গোয়েন্দা নজরদারিতে রবীন্দ্রনাথ

১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ। ছবি: সংগৃহীত
১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ। ছবি: সংগৃহীত

পুলিশের নথিতে রবীন্দ্রনাথের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে, সরকারের কাছে পাঠানো আইজি পুলিশের এক বিশেষ রিপোর্টে। এতে বলা হয়েছে, ১৮৯৭ সালে ‘কবি-রাজনীতিবিদ’ (Poet-Politician) রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় ‘স্বদেশি ভান্ডার’ নামে এক প্রতিষ্ঠান খোলেন। তাঁর এই কার্যক্রম ছিল অরাজনৈতিক। এরপর থেকে গোয়েন্দাদের বিশেষ শাখার কয়েকটি প্রতিবেদনে রবীন্দ্রনাথকে কবি-রাজনীতিবিদ হিসেবে উল্লেখ করলেও কোনো বিশেষ রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতার উল্লেখ পাওয়া যায় না।

বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের পুলিশ প্রশাসনে দমন-পীড়ন কঠোর হতে লাগল। রবীন্দ্রনাথ কখনোই সন্ত্রাসবাদ ও হিংসাত্মক কার্যক্রম সমর্থন করেননি। শান্তিনিকেতনকেও যথাসম্ভব সক্রিয় রাজনৈতিক কার্যকলাপের বাইরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। তবু বিপ্লবীদের দেশপ্রেম, তাঁদের আত্মত্যাগের প্রতি কবির শ্রদ্ধা ছিল গভীর। বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলনে তাঁর কিছুদিনের সংশ্রব ও সক্রিয় ভূমিকা ছিল, সন্দেহ নেই। কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর থেকে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সব অধিবেশনে তিনি উপস্থিত থেকেছেন। এসবই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে মান্য বলে স্বীকৃত।

সেই উত্থান ও ঝঞ্ঝাবহুল সময়ে নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির সঙ্গে গুপ্ত বিপ্লবী দলের সহিংস সব কর্মসূচির মিল ছিল না ঠিকই। তবু এই দুই বিরুদ্ধ মতাদর্শের দলের মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিল না, এমন সিদ্ধান্তও যথার্থ নয়। সুরেন ব্যানার্জি, বিপিন পাল, চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। রাজনৈতিক গোয়েন্দা পুলিশের মূল্যায়নে তাই অনেক সময় নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ও বিপ্লবী আন্দোলনের পথকে বিশেষ পার্থক্যসহকারে দেখা হতো না। যেকোনো প্রকার ব্রিটিশ বিরোধিতাকে ‘রাজদ্রোহ’ বলে তকমা এঁটে দেওয়া হতো।

গোয়েন্দা বিভাগের কাছে পাঠানো শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থীবেশী চরের প্রতিবদেন। সূত্র: আ ট্রিবিউট টু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গ্লিমপসেস ফ্রম আকাইভাল রেকর্ডস, সম্পাদক: অতীশ দাশগুপ্ত, ডাইরেকটরেট অব স্টেট আর্কাইভস, গভমেন্ট অব ওয়েস্ট বেঙ্গল, কলকাতা, ২০১১
গোয়েন্দা বিভাগের কাছে পাঠানো শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থীবেশী চরের প্রতিবদেন। সূত্র: আ ট্রিবিউট টু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গ্লিমপসেস ফ্রম আকাইভাল রেকর্ডস, সম্পাদক: অতীশ দাশগুপ্ত, ডাইরেকটরেট অব স্টেট আর্কাইভস, গভমেন্ট অব ওয়েস্ট বেঙ্গল, কলকাতা, ২০১১

অরবিন্দের গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কার কথা শুনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘নমস্কার’ কবিতাটি রচনা করে সেটির এক কপি অরবিন্দকে পাঠিয়ে দেন। কবিতাটি ৭ সেপ্টেম্বর ১৯০৭-এর বন্দে মাতরম পত্রিকায় ছাপা হয়। বন্দে মাতরম-এর বিরুদ্ধে মামলায় অরবিন্দ আইনের ফাঁকে মুক্তি পেলেন, কিন্তু বিপিন পাল ছয় মাসের বিনা শ্রমে দণ্ডিত হন। পত্রিকার প্রকাশকের দুই বছরের জেল হয়। রবীন্দ্রনাথের কবিতার সুর এবং তাঁর এহেন মনোভাব ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের যে খুব আশ্বস্ত ও সন্তুষ্ট করেনি, তা সহজেই অনুমেয়।

