উপন্যাসের মৃত্যু

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

‘দ্য নভেল ইজ ডেড, দিস টাইম ইটস ফর রিয়েল’—উল্লিখিত উক্তিটি যাঁর, তিনি ইংরেজ ঔপন্যাসিক উইল সেলফ। মনে হতে পারে, উপন্যাসের মৃত্যুপরবর্তী সৎকারের সব ব্যবস্থা পাকা করে এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে তিনি উদ্‌যাপনে বিভোর। বাস্তবে এটি একজন নিবেদিতপ্রাণ ঔপন্যাসিকের চাপা দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বনি। সভ্যতার একটি অন্যতম প্রধান উদ্ভাবন উপন্যাসকে—তাঁর ভাষায়—চোখের সামনে মরতে দেখছেন বলেই এই বিষাদতিক্ত উচ্চারণ।

মরতে দেখছেন? তাঁর ভাষ্য তাই। তিক্ততার তিতকুটে উদ্গার। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক নিবন্ধে এ বক্তব্যের সমর্থনে তিনি যে যুক্তি তুলে ধরেছেন, তা কিন্তু জটিল নয়, যদিও তাঁর উপন্যাসে জটিল বিষয়-আশয়ই প্রাধান্য পায়। মোটামুটি যে সরল যুক্তি তিনি দেখিয়েছেন তা হলো, প্রযুক্তি-আগ্রাসনের এই সময়ে সস্তা বিনোদনের এত হাতছানি থাকতে উপন্যাস নামের বস্তুটির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এর মৃত্যু অনিবার্য। মৃত্যুটা কাউকে দিয়ে ঘটাতে হবে না, নিজে নিজেই মরবে—অপঘাতহীন, স্বাভাবিক মৃত্যু।

উইল সেলফ
উইল সেলফ

উপন্যাস বলতে অবশ্য তিনি হালকা, মনোরঞ্জক, সুড়সুড়িপ্রবণ আখ্যান প্রত্যাখ্যান করে পাঠকের চিন্তাভাবনাকে নাড়া দেবে, উসকে দেবে এবং সেই সঙ্গে আক্রান্তও করবে, এমন রচনাকে বুঝিয়েছেন। সোজা কথায়, বড় পরিসরে সৃজনশীল সিরিয়াস রচনা। তার মানে, হুমায়ুন আজাদ যাকে বলতেন ‘অপন্যাস’, তা নয়। যার অন্য মানে, অপন্যাস নামক বস্তুটির গায়ে আঁচড় পড়বে না, সুস্বাস্থ্য নিয়েই হয়তো বেঁচেবর্তে থাকবে।

রেগেমেগে উইল সেলফ যা বলেছেন তাতে নাটকীয়তা থাকলেও যুক্তি যা দিয়েছেন, তাতে নতুনত্ব নেই। বলতে দ্বিধা থাকা উচিত নয়, ডিজিটাল এই সময়ে মানুষ তার উদ্বৃত্ত সময় অনলাইন বিনোদনে কাটাতেই ভালোবাসে এবং সেটা অস্বাভাবিক নয়। বই পড়া, আর পড়ার বিষয় যদি হয়—উইল সেলফ যাকে বলেন সিরিয়াস-লিটারারি উপন্যাস—তাহলে আপামর মানুষ এ থেকে তফাতে থাকবে, এটা কোনো আবিষ্কারের বিষয় নয়। এখানে যে প্রশ্নটা অবশ্যম্ভাবী, আপামর মানুষ কি উপন্যাসের পাঠক? আবার আপামর পাঠক কি সাহিত্যের পাঠক? দূর অতীতে যখন বই ছাড়া শিক্ষিত মানুষের মনের খোরাক জোগানোর কোনো উপায় ছিল না, তখন কি মানুষ উপন্যাসে হুমড়ি খেয়ে পড়ত—সিরিয়াস-লিটারারি উপন্যাসে? আমাদের মতো দেশের কথা বাদই দিলাম, উন্নত দেশের শিক্ষিত পাঠকমহলেও কি এর জোর প্রভাব ছিল? জেমস জয়েসের ফিনেগানস ওয়েক বা ইউলিসিস প্রথম প্রকাশের পর কত কপি বিক্রি হয়েছিল তৎকালীন সাহিত্যের পীঠস্থান খোদ বিলেতে? কিংবা আমরিকায় উইলিয়াম ফকনারের অ্যাজ আই লে ডাইং বা আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ফেয়ারওয়েল টু আর্মস? হ্যাঁ, সাড়া জাগিয়েছিল। তবে গরিষ্ঠ পাঠকের নজর এসবে ছিল না। থাকার যুক্তিসংগত কারণও ছিল না। সিরিয়াস ও লিটারারি উপন্যাস হওয়া সত্ত্বেও সাহিত্যানুরাগী নিবিষ্ট পাঠকমহলের বাইরে এগুলো সমাদর পায়নি। পেয়েছে পরে এবং সময় যত গড়িয়েছে, সমাদরের প্রসারও ঘটেছে। আরও পরবর্তী সময়ে, সাম্প্রতিক কালে, প্রযুক্তির রমরমা এবং চটুল উপন্যাসের (অপন্যাসের) ছড়াছড়ি সত্ত্বেও প্রকৃত উপন্যাসের কদর কি কমেছে? এত যে অনুবাদের বিশাল যজ্ঞ আজ পৃথিবীজুড়ে, এতে কি প্রমাণিত হচ্ছে না পাঠক বাড়ছে উপন্যাসের? কেবল নিজের ভাষার উপন্যাসে পাঠকের খিদে মিটছে না, বিশ্বের আনাচকানাচে কোথায় কী গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস লেখা হচ্ছে, তার খবর জানা জরুরি হয়ে পড়ছে, সস্তা ও অনায়াস বিনোদনের এত মাধ্যম থাকতেও।

