রবীন্দ্র-লেখমালা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৫ বৈশাখ ১২৬৮—২২ শ্রাবণ ১৩৪৮), প্রতিকৃতি: তুলি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৫ বৈশাখ ১২৬৮—২২ শ্রাবণ ১৩৪৮), প্রতিকৃতি: তুলি

সাময়িকপত্রে মুদ্রিত কিন্তু গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনা বিশ্বভারতীর রচনাবলীর ২৯-৩১ খণ্ডে গ্রথিত। অনাথনাথ দাস সম্পাদিত কবিতাসমগ্র-এর ৫ম খণ্ডে অগ্রন্থিত অনেক কবিতা স্থান পেয়েছে। আমাদের ধারণা, রবীন্দ্রনাথের আরও অসংখ্য গদ্য-পদ্য রচনা ও চিঠিপত্র এখনো অগ্রন্থিত। পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রকাশিত শতবার্ষিক সংস্করণ ও পরবর্তী সংস্করণে কিছু লেখা সাময়িকপত্র থেকে গৃহীত।

শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রভবন মহাফেজখানা থেকে এবং অন্যান্য সূত্রে কবির বইয়ে অগ্রন্থিত কিছু রবীন্দ্র-লেখার সন্ধান পেয়েছি।

এক. ফিরোজা বারীকে উপহার দেওয়া একটি অটোগ্রাফ ‘কবিতিকা’,

দুই. একটি গান,

তিন. ব্যাধি ও প্রতিকার পুস্তিকা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত অভিমত,

চার. নাটক ও উপন্যাসের প্রভেদ কী কী? এই প্রশ্নের জবাব,

পাঁচ. তিনটি চিঠি।

ব্যোমকেশ মুস্তফীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি
ব্যোমকেশ মুস্তফীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি

গত সেপ্টেম্বরে শান্তিনিকেতনে ড. শ্যামল চন্দের বাড়িতে রবীন্দ্রসংগীতের গায়িকা চিত্রলেখা চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ হয়। তিনি জানালেন, তাঁর মা চিত্রনিভা চৌধুরী যখন শান্তিনিকেতনে পড়তেন, তখন ফিরোজা বারী হোস্টেলে তাঁর রুমমেট ছিলেন। পরে চিত্রনিভা চারণা করেছেন ফিরোজা ও রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি:

মনে আছে, একবার গ্রীষ্মের ছুটিতে আমার বন্ধু ফিরোজা বারী শান্তিনিকেতন ছেড়ে একেবারে চলে যাচ্ছিল। যাওয়ার শেষ মুহূর্তে ওর মনে হয়েছে—গুরুদেবের হাতের কোনো লেখা তো নেওয়া হলো না? সেদিনই বিকেলে আমি ওকে নিয়ে গুরুদেবের কাছে গেলাম। তখন ফিরোজা গুরুদেবের কাছে দুই লাইন কবিতা প্রার্থনা করল, গুরুদেব শুধু হাসলেন, কিছুই বললেন না। আমাদের মনে বড় আঘাত লাগল। আমরা ক্ষুণ্ন মনে তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ মাঠঘাট ঘুরে, সন্ধ্যার সময় শ্রীসদনে ফিরলাম। এসে যা দেখলাম, বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লাম।

গুরুদেব একজন লোক দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন একখানা নতুন চয়নিকা বই, ফিরোজার জন্য। তার প্রথম পৃষ্ঠায় দুই লাইন কবিতা লিখে—

হও তুমি সবাকার প্রিয়

মাধুর্যে সংসার তব কর রমণীয়।।

(চিত্রনিভা চৌধুরী, রবীন্দ্রস্মৃতি, বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ২০১৭। বইটি রাজ্য চারুকলা পর্ষদ, কলকাতা থেকে ২০১৫-তে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল স্মৃতিকথা নামে। এই কবিতিকা স্ফুলিঙ্গ বইতে অগ্রন্থিত।

ব্যাধি ও প্রতিকার পুস্তিকা সম্পর্কে প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত অভিমত
ব্যাধি ও প্রতিকার পুস্তিকা সম্পর্কে প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত অভিমত