রবিঠাকুরের উদার মানবতাবাদ ও নিজস্ব শিক্ষাচিন্তা গোয়েন্দাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি। তাঁর প্রতিবাদের ভাষা সব সময় প্রচলিত স্লোগান অথবা আন্দোলনের পথে স্ফুরিত হয়নি। ‘নাইটহুড’ প্রত্যাখানের দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত কিংবা সাহিত্যের রূপকের মধ্য দিয়ে তাঁর আবেগ আরও তীব্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে। কখনো কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরিয়ে দেশবাসীর প্রতি অভিমান জানিয়ে তিনি লিখেছেন:

‘ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে

                    ততই বাঁধন টুটবে

মোদের ততই বাঁধন টুটবে।

ওদের যতই আঁখি রক্ত হবে

                    মোদের আঁখি ফুটবে

ততই মোদের আঁখি ফুটবে।...’ ইত্যাদি।

স্বভাবতই ইংরেজ সরকারের পক্ষে তাঁর কর্মপদ্ধতি পুরোপুরি বুঝে ওঠা হয়নি, ফলে তাদের চোখে তাঁর ক্রিয়াকাণ্ড ক্রমেই ‘সন্দেহজনক’ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের স্পষ্ট প্রকাশ ছিল না।

শান্তিনিকেতনে তাঁর ব্রাহ্মচর্যাশ্রমকে সরকারবিরোধী প্রতিষ্ঠান বলে সন্দেহ করা শুরু হয়। এমনকি গোয়েন্দারা সূক্ষ্মভাবে গুজব ছড়িয়েছিলেন, শান্তিনিকেতন আসলে একটি ‘রিফরমেটরি’। তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ ও আসাম সরকারের এক গোপন প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তানদের পক্ষে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন অবাঞ্ছিত। এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করলে সরকারি কর্মচারীদের সন্তানেরা ভবিষ্যতে সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হতে পারে। পরে অবশ্য এই বিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলীতে বেশ কিছু রদবদল করার কারণে এই প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই যেসব ইউরোপীয় ও অন্য বিদেশি ভারতে ছিলেন, তাঁদের ওপর আইবি, সিআইডি কড়া নজর রেখেছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের পর অনেক মনীষী অধ্যাপক ইউরোপ থেকে শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনা করতে আসেন। রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণেই তাঁরা এসেছিলেন। যুদ্ধের সময় জার্মান ভারতীয় ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধে জার্মানির শত্রুতা এবং যুদ্ধোত্তরকালে বলশেভিক শত্রুতার ফলে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ থেকে আগত ব্যক্তিদের সম্পর্কে ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগ সন্দিহান ছিল। ফলে বিশ্বভারতী ও শান্তিনিকেতনও তাদের নজরদারির মধ্যে চলে এল।

শান্তিনিকেতনের কর্মকাণ্ডের খবর সংগ্রহের জন্য ইংরেজ সরকারের প্রচেষ্টার বিরাম ছিল না। সরাসরি গোয়েন্দা বিভাগের এজেন্টরা শান্তিনিকেতনের ওপর নজর রাখত। শান্তিনিকেতনের ঠিকানায় পাঠানো চিঠি নিয়মিতভাবে সরকারি আদেশে খুলে পড়া শুরু হয়। শান্তিনিকেতন থেকে লেখা চিঠিও এই নজরদারির আওতায় ছিল। এ ছাড়া শান্তিনিকেতনের কিছু ছাত্র বা কর্মীকে চর হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল। অনেক সময়েই রবীন্দ্রনাথের চিঠি যে খুলে পড়া হয়েছে তা কবি বুঝতে পারতেন। একবার দুজন বিদেশিকে লেখা দুটি চিঠি একই খামের মধ্যে কবির কাছে পৌঁছেছিল। ক্ষুব্ধ কবি লিখেছেন: ‘বেশ বুঝা যাইতেছে আমাদের রাজকীয় শনির সন্দেহদৃষ্টি আমার প্রতি তীক্ষ্ণভাবে পড়িতেছে।’ (রবীন্দ্রনাথ, এন্ডরুজ পত্রাবলি, পৃ. ২১২)।

