মৃত্যুহীন জীবনজুড়ে কবিতার রং

শখের ক্যামেরা হাতে চে গুয়েভারা। ছবি: সংগৃহীত
শখের ক্যামেরা হাতে চে গুয়েভারা। ছবি: সংগৃহীত

চে: বন্দুকের পাশে কবিতা
মনজুরুল হক ও মতিউর রহমান
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১২৮ পৃষ্ঠা, দাম: ২৫০ টাকা।

ইতিহাস বলে, আজ থেকে ৫০ বছর আগে বলিভিয়ার জঙ্গলঘেরা এক প্রত্যন্ত গ্রামে হত্যা করা হয় সারা বিশ্বের বিপ্লবীদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অনুপ্রেরণা চে গুয়েভারাকে। কিন্তু তাঁকে হত্যা করতে আদতে চরমভাবে ব্যর্থ হয় মার্কিন মদদপুষ্ট বলিভিয়ার তৎকালীন সামরিক সরকার। রক্তমাংসের একটা শরীরকে কেবল তারা নির্জীব করে ফেলে। চের বাকি অস্তিত্ব বহুগুণ শক্তিশালী হয়ে প্রচণ্ড দ্যুতি ছড়াতে থাকে বিশ্বজুড়ে। শরীরহীন কিন্তু দারুণ জীবন্ত একজন চে ‘যিশুখ্রিষ্টের মতো হাজির হয়ে যান প্রতিকৃতিতে, লাল পোস্টারে, গানে, কবিতায়, বইয়ের পাতায় আর সিনেমায়—পৃথিবীর প্রায় সব শহরে, রাস্তায় রাস্তায়, মিছিলে আর স্লোগানে।’

মনজুরুল হক আর মতিউর রহমান, তাঁদের চে: বন্দুকের পাশে কবিতা বইয়ে এই অজর অমর বিপ্লবীর সঙ্গে কবিতার চিরন্তন আর স্বতঃস্ফূর্ত এক সম্পর্ক তুলে ধরেছেন অতি যত্নে। দেখিয়েছেন কীভাবে বিপ্লবের অস্ত্র আর কবিতার ভাব মিলেমিশে একাকার হয়ে ছিল চের জীবনব্যাপী। আলোচনার সুবিধার্থে, কবিতার সঙ্গে এই মহান নায়কের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ককে লেখকদ্বয় তিনটি ভাগে ভাগ করে এগিয়েছেন: চের নিজের লেখা কবিতা, তাঁর প্রিয় কবি ও কবিতা এবং যুগে যুগে সারা বিশ্বে তাঁকে নিয়ে যেসব কবিতা রচিত হয়েছে।

কবিতা কেবল চে গুয়েভারার বিপ্লবী চেতনার সঙ্গী ছিল এমন নয়। মনজুরুল হক আর মতিউর রহমান জানাচ্ছেন, তাঁর অতি ব্যক্তিগত আবেগ আর দুঃখের দিনে কবিতাকেই তিনি বেছে নিয়েছেন পরম আশ্রয় হিসেবে। দাদির মৃত্যুতে তিনি চার পৃষ্ঠার একটি কবিতা লেখেন, মাত্র ২০ বছর বয়সে।

বইটির অনূদিত কবিতাংশ শুরু হয়েছে ‘ফিদেলের জন্য গান’ নামে তাঁর নিজের রচিত কবিতা দিয়ে।

দৈহিকভাবে মৃত চের ব্যাগ থেকে সবুজ রঙের দুমড়েমুচড়ে যাওয়া নোটবুক পাওয়া যায়। এটি ছিল মূলত নিজের হাতে তুলে রাখা তাঁর প্রিয় কবিদের কবিতার সংকলন। ছিল কিউবার কবি নিকোলাস গিয়েন, পেরুর সেজার ভাইয়েখোর আর চিলির কবি পাবলো নেরুদার কবিতা। নেরুদার কবিতা তাঁকে আজীবন মোহগ্রস্ত করে রেখেছিল। নেরুদার স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে একজন কবি আর একজন বিপ্লবীর একমাত্র সাক্ষাতের অনন্য গল্প। নেরুদার মতে চে গুয়েভারা ‘এমন এক ভাবুক, সাহসিক লড়াইয়ে যিনি অস্ত্রের পাশে সব সময় রাখতেন কবিতা।’ কিউবার মুক্তিসংগ্রামে তিনি সর্বক্ষণ সঙ্গে রাখতেন নেরুদার কান্তো জেনারেল। তিনি ভালোবাসতেন লোরকার কবিতাও। পড়তে ভালোবাসতেন ওয়াল্ট হুইটম্যান আর রবার্ট ফ্রস্টের কবিতার স্পেনীয় অনুবাদ। কবিতা আবৃত্তির প্রতিও ছিল তীব্র আগ্রহ। হাভানা থেকে শেষবারের মতো চলে যাওয়ার আগে প্রিয় ভালোবাসার কবিতাগুলো নিজের কণ্ঠে রেকর্ড করে রেখে গিয়েছিলেন স্ত্রীর জন্য।



বইয়ের পরবর্তী অংশে স্থান করে নিয়েছে দেশে দেশে বিভিন্ন ভাষায় চেকে নিয়ে রচিত নির্বাচিত কিছু কবিতার অনুবাদ। উরুগুয়ের কবি আনিবাল সাম্পাইওর কবিতা দিয়ে শুরু হয়ে এই সংকলন শেষ হয়েছে পেরুর সেজার ভাইয়েখোর কবিতায়। এর মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ্য যুক্তরাজ্যের অ্যাড্রিয়ান মিচেলের ‘কীভাবে খুন করা যায় কিউবাকে’, যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালেন গিনসবার্গের লেখা ‘শোকগাথায় চে গুয়েভারা’, সেন্ট লুসিয়ান কবি ডেরেক ওয়ালকটের ‘চে’, পাবলো নেরুদার ‘একজনের বীরের মৃত্যুতে দুঃখের অনুভূতি’, আর চের জন্মভূমি আর্জেন্টিনার কবি হুলিও কোর্তাসার রচিত ‘আমার এক ভাই ছিল’। কোর্তাসার কবিতাটি শেষ করেছেন চেকে নিয়ে আবেগ আর স্মৃতির মিশেলে: ‘রাতের আড়ালে/ ভাই আমাকে দেখায়/ তার পছন্দের নক্ষত্র’।

বইটির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো প্রায় শেষ ভাগে যুক্ত ‘পোস্টার দেয়াল ও মানুষের মনে গাঁথা একটি ছবি’ নামের পরিচ্ছেদটি। সারা দুনিয়ায় বিপ্লব, বিদ্রোহ, স্বপ্ন, তারুণ্য আর শিল্পের প্রতীক হয়ে ছড়িয়ে পড়া চের অম্লান প্রতিকৃতির পেছনের অজানা কিছু গল্প এখানে তুলে ধরা হয়েছে। জানা যায় এক মহান আলোকচিত্রীর গল্প। কবে, কখন, কীভাবে, কোথায় ছবিটি প্রথম ছাপা হলো, কবে থেকে ছবিটির বাণিজ্যিক বিপণন শুরু হলো ইত্যাদি নানা তথ্যে সমৃদ্ধ এই পরিচ্ছেদ পড়া শেষে পাঠকের চোখে বহুগুণে দীপ্ত হয়ে মূর্ত হয় সেই দৃঢ়, স্বপ্নাতুর অথচ গভীরভাবে সচেতন একজোড়া চোখ। মহানায়ক ‘তাকিয়ে আছেন সোজা সামনের দিকে। যেন আমাদের আশ্বস্ত করছেন, ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’