ফিরোজা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে রেলওয়ে বোর্ডের ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান—মালিক আবদুল বারীর (এম এ বারী) স্ত্রী। বারী সাহেবের বড় ভাই (পরে ডা.) এম এ মালেক (পূর্ব পাকিস্তানের শেষ গভর্নর, ১৯৭১) ও তিনি শান্তিনিকেতনের ছাত্র ছিলেন। বিয়ের পর বারী সাহেব তাঁর সদ্যপরিণীতা স্ত্রী ফিরোজাকেও শান্তিনিকেতনে পাঠিয়েছিলেন পড়াশোনার জন্য। বারী সাহেব ১৯৬১ সালে চট্টগ্রামে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন কমিটির সভাপতি ছিলেন। ফিরোজা বারী ছিলেন কমিটির অন্যতম সদস্য।

ফিরোজা সমাজসেবী ছিলেন; পূর্ব পাকিস্তান শিশুকল্যাণ পরিষদের সভানেত্রী ও নানা সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা। তাঁর কন্যা ফরিদা বারী মালিক বীথিও শান্তিনিকেতনের ছাত্রী ও রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পী ছিলেন।

দুই.

দেবকণ্ঠ বাগচীর সুরের রূপ (১৯৩২) সংকলনে গৃহীত এই গানের সন্ধান দিয়েছেন সর্বানন্দ চৌধুরী (উদ্ধৃত, গীতবিতান-এ অসংগৃহীত গান? পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পত্রিকা—১২, পৃ. ১২৫-১৩৬, মে ২০০৭)

(মিশ্র ইমন—একতালা)

 আজি তোমারি আলো আমার

        সান্ধ্য আঁধার ভবনে।

তোমার শান্তি গগন ভরিয়া,

        তোমার কান্তি ভুবনে।

তোমার সোহাগ-পরশ যেন গো

        নব বসন্ত-পবনে।

তোমার স্নেহ, তোমার স্মৃতি

        আমার সফল জীবনে।।

সুরের রূপ সংকলনে গানটির স্বরলিপি মুদ্রিত।

তিন.

‘হিন্দু-মুসলমানের বিচ্ছেদ সম্বন্ধে’ রবীন্দ্রনাথের ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’ প্রবাসী, (শ্রাবণ ১৩১৪) প্রবন্ধে উত্থাপিত প্রসঙ্গ এক বছর আগেই আলোচনা করেছেন দেবকুমার রায়চৌধুরী (১৮৮৬-১৯২৯) তাঁর একই শিরোনামের বরিশাল আদর্শ যন্ত্রে ছাপা একটি পুস্তিকায় (জ্যৈষ্ঠ ১৩১৩)। কবির প্রবন্ধটি সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রবাসীতে (আশ্বিন ১৩১৪) একটি সুদীর্ঘ আলোচনা লেখেন।

ওই পুস্তিকা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের অভিমত প্রকাশ পেয়েছে প্রবাসীতে (আশ্বিন ১৩১৪, পৃ. ৩৪৭):

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

‘ব্যাধি ও প্রতিকার’

শ্রীযুক্ত দেবকুমার রায় চৌধুরী ১৩১৩ সালের জ্যৈষ্ঠমাসে “ব্যাধি ও প্রতিকার” নামক একখানি পুস্তিকা রচনা করিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। অদ্য তাহা পাঠ করিয়া আমি আনন্দের সহিত স্বীকার করিতেছি যে গত শ্রাবণ মাসের “প্রবাসী” পত্রে আমার “ব্যাধি ও প্রতিকার” প্রবন্ধে আমি হিন্দুমুসলমানের বিচ্ছেদ সম্বন্ধে যে প্রসঙ্গ উত্তাপন করিয়াছি শ্রীযুক্ত দেবকুমারের গ্রন্থে তাহা সুন্দররূপে আলোচিত হইয়াছে। অথচ সে সময়ে হিন্দুমুসলমানের সংঘর্ষ উৎকট হইয়া উঠে নাই। গ্রন্থকার এই গ্রন্থে নিপুণভাবে ও সরল ভাষায় ভারতবর্ষের বর্ত্তমান অবস্থার বিচার করিয়া যে প্রাজ্ঞতা প্রকাশ করিয়াছেন, তাহাতে দেশের প্রধানগণের নিকট হইতে তিনি সাধুবাদ লাভ করিয়াছেন;—তাঁহার প্রতি আমার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করিয়া পাঠকগণকে এই গ্রন্থ পাঠ করিতে অনুরোধ করি।