১৯২৫ সালে গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তা তাঁর উপরিওয়ালা ব্রামফিল্ডের কাছে লেখা একটি চিঠি সম্প্রতি উদ্‌ঘাটিত হয়েছে। এই চিঠিতে দেখা যায়, শান্তিনিকেতনের এক ছাত্র সেখানকার অন্যান্য ছাত্র, শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষের আচরণের বিস্তারিত খবর দিয়েছেন। এই ছাত্রটি নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বিশ্বভারতীতে ভর্তি হন এবং এক সপ্তাহ পর বোর্ডিংয়ে তিনজন গুজরাটি ছাত্রের ঘরে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। চিঠিতে আশ্রমের পরিবেশ সম্পর্কে চর-ছাত্রের মন্তব্য: ‘সেখানকার সাধারণ আবহাওয়া এই রূপ যে সকলেই যাচিয়া আলাপ-পরিচয় করে, কিন্তু সহজে ঘনিষ্ঠতায় আসে না।’ এই হাতে লেখা চিঠিতে তৎকালীন ছাত্র পুলিনবিহারী সেন, মনমোহন ঘোষ, কৃষ্ণ আইয়ার এবং বিভিন্ন শিক্ষকের বিস্তারিত পরিচয় আছে, বিশেষত তাঁদের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত প্রেক্ষাপট তুলে ধরার কোনো ঘাটতি ছিল না। পুলিনবিহারীর পিতা ময়মনসিংহের ‘নন কো-অপারেশন’ আন্দোলনের নেতা ছিলেন, মনোমোহন ঘোষের ঘরে বলশেভিক পুস্তক থাকত ইত্যাদি সংবাদের সঙ্গে শান্তিনিকেতনের অন্যান্য শিক্ষকেরও পরিচয় দেওয়া হয়েছে।

আবার মনমোহন ঘোষ সম্পর্কে ওই চরের ভাষ্য, ‘তাহাকে দেখিয়াই আমার কেমন সন্দেহ হইত। সে ছাত্রদের কাহারও সঙ্গে মিলিত না, কেবল অধ্যাপকদের সঙ্গে মিলিত। তাহাও সকলের সঙ্গে নহে। বিশেষ করিয়া জার্মানি অধ্যাপক, চীনা অধ্যাপক ও সংস্কৃত অধ্যাপক বিধু শেখর শাস্ত্রী মহাশয়ের সঙ্গে টলস্টয়, লেনিন ও অন্য রাশিয়ানদের পুস্তকের ইংরেজি অনুবাদে তাহার টেবিল ভরা থাকিত। জার্মান ভাষা সে ভালোরূপে আয়ত্ত করিয়াছে। জার্মানিতে জার্মান প্রফেসরের সঙ্গে সুন্দরভাবে কথা বলিতে পারিত।’ এরপর চিঠিতে মনমোহনের ক্লাস রুটিন দেওয়া হয়েছে। মনমোহনকে লেখা কৃষ্ণ আইয়ারের একটি চিঠি লুকিয়ে পড়ে এই চিঠির কিছু অংশ নকল করে পাঠানো হয়। শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনের কার্যকলাপের বিস্তারিত বিবরণও বাদ পড়েনি এই চরের পাঠানো চিঠিতে।

মনমোহন ঘোষ তাঁকে পুলিশের ইনফরমার বলে সন্দেহ করেছিলেন, কিন্তু পুলিনবিহারী তা মানতে রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ তথাকে ছাত্র হিসেবে স্থায়ীভাবে নিতে অস্বীকার করে।

