ ছাড়া যাঁদের কথোপকথন পাঠককে বেশি আকৃষ্ট করবে, তাঁরা হলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, ক্রিকেটার মনসুর আলী খান পতৌদি, কৃষ্ণচামারী শ্রীকান্ত, কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লা প্রমুখ।

১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ২০০০ সালে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ করেছেন মতিউর রহমান। প্রাণবন্ত এই সাক্ষাৎকার দুটো আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাসের চারটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বের চার সাবেক সেনা কর্মকর্তার সাক্ষাৎকারও পাঠকের মনে জমে থাকা নানা প্রশ্নের উত্তর দেবে। বিশেষত, পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট বঙ্গবন্ধু আক্রান্ত হওয়ার পরপরই তিনি যে ফোন করেছিলেন তখনকার সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহকে। উত্তরে কী বলেছিলেন সফিউল্লাহ? তাঁর বয়ানেই উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময়ে সেনাবাহিনী ও তাঁর নিজের ভূমিকার কথা।

পাঠের আনন্দ তো বটেই, বইটি থেকে শিক্ষণীয়ও আছে অনেক কিছু। সাংবাদিক-লেখকদের মধ্যে যাঁরা বিভিন্ন সময় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নিয়ে থাকেন, তাঁদের জন্য অবশ্যপাঠ্য এই বই। কারণ, সমাজে-দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে সবচেয়ে প্রাগ্রসর ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার আগে যে সেই ব্যক্তির অভিজ্ঞতা, কাজের ক্ষেত্র, কাজের আগ্রহ, কাজের পরিসর, প্রকাশনা, দৃষ্টিভঙ্গি, নিজস্ব মতবাদ ইত্যাদি সম্পর্কে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হয়, সে বিষয়টি যেকোনো সচেতন পাঠককে সমৃদ্ধ করবে।

বলার অপেক্ষা রাখে না লেখক-সাংবাদিক মতিউর রহমানের দীর্ঘদিনের সাধনার ফসল এই বই। বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ এখন পাওয়া যাচ্ছে বাজারে।