২১শে শ্রাবণ, ১৩১৪।

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

জীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল রবিজীবনীর ৫ম খণ্ডে (১৩৯৭, পৃ.৩৭৩) কবির এই মন্তব্যের দুটি বাক্য উদ্ধৃত করেছেন।

চার.

প্রবাসী পত্রিকার ‘বেতালের বৈঠক’ বিভাগে চিকিৎসা, আইন, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, শিল্প, বাণিজ্য প্রভৃতি বিষয়ে প্রশ্ন ও উত্তর ছাপা হতো। কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক জিজ্ঞাসা করেছিলেন: নাটক ও উপন্যাসের মধ্যে প্রভেদ কী কী? (প্রবাসী, ভাদ্র ১৩২৭) পরের মাসে আশ্বিন সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের ‘মীমাংসা’ প্রকাশ পায়: ৪২ বছর পর দেশ পত্রিকায় (বর্ষ-২৯, সংখ্যা-২৭, ৫ মে ১৯৬২) পুনমুর্দ্রিত হয়েছিল:

শৈলেন ঘোষকে লেখা এবং ‘সাধনার রূপ’ শিরোনামে প্রবাসীতে ছাপা হওয়া রবি ঠাকুরের চিঠি; এটি পরে দেশ-এর রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষপূর্তি সংখ্যাতেও সংকলিত হয়
শৈলেন ঘোষকে লেখা এবং ‘সাধনার রূপ’ শিরোনামে প্রবাসীতে ছাপা হওয়া রবি ঠাকুরের চিঠি; এটি পরে দেশ-এর রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষপূর্তি সংখ্যাতেও সংকলিত হয়

নাটক ও উপন্যাসে প্রভেদ কি কি?

নাটক ও নভেলের প্রভেদটা কি তাহা সংক্ষেপে বুঝিতে হইলে এই কথাটি মনে রাখা দরকার, চোখে দেখিয়া নাটক বুঝি, আর ঘরে বসিয়া নভেল পড়ি। সংসারের নাট্যলীলা প্রত্যহই আমরা চোখে দেখিয়া কানে শুনিয়া প্রত্যক্ষ অনুসরণ করি। নাটক তাহারই প্রতিরূপ। কিন্তু সংসার-রঙ্গভূমি দেশে কালে পাত্রে অতি বিস্তীর্ণ, সেখানে নাট্যের ঐক্যসূত্র নানা জটিলতা ও বহুলতার ভিতর দিয়া স্পষ্ট করিয়া ধরিতে পারি না। তাই সাহিত্য-নাটকে একটি ঘটনা-পর্যায়কে বিবিক্ত করিয়া লইয়া তাহারই নিবিড় বিকাশের মধ্য দিয়া রসের পরিণতিতে অবিচ্ছেদে দেখাইতে হয়। নভেলে নানা বর্ণনা, চিত্তবৃত্তির সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ, বাহুল্য ঘটনাবলীর সমাবেশ চলে—যাহা চোখে দেখা যায় না, তাহার আলোচনা থাকে, অর্থাৎ গ্রন্থকার গাইডের মত সঙ্গে থাকিয়া যাহা অগোচর, যাহা অতীত, যাহা অনুমানমাত্র, সমস্তই ব্যাখ্যাত ও বিবৃত করিয়া চলেন। নাটকে তাহার জো নাই। ঘটনার পর ঘটনা আপন প্রত্যক্ষতার দ্বারাই বিনা ব্যাখ্যায় আপন অপ্রত্যক্ষকেও অনুভবগম্য করিয়া চলে। এইজন্য নাটকের ঘটনা সংস্থানে ওস্তাদি থাকা চাই। একটার পাশে আর-একটাকে রাখিয়া নিষ্কৃতি নাই; একটার সঙ্গে আর একটাকে একেবারে প্রাণগত বন্ধনে এমন বাঁধিয়া দিতে হইবে যে সমস্ত নাটকের ঘটনা অবিচ্ছিন্ন ও অবিচ্ছেদ্য সজীব দেহরূপে আপন আত্মাকে অখণ্ডভাবে প্রকাশ করিতে পারে। এই কথাটি মনে রাখা চাই—নাটক দৃশ্যকাব্য; যাহা দেখা যায় সেই উপকরণ লইয়াই যাহা দেখা যায় না সেই ভাবরসকে নাটকে অভিব্যক্ত করিতে হইবে; অতএব তাহা স্বভাবতই অন্যজাতীয় সাহিত্যের পথে চলে না, তাহার নিজেরই স্বতন্ত্র পথ আছে। এসব কথা বেশি করিয়া বলিবার সময় নাই, অল্প করিয়া বলাও সহজ নয়।