১৯০৯ সালে বাংলার স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি এক প্রজ্ঞাপন দিয়ে জেলার এসপি ও কলকাতার পুলিশের কমিশনারকে কয়েকজন ‘পাবলিক অ্যান্ড প্রমিনেন্ট পারসন কানেকটেড উইথ পলিটিক্যাল অর্গানাইজেশন’-এর ওপর নজর রাখার নির্দেশ দিলেন। এই তালিকায় সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম ছিল। এই নির্দেশনামার উল্লেখিত ব্যক্তিরা সবাই পুলিশের পরিভাষায় ‘Suspect’ বা সন্দেহভাজন ব্যক্তি। সহজ চলতি কথায় ‘দাগি’—যদিও দাগি বলতে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরই বোঝায়। অমিয় কুমার সামন্ত এই প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘যেহেতু রাজনৈতিক গোয়েন্দাগিরি ও নজরদারি ছিল সদ্য সংগঠিত ব্যবস্থা, তাই অপরাধ ও অপরাধীসংক্রান্ত শব্দগুলিই রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়েছে।’ যদুনাথ সরকার রবীন্দ্রনাথের কাছেই শুনেছিলেন, এক কনস্টেবল থানায় রবীন্দ্রনাথকে ‘দাগি’ হিসেবে উল্লেখ করছে। অপরাধ ক্ষেত্রের শব্দগুলো রাজনৈতিক সন্দেহবানদের ক্ষেত্রে ব্যবহারের ফলে রবিঠাকুরকে ‘দাগি’ ইত্যাদি অবমাননা সহ্য করতে হয়েছিল—ঠাকুর: আ বায়োগ্রাফি গ্রন্থের ২১৯ পৃষ্ঠায় কৃষ্ণ কৃপালিনীও উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ‘Suspect no 11, class B’।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতার মধ্যে রাজদ্রোহের গন্ধ খোঁজ করেছিল গোয়েন্দা বিভাগ ও আইনবিষয়ক দপ্তর। ১৯১২ সালের একটি নথিতে দেখা যায়, গোয়েন্দাকর্তাদের দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের ১২টি গান আপত্তিজনক। একটি গান—‘আমরা গাব মনে বন্দে মাতরম’—রবীন্দ্রনাথের রচিত বলে ধরা হয়। (যদিও গীতবিতান-এ এ রকম কোনো গান নেই)। তিনটি গানে রাজদ্রোহের প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে বলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে আইন বিভাগ। এদের মধ্যে একটি—‘যে তোমারে দূরে রাখি নিত্য ঘৃণা করে, হে মোর স্বদেশ’—কবিতা হিসেবেই পরিচিত। সরকার অবশ্য কবির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক মতামত খতিয়ে দেখতে গোয়েন্দা বিভাগ তাঁর দু-একটি রচনার অনুবাদ করে তাদের সুবিধামতো অর্থ আলাদা করেছে—রবীন্দ্রনাথের ‘সুপ্রভাত’ কবিতাটির কিছু অংশ অনুবাদ করে তাঁকে বিপ্লবীদের সমর্থক প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছিল।

১৯২৫ সালে বুয়েনস এইরেস থেকে রবীন্দ্রনাথের লেখা একটি চিঠির কিছু কবিতাংশ ইংরেজিতে অনুবাদ করে তাঁকে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের কঠোর সমালোচক প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ডেভিড পেট্রি। লাইনগুলো হলো, ‘দেশের খবর পাইনে কিছুই গুজব শুনি নাকি, পুলিশ পাণি পুলিশ হেথায় লাগায় হাঁকাহাঁকি। শুনছি নাকি বাংলাদেশের গান হাসি সব ফেলে, কলুপ দিয়ে করছে আটক আলিপুরের জেলে।’

 চার অধ্যায় উপন্যাসটি বের হওয়ার পর বাংলার গোয়েন্দা বিভাগের ধারণা হলো, এই উপন্যাসটি ‘হ্যাজ এক্সটোল্ড রেভল্যুশনারি কাল্ট ইন বেঙ্গল’—সুতরাং এটি বাজেয়াপ্ত করা উচিত। তবে সরকার বইটি বাজেয়াপ্ত করেনি।

রবীন্দ্রনাথের প্রতি কয়েকজন সন্দেহবাতিক ইংরেজ কর্মকর্তা তাঁকে যারপরনাই হেনস্তা করার চেষ্টা করেছিলেন। এঁদের একজন হলেন ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগের কর্তা চার্লস ক্লিভল্যান্ড, আইসিএস। ১৯১২ সালের ডিসেম্বরে দিল্লিতে ভাইসরয়ের ওপর বোমা নিক্ষেপের কোনো সুরাহা না করতে পারায় তাঁর প্রচণ্ড সমালোচনা হয়েছিল। ফলে এই কর্তাব্যক্তিটি আরও সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠেন। ১৯১৩ সালে ভাইসরয় হার্ডিঞ্জ যখন কবিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডিলিট দিতে চান তখন ক্লিভল্যান্ড আপত্তি তোলেন। কারণ, রবীন্দ্রনাথের আনুগত্যের রেকর্ড সন্তোষজনক নয়। হার্ডিঞ্জ বাংলার গভর্নর কারমাইকেলকে লিখলেন, ‘গোয়েন্দা বিভাগে রবীন্দ্রনাথকে ভালো বা মন্দ যা-ই আখ্যা দিন আমি এর তোয়াক্কা করি না। আমি তাঁকে সাম্মানিক ডিগ্রি দিতে বদ্ধপরিকর।’ রবীন্দ্রনাথকে যথাসময়ে সাম্মানিক ডিগ্রি দেওয়া হয়েছিল।