বাংলা সাহিত্যের কথা যদি বলি, সীমিত শিক্ষিত পাঠক সত্ত্বেও নিজেদের সমকালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে তিন বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত প্রত্যেকেই পাঠকের কম-বেশি মনোযোগ পেয়েছিলেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা না-ই বললাম, মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট নিয়ে নাড়াচাড়া করলেও শরৎচন্দ্র অপন্যাস নয়, উপন্যাসই লিখেছেন। এখন কথা হলো, সাম্প্রতিক কালে কি তাঁদের পাঠক কমেছে—এ বাংলায়, ও বাংলায়? কিংবা তাঁদের পর উল্লেখযোগ্য অনেকেই যাঁরা এসেছেন, তাঁদের? বাস্তব মোটেও তা বলে না। বরং অনুবাদের নানা প্রকল্পের খবরে এ ধারণাই সায় পাই, পাঠক রয়েছে বাংলাভাষীদের সীমানা ছাড়িয়েও, আর তাদের চাহিদা মেটাতে প্রকাশনা ব্যবসায় পুঁজির লগ্নিও বাড়ছে।

একটা বিষয় অনেকের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় তা হলো, ডিজিটাল এ যুগে মানুষের দৃষ্টি নানামুখী। সে একসঙ্গে অনেক কাজ করতে সক্ষম, আর করেও থাকে। করতে গিয়ে তাকে খোঁজখবর রাখতে হয় পূর্বসূরিদের তুলনায় বহুগুণ বেশি। তার হাতে সময় কম। এর ছাপ তার পড়াশোনায় পড়তে বাধ্য। সে হয়তো ঘরে শুয়ে-বসে বই—তা উপন্যাস-অপন্যাস যা-ই হোক—পড়ার তেমন সময় পায় না। তবে পড়ে সে, ডিজিটাল পড়া। এটা অনেকের দুর্ভাবনার কারণ হতে পারে। পাতা উল্টে পড়ার বদলে ই-রিডিং, বা বই না কিনে আমাজন থেকে সস্তায় কিন্ডেলে ভরে পড়া। এর বড় নজির দুনিয়ার অনেক বড় বড় ঐতিহ্যবাহী বইয়ের দোকান (যেমন—লন্ডনে ফয়লস) বন্ধ হয়ে যাওয়া, শতবর্ষী পত্রিকা (যেমন—নিউজউইক) অনলাইনে চলে যাওয়া।