 —শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পাঁচ.

শৈলেন ঘোষ, ব্যোমকেশ মুস্তফী ও হরপ্রসাদ মিত্রকে লেখা পত্রত্রয়ের মধ্যে ১৯৩১ সালের ১১ মার্চ চিঠিটি প্রথমে প্রবাসীতে (ভাদ্র ১৩৩৮) এবং পরে দেশ-এর রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষপূর্তি সংখ্যায় (১৩৬৯) ‘সাধনার রূপ’ নামে সংকলিত হয়। দেশ সম্পাদক কবির ‘আত্মপরিচয়’ (১৩৩৮) রচনাটির সঙ্গে এই পত্রের ভাবসাদৃশ্য লক্ষ করেছেন।

ওঁ

শান্তিনিকেতন

কল্যাণীয়েষু

সুনীতি তোমার সম্বন্ধে আমার কাছে আভাসমাত্র দিয়েছিলেন আরো স্পষ্টতর করে জানলে তোমার সঙ্গে আলাপ করবার চেষ্টা করতুম। আমার আশঙ্কা হয় পাছে আমাকে কেউ ভ্রমক্রমে গুরু বলে গ্রহণ করেন—আমার সে পদ নয়। সুনীতির কাছে আমি যে সঙ্কোচ জানিয়েছিলুম তার কারণই এই। তুমি যে সাধনার কথা লিখেচ আমি তাকে শ্রদ্ধা করি। সেই সঙ্গে আমার একটি কথা বলবার আছে এই যে, অন্তরের সাধনার পরিণতি বাইরে—সঞ্চয়ের সার্থকতা দানে। একদিন আমি নিজের আত্মিক নির্জনতার মধ্যে আধ্যাত্মিক উপলব্ধির আনন্দকে সংহতভাবে লাভ করবার জন্যে সাধনায় প্রবৃত্ত ছিলুম। যে কারণেই হোক সেই নিঃসঙ্গতা থেকে আমি বেরিয়ে এসেছি। অতিশয় একান্তভাবে নিজের সত্তার নিগূঢ় মূলে নিবিষ্ট হয়ে যাওয়া আমার চল্ল না, যে বিচিত্র সংসারে আমি এসেচি আপনাকে ভুলে সহজভাবে সেখানে আপনাকে লাভ করতে হবে এই দিকেই আমাকে ভিতর দিক থেকে ঠেলে পাঠালে। আমি স্বভাবতই সর্বাস্তি [?] বাদী—অর্থাৎ আমাকে ডাকে সকলে মিলে—আমি সমগ্রকেই মানি। গাছ যেমন আকাশের আলো থেকে আরম্ভ করে মাটির তলা পর্যন্ত সমস্ত কিছু থেকে ঋতু পর্য্যায়ের বিচিত্র প্রেরণ দ্বারা রস ও তেজ গ্রহণ করে তবেই সফল হয়ে ওঠে—আমি মনে করি আমারও ধর্ম্ম তেমনি—সমস্তর মধ্যে সহজে সঞ্চরণ করে সমস্তর ভিতর থেকে আমার আত্মা সত্যের স্পর্শ লাভ করে সার্থক হতে পারবে। এই যে বিচিত্ররূপী সমগ্র এর সঙ্গে ব্যবহার রক্ষা করতে হলে একটি ছন্দ রেখে চলতে হয়, একটি সুষমা,—যদি তাল কেটে যায় তবেই সমগ্রকে আঘাত করি এবং তার থেকে দুঃখ পাই। বস্তুত যখনি কিছুতে উত্তেজনার উগ্রতা আনে []েথকে