শুধু সাম্মানিক ডিগ্রিই নয়, রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠান যেন কোনো বিদেশি অনুদান না পায় সে ব্যাপারে গোয়েন্দা বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তা ডেভিড পেট্টিও যথেষ্ট কাঠখড় পুড়িয়েছিলেন। সেই সময় ১৯২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এক নারী শান্তিনিকেতনে ৫০ হাজার ডলার দান করতে চান বলে লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিসে চিঠি লিখে শান্তিনিকেতন বিষয়ে জানতে চান। এরপর শুরু হলো দীর্ঘ চিঠি চালাচালি, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা আর বাংলার রাজনৈতিক গোয়েন্দা দপ্তরের মধ্যে। বাংলার রাজনৈতিক গোয়েন্দাপ্রধান জানালেন, ‘আমাদের হাতে যেসব তথ্য রয়েছে তা থেকে অন্তত এটুকু জানা যায় যে ভারতের বিপ্লবীরা ড. রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর প্রতিষ্ঠানকে বিপ্লবের কাজে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে ড. ঠাকুর এ বিষয়ে কিছু জানেন বলে কিংবা তাঁর প্রতিষ্ঠানের কোনো রকম বিপ্লবী পরিচয় আছে বলে জানা যায়নি।’ এসব মতামত যখন ভাইসরয় লর্ড লিটনের কাছে পেশ করা হলো তখন তিনি স্যার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিষয়ে পুলিশ প্রতিবেদনের ওপরই পুরোপুরি ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে চাইলেন না। তাঁর অভিমত ছিল, বাংলা সরকারের শিক্ষা বিভাগের কাছ থেকে রিপোর্ট নেওয়া হোক। অনুকূল রিপোর্ট দিলেন সেই সময়ের বিখ্যাত ডিপিআই ই. এফ. ওটেন সাহেব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো টাকা শান্তিনিকেতনে আসেনি।

নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথের ওপর নজরদারির ব্যবস্থা শিথিল হতে শুরু করে এবং তারপর একসময় ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “ছোট ইংরেজ ‘রাগ ও আতঙ্কের সময়’ অল্প প্রমাণেই ‘ছায়াকে বন্ধু বলিয়া ঠাহর’ করেন; সকল মানুষকে সন্দেহ করাটাই তাদের ব্যবসা” এবং “অবিশ্বাস করাটাই স্বভাব হইয়া ওঠে।” রবীন্দ্রনাথের উক্তি যে কতখানি সত্য, কবির ওপর ছোট ইংরেজের নজরদারির অনাবশ্যক ব্যবস্থাই তা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট।

>

গোয়েন্দাদের হাস্যকর কাণ্ড

শান্তিনিকেতনের ওপর নজরদারি করতে গিয়ে অনভিজ্ঞ ও অদক্ষ গোয়েন্দারা নানা হাস্যকর কাণ্ড করতেন। রাজলক্ষ্মী দেবী ১৯০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বরে একটি ঘটনার কথা তাঁর এক চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, ‘কাল সকালে হঠাৎ একটা লোক এসে হাজির। বলে কিনা স্কুল দেখবে। প্রথম থেকেই রবীন্দ্রনাথের লোকটার ওপর সন্দেহ হয়েছিল—তিনি কোনো রকমে স্কুলের শিক্ষকদের হাতে দিয়ে নিষ্কৃতি লাভ করলেন—কিন্তু সে কি তা শোনে—ঘুরে ঘুরে ক্রমাগত খবর নিতে লাগল। আমাদের ছেলেরা লাঠি অভ্যাস করে কিনা বন্দুক ধরে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। দুপুরে রবীন্দ্রনাথকেও নানা প্রশ্ন করতে লাগল—তিনি বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য বুঝিয়ে বললেন। কিন্তু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে ছেলেদের লাঠিখেলা শেখানো হচ্ছে কিনা এই জাতীয় অবান্তর প্রশ্ন করতে লাগল। তখন রবীন্দ্রনাথ তাকে পরিষ্কারভাবে বললেন—চলুন, আপনাকে সব ঘর দুয়ার দেখাচ্ছি—কোনো ঘরেই কামান গোলা-বারুদের সন্ধান পাবেন না—তখন লোকটি থতমত খেয়ে ওখান থেকে চলে গেল।’

সূত্র: রবীজীবনী, পঞ্চম খণ্ড