বলা নিষ্প্রয়োজন, এ নিয়ে দুশ্চিন্তা স্বাভাবিক হলেও প্রযুক্তিকে ঠেকানোর কোনো উপায় উদ্ভাবিত হয়নি। প্রযুক্তি যদি মানুষকে সাহায্য করে, মানুষ গ্রহণ করবেই, নয়তো ছুড়ে ফেলবে। মুদ্রিত বইয়ের বাজার কমার আশঙ্কা মনঃকষ্টের কারণ হলেও বাস্তবে তা ঘটলে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কী! বড় কথা, নতুন প্রজন্ম, যাদের বেড়ে ওঠা ডিজিটাল যুগে, তাদের একটা বড় অংশের পাঠাভ্যাসের সূচনা তো ই-রিডিং দিয়েই। সুতরাং কাগজের বই তাদের টানার কথা নয়। পৃথিবীর অনেকে বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা ই-বুক বের করে আসছে। আর আমাজন তো কিন্ডেলের বাজার বাড়াতে এতই উঠেপড়ে লেগেছে, পাঠক প্রলুব্ধ না হয়ে যাবে কোথায়! প্রায় বিনা মূল্যে বিশ্বসেরা সব ক্ল্যাসিক যেমন দেদার বিলিয়ে যাচ্ছে, তেমনি খ্যাত-অখ্যাত কার না বই আঙুলের এক টোকায় কিন্ডেলে ঢুকে পড়ছে, তা-ও অতি অল্প দামে! এখানে বলতেই হবে, দুষ্প্রাপ্য বই পড়তে কিন্ডেলের জুড়ি নেই। আমার নিজের পেপারহোয়াইট কিন্ডেলে শ তিনেকের ওপর বই রয়েছে, কিন্তু বাধ্য হয়ে যখন খুলি, পড়ার মজাটজা জোটে না। এটা পাঠক হিসেবে আমার ব্যক্তিগত সমস্যা, অন্যের বেলায় তা হয়তো ধর্তব্যের মধ্যে পড়বে না। মূল বিষয়টা এখানে বাণিজ্যিক, কাগজের বই বনাম ই-বুক। সে অন্য প্রসঙ্গ। আজ থেকে তিরিশ-চল্লিশ বছর পর কাগজ-কালি-ছাপাখানা-বইয়ের দোকান—এমনকি লাইব্রেরির মতো সভ্যতার ধারক-বাহকও যদি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, কাগজের বইয়ের অবর্তমানে মানুষ প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পড়ার কাজ কি চালিয়ে যাবে না! উপন্যাস কি তখন পড়বে না! এর চেয়ে বড় কথা, উপন্যাস লেখাও বন্ধ হয়ে যাবে!

উপন্যাস মরে যাচ্ছে, এমনকি চোখের সামনে মরতে দেখছেন বলে উইল সেলফের খেদোক্তির পেছনে, তাঁর মতে অন্য কারণটি হলো, হালকা লেখালেখির তোড়ে সিরিয়াস ও লিটারারি উপন্যাস পাঠকের আনুকূল্য তো পাবেই না, লেখকেরাও সে পথ থেকে ক্রমশ সরে আসবেন বা ইতিমধ্যেই সরে আসতে শুরু করেছেন। মোদ্দা কথা, ভালো উপন্যাস যা পাওয়ার, পাওয়া হয়ে গেছে। আগামী দিনে কদাচিৎ হয়তো লেখা হবে বা একেবারে না হলেও বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। যদি হয়ও, সাধারণের বোধবুদ্ধির বাইরে বিমূর্ত পেইন্টিং বা শাস্ত্রীয় সংগীতের মতো সেটা দূরে দূরেই থাকবে। এর অপর নাম তো মৃত্যুই।

উইল সেলফ তাঁর মতামতে ঝাল ঝেড়েছেন হতাশা থেকে। তিনি পাশ্চাত্যের লেখক, যেখানে উপন্যাসের মৃত্যুসংক্রান্ত পূর্বাভাসের ঘোষণা নতুন নয়। সম্ভবত স্পেনের দার্শনিক ওর্তেগা গ্যাসেট প্রথম উপন্যাসের মৃত্যুপরোয়ানা জারি করেন ১৯২৫ সালে। তিনি প্রধানত উপন্যাসের উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ইউরোপ ও আমেরিকায় এ বিতর্কে যোগ দিয়েছিলেন বেশ কয়েকজন, তাঁদের মধ্যে প্রখ্যাত আমেরিকান লেখক ও ঔপন্যাসিক গোর ভিদালও ছিলেন। সত্তরের দশকে আরেক খ্যাতনামা আমেরিকান টম উলফ, নিজের লেখালেখি, বিশেষত উপন্যাস বিপুল পাঠক সমাদৃত হওয়া সত্ত্বেও মন্তব্য করেছিলেন, নব্য সাংবাদিকতা (নিউ জার্নালিজম) শিগগিরই উপন্যাসের জায়গা দখল করবে। ইতালো কালভিনো সে সময় পাল্টা প্রশ্ন তুলেছিলেন এই বলে, উপন্যাস যে গল্প বলে তা কি অন্য কোনো উপায়ে বলা সম্ভব? আর সালমান রুশদি উপন্যাসের মৃত্যুবিষয়ক সন্দর্ভকে দেখেছেন উন্নত বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী পিছুটান-উদ্ভূত ধারণা হিসেবে।

সে যাক, একটা কথা তো বলাই যায়, উইল সেলফ উপন্যাসের মৃত্যুকে নিশ্চিত ঘোষণা করতে গিয়ে সৃজনশীল লেখকসত্তার অপ্রতিরোধ্য প্রকাশস্পৃহাকে অস্বীকার করেছেন। প্রযুক্তির প্রভাবে বা বিনোদনের ঝলমলে হাতছানিতে তা দমে যাবে, এমন ভাবা মানব অস্তিত্বের সৃষ্টিশীল ভিতকেই নস্যাৎ করার শামিল।