এই বুঝি, ছন্দ রাখতে পারলুম না; তাই সহজ সমগ্রর সঙ্গে যোগসূত্রে জটা পড়ে গেল। তখন নিজেকে স্তব্দ করে জটা খোলবার সময় আসে। এমন প্রায়ই ঘট্‌তে থাকে সন্দেহ নেই কিন্তু তাই বলে জীবনের সঙ্গে সাধনার প্রশস্ত ক্ষেত্রকে সঙ্কীর্ণ করে নিজেকে নিরাপদ করা আমার দ্বারা ঘটল না। বিশ্বে সত্যের যে বিরাট বৈচিত্র্যের মধ্যে আমরা স্থান পেয়েছি তাকে কোনো আড়াল তুলে খণ্ডিত করলে আত্মাকে বঞ্চিত করা হবে এই আমার বিশ্বাস। যদি এই বিরাট সমগ্রের মধ্যে সহজ বিহার রক্ষা করে চল্‌তে পারি তবে নিজের অগোচরে স্বতই পরিণতির পথে এগোতে পারব—ফল যেমন রৌদ্রে বৃষ্টিতে হাওয়ায় আপনিই তার বীজকে পরিণত করে তোলে। আমি তাই নানা কিছুকেই নিয়ে আছি—নানাভাবেই নানা দিকেই নিজেকে প্রকাশ করতে আমার উৎসুক্য। বাইরে থেকে লোকে মনে ভাবে তাদের মধ্যে অসঙ্গতি আছে, আমি তা অনুভব করিনে। আমি নাচি গাই লিখি আঁকি ছেলে পড়াই—গাছপালা আকাশ আলোক জলস্থল থেকে আনন্দ কুড়িয়ে বেড়াই। কঠিন বাধা আসে লোকালয় থেকে—এত জটিলতা এত বিরোধ বিশ্বে আর কোথাও নেই। সেই বিরোধ কাটিয়ে উঠ্‌তে হবে, জীবনের শেষ দিন পর্য্যন্ত আমার এই চেষ্টার অবসান হবে না। আমার নিজের ভিতর থেকে আশ্রমে যদি কোনো আদর্শ কিছুমাত্র জেগে থাকে তবে সে আদর্শ বিশ্বসত্যের অবারিত বৈচিত্র্য নিয়ে। এই কারণেই কোনো একটা সঙ্কীর্ণ ফল হাতে হাতে দেখিয়ে লোকের মন ভোলাতে পারব না—এই কারণেই লোকের আনুকূল্য এতই দুর্লভ হয়েচে এবং এই কারণেই আমার পথ এত বাধাসঙ্কুল। একদিকে পণ্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী থেকে আরম্ভ করে সুরুলের দরিদ্র চাষী পর্য্যন্ত সকলেরই জন্যে আমাদের সাধনক্ষেত্র স্থান করে দিতে হয়েছে—সকলেই যদি আপনাকে প্রকাশ করতে পায় তবেই এই আশ্রমের প্রকাশ সম্পূর্ণ হতে পারবে—তিব্বতী লামা এবং নাচের শিক্ষক, কাউকে বাদ দিতে পারলুম না।

‘আজি তোমারি আলো আমার সান্ধ্য আঁধার ভবনে’ গানটির স্বরলিপি; পশ্চিমবঙ্গ বাঙলা আকাদেমি পত্রিকায় পুনর্মুদ্রিত
‘আজি তোমারি আলো আমার সান্ধ্য আঁধার ভবনে’ গানটির স্বরলিপি; পশ্চিমবঙ্গ বাঙলা আকাদেমি পত্রিকায় পুনর্মুদ্রিত

