স্মৃতিচারণে ঐতিহাসিক কালপর্ব

>

ওজারতির দুই বছর

আতাউর রহমান খান

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: মাসুক হেলাল / প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা / প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০১৭ / ২৫৫ পৃষ্ঠা / দাম: ৪৫০ টাকা।

বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রাজ্ঞ রাজনীতিকদের মধ্যে অন্যতম আতাউর রহমান খান। তাঁর লেখা ওজারতির দুই বছর এমন এক গোত্রের স্মৃতিচারণামূলক বই, ‘প্রকাশকের কথা’য় মতিউর রহমান এ-সম্পর্কে বলতে গিয়ে যথার্থই বলেছেন, ‘সরল ভাষায় ও সরল ভঙ্গিতে লেখা আতাউর রহমান খানের এ বই হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্বকালের একটি রাজনৈতিক কালপর্বের মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল।’ ভূমিকাটি পাঠ করার পরপরই আমরা যখন এ বইয়ের গভীর থেকে গভীরে যেতে থাকি, মতিউর রহমানের কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য বলে প্রমাণিত হতে থাকে।

আতাউর রহমান খানের লেখার ভঙ্গিটি স্মৃতিচারণামূলক হলেও ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ সালজুড়ে তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের দুই বছরের যে কাল, সেই কালপরিসরে ঘটে চলা ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ সত্যিই ‘দলিল’ হয়ে উঠেছে।

আতাউর রহমান খানকে পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ পড়াচ্ছেন গভর্নর শেরেবাংলা এ কে
আতাউর রহমান খানকে পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ পড়াচ্ছেন গভর্নর শেরেবাংলা এ কে

পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালি মুসলমান ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঠিকই, তবে তার মোহমুক্তি ঘটতেও সময় লাগেনি। বাঙালির ভাষার প্রশ্নে ১৯৪৮ সালে যখন মুসলিম লীগ শাসক সম্প্রদায়, এমনকি পাকিস্তানের জাতির জনক খোদ মোহাম্মদ আলী জিন্নার মুখ থেকে যখন শোনা যায়, ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা,’ এ দেশের বাঙালি বুঝে গিয়েছিল, এ তারা কোন আবাসভূমির বাসিন্দা! ফলে এভাবেই শুরু হয়ে যায় বাঙালির সার্বিক বাঙালিত্ব সংগ্রাম। এ সবকিছুরই জলজ্যান্ত সাক্ষী আতাউর রহমান খান। এমনকি তিনি ছিলেন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পরিণতিতেই যুক্তফ্রন্টের জন্ম। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার মনোনীত প্রার্থীদের হারিয়ে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীদের অভাবিত জয় ভীতিগ্রস্ত করে তোলে মুসলিম লীগকে—তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, সেই সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারি মহলকেও। এ বইয়ে এসবের বর্ণনা আছে। আছে খুবই রসালো আর তির্যক ভঙ্গিতে। মোট কথা, পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের প্রধান ক্ষেত্র সেই কালের পূর্ব পাকিস্তানে (আজকের বাংলাদেশ) যুক্তফ্রন্টের সরকার গঠন তাদের ভালো লাগেনি। ফলে শুরু হয় ষড়যন্ত্রের পর ষড়যন্ত্র। কীভাবে মুখ্যমন্ত্রিত্বের পদ থেকে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে সরানো হলো, মুখ্যমন্ত্রী করা হলো আবু হোসেন সরকারকে, আবার আবু হোসেন সরকারকে সরিয়ে আতাউর রহমানের নেতৃত্বে সরকার গঠন করা হলো—এসব ঘটনার বিবরণ আতাউর রহমান খান দিয়েছেন অকপটে। এ বইয়ে বর্ণিত সবকিছু তাঁর কাছে থেকে দেখা। দেখেছেন পাকিস্তানি শাসকচক্রের চেহারা—শুধু বাইরের নয়, ভেতরেরও। এ কথা তিনি নির্দ্বিধায় বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ববঙ্গকে কোনোভাবেই মাথা তুলে দাঁড়াতে দেওয়া হবে না। ব্যবসা-বাণিজ্য, সামরিক-বেসামরিক কর্তৃত্ব—সব পশ্চিমাদের হাতে। ব্যাংক, বিমাও তাদের এখতিয়ারে। কৃষিনির্ভর দেশ পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমারা সেই কৃষিকেও বিকশিত হতে দিতে চায় না। আতাউর রহমান খান আমাদের মন খুলে জানাচ্ছেন, ‘শিল্প গড়ে উঠতে পারেনি পূর্ব বাংলায়, নন-ডিভ্যালুয়েশনের আমলে বিদেশ থেকে কম দামে বড় বড় যন্ত্রপাতি এনে শিল্প গড়ে ওঠে পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাতীত।’ তিনি আরও জানাচ্ছেন, ‘আর সেই শিল্পজাত সামগ্রী বিদেশে রপ্তানি করার সময় যখন এসেছে, তখন নন-ডিভ্যালুয়েশন চালু থাকলে বিদেশ থেকে কম টাকা আসবে, এই ভয়ে মুদ্রার মূল্যমান কমিয়ে বা ডিভ্যালুয়েশন করে দিয়েছেন। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে বৃহৎ শিল্প গড়ে ওঠার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবসা গড়ে ওঠেনি পূর্ব পাকিস্তানে, তার অন্যতম কারণ মূলধনের অভাব। মূলধন গড়ে ওঠার সুযোগই পায়নি পূর্ব পাকিস্তানে।’

এখানেই থেমে থাকেননি আতাউর রহমান খান। যুক্তফ্রন্টের শরিক দলগুলোর মধ্যকার অন্তঃকলহ, অন্তর্দ্বন্দ্ব ও পারস্পরিক দ্বেষ-বিদ্বেষের কথাও প্রায় খোলামেলাভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। কেবল নিজেদের অন্তঃকলহই নয়, অন্তর্দ্বন্দ্বই নয়, এসবের পেছনে যে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকমহলেরও সক্রিয় ষড়যন্ত্র ছিল, আতাউর রহমানের বয়ানে সে কথাও আভাসিত হয়। ফল কী দাঁড়ায়? ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের নেতৃত্বে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর গোটা পাকিস্তানে জারি করা হয় সামরিক শাসন। তবে এই সামরিক শাসকের পীড়ন ভোগ করতে হয় সবচেয়ে বেশি তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান, তথা পূর্ববঙ্গকে। আতাউর রহমান মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে পদচ্যুত হন। কথিত ‘এবডো’ আইন বলে রাজনীতি করা থেকে তাঁকে আরও অনেকের মতো নিষিদ্ধ করা হয়। এ পর্যন্ত যখন আসি, তখনই মনে হয়, আইয়ুবের সামরিক শাসনের গর্ভেই বীজ রোপিত হয়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে আতাউর রহমান খানেরই ভাষ্যে, যেখানে তিনি বলছেন, ‘মার্শাল ল রাজত্বের সাফল্যের দাবি পাকিস্তানে বনিয়াদি আদর্শকে ধ্বংস করে দিচ্ছে ও দেবে। কুয়াশাচ্ছন্ন দৃষ্টি নিয়ে অনেকেই এর ভেতর নতুন কিছু দেখতে পাচ্ছেন। চারদিক পরিষ্কার হয়ে গেলে দেখা যাবে কত বড় ক্ষতি হয়েছে দেশের ও জাতির।’ বাঙালি এ ক্ষতিকে বেশি দিন সহ্য করেনি। ইতিহাস স্পষ্ট সে সাক্ষ্যই দেয়। ওজারতির দুবছর-এর পাঠ আমাদের অতীতের রাজনীতি সম্পর্কে অজানা অনেক কিছু জানতে সাহায্য করে। ফলে আমাদের রাজনৈতিক-সাহিত্যে এ বই একটি সংযোজনস্বরূপ গ্রন্থ।