মনে কোরো না যে তোমার সাধন প্রণালী ও সাধন ফলের প্রতি আমার কিছুমাত্র সংশয় আছে। তোমার প্রকৃতি নিজের পথ যদি খুঁজে পেয়ে থাকে তবে আমার পন্থা তার প্রতিবাদ করবে এমন স্পর্ধা তার নেই। সত্যকে তুমি যেভাবে যে রসে পাচ্ছ আমার প্রকৃতিতে যদি তা সম্ভব না হয় তবে সে জন্য পরিতাপ করা মূঢ়তা। ফলের গাছ তার রসের সার্থকতা প্রকাশ করে আপন ফলে, ইক্ষু করে আপন দণ্ডের মধ্যে—কেউ কারো প্রতিযোগী নয়, বৃহৎ ক্ষেত্রে এক জায়গায় উভয়েই মিলে যায়।

আশ্রমে তুমি কোনো কর্ম্মের উপলক্ষ পেলে খুশি হও লিখেচ। এ সম্বন্ধে তোমার সঙ্গে আলোচনার অবকাশ হয়নি। শীঘ্র কর্ম্ম উপলক্ষ্যে কলকাতায় যেতে হবে তখন কথাবার্তা হতে পারবে। ইতি ১১ মার্চ ১৯৩১

 শুভাকাঙ্ক্ষী

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ব্যোমকেশ মুস্তফীকে (১৮৬৮-১৯১৬) ১৩৭/১ কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট, শ্যামপুকুর, কলকাতা ঠিকানায় প্রেরিত, [পোস্ট মার্ক ১৯০৫-এর ৭ই মার্চ] জবাবি [রিপ্লাই] পোস্ট কার্ডটি বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবন মহাফেজখানায় সংরক্ষিত। তারিখবিহীন দুই অনুচ্ছেদের সংক্ষিপ্ত চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:

ওঁ

কল্যাণীয়েষু

মিনার্ভার চেয়ে কার্জ্জনে বেশি জায়গা আছে। আমার প্রবন্ধটির নাম “সফলতার সদুপায়”। সভাপতি মেজদা হইলে কোনোমতেই চলিবে না। বরং নাটোরের মহারাজা ভাল। নতুবা হীরেন্দ্রবাবু বা ত্রিবেদী মহাশয় বা দীনেশ বাবুকে ধরিবে—আত্মীয়ের মধ্যে কাহাকেও নয়। গুরুদাস বাবুকে উপস্থিত থাকা চাই। ভিড় সামলাইবার একটা সুব্যবস্থা করিয়ো।

রবিবার রাত্রে তোমার উত্তর দিতে না পারিয়া দুঃখিত হইলাম—সোমবার প্রাতে তোমার পত্র পাইয়াছি।

ইতি সোমবার

 শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পুঃ পর্শু বুধবারে সকালের গাড়িতে কলিকাতায় যাইব।

জীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল এই চিঠির দুটি লাইন রবিজীবনীতে (৫ম) উদ্ধৃত করেছেন। সম্প্রতি এই পত্রের পাণ্ডুলিপিচিত্র চট্টগ্রামের সুপ্রভাত বাংলাদেশ-এ মুদ্রিত হয়েছে।

চিঠির প্রাপক ব্যোমকেশ মুস্তফী উনিশ শতকের প্রখ্যাত অভিনেতা অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফীর পুত্র। তিনি প্রথম আঞ্চলিক শব্দ সংগ্রহ করেন এবং অন্যদের উৎসাহী করেন। বিশ্বকোষ সম্পাদনায় ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

চিঠির উল্লিখিত মেজদা—সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতের প্রথম সিভিলিয়ান, ১৮৬৪ সালে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে (আইসিএস) যোগ দেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি, ব্রাহ্মসমাজের আচার্য ও হিন্দু মেলার প্রবর্তক। ১২টি বইয়ের ও ব্রহ্মসংগীতের রচয়িতা। ‘সফলতার সদুপায়’ প্রবন্ধ বঙ্গদর্শনে, (চৈত্র ১৩১১) প্রথম প্রকাশ পায় [পরে আত্মশক্তি (১৩১২) বইয়ে সংকলিত]।

নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় (১৮৬৮-১৯২৬) প্রথমে মানসী ১৯০৮ এবং পরে মানসী ও মর্ম্মবাণী (১৯১৪) সম্পাদনা করেন। রবীন্দ্রনাথের অন্তরঙ্গ বন্ধু ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহসভাপতি ছিলেন।

প্রবাসী পত্রিকার প্রচ্ছদ
প্রবাসী পত্রিকার প্রচ্ছদ

হীরেন্দ্রবাবু—হীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৬৮-১৯৪২) ছিলেন দার্শনিক পণ্ডিত। হিন্দু মহাসভার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর পুত্র।

ত্রিবেদী মহাশয়—রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী (১৮৬৪-১৯১৯), বাংলায় বিজ্ঞান রচনার পথিকৃৎ, রিপন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন।

দীনেশবাবু—দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯)—কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক (১৮৯১) ও পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রধান হন।

গুরুদাসবাবু—স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৪৪-১৯১৮)—ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি প্রথম ভারতীয় উপাচার্য (১৮৯০) ছিলেন।

২৭ ফাল্গুন ১৩১১ তারিখে স্কটিশচার্চ কলেজের জেনারেল অ্যাসেমব্লি হলে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর সভাপতিত্বে রবীন্দ্রনাথ ‘সফলতার সদুপায়’ প্রবন্ধ পাঠ করেন।

কবির মৃত্যুর মাস দুয়েক আগে ১৯৪১-এর ১৯ জুন শান্তিনিকেতন থেকে ৪৫ বরদা দে স্ট্রিট, শ্রীরামপুর ঠিকানায় লেখা চিঠিটি হরপ্রসাদ মিত্রের ‘গল্পগুচ্ছের রবীন্দ্রনাথ’ (পরিচয়, রবীন্দ্রসংখ্যা, জ্যৈষ্ঠ ১৩৫০) প্রবন্ধ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ সমালোচকের প্রশংসা করেন।

কুমুদরঞ্জন মল্লিক: রবীন্দ্রনাথকে তিনিই জিজ্ঞেস করেছিলেন, উপন্যাস ও নাটকের প্রভেদ কী
কুমুদরঞ্জন মল্লিক: রবীন্দ্রনাথকে তিনিই জিজ্ঞেস করেছিলেন, উপন্যাস ও নাটকের প্রভেদ কী

হরপ্রসাদ মিত্র কবির উল্লিখিত প্রবন্ধের উপসংহারে মন্তব্য করেছিলেন:

রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছে আমি দেখলাম পরিপূর্ণ একটি পৃথিবী হাসিতে-কান্নায়, শোকে আনন্দে, কথায় নীরবতায়, ত্যাগে স্বার্থপরতায়, মৃত্যুতে-অমরতায় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কতকগুলো মানুষ, তাদের চারিদিকে দিন-রাত্রির সনাতন লীলা। তাদের মাথার উপর অনন্ত, আকাশের নীল, সেখানে কিছুই দেখা যায় না; শুধু অদৃশ্য এক বিধানের অক্লান্ত হাত নিরন্তর তাদের জীবনের পট পরিবর্তন করে, সেই হাত ঋজু আর বলিষ্ঠ, সেই বিধাতা রসিক এবং নির্মম।

এই প্রবন্ধ হরপ্রসাদের মৃত্যুর (১৫ আগস্ট ১৯৯৪) পর কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রবীন্দ্র-ভাবনা পত্রিকায় পুনর্মুদ্রিত হয় (অক্টোবর-ডিসেম্বর ১৯৯৪)।

হরপ্রসাদ মিত্র স্কটিশ চার্চ ও প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষকতা করে পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অধ্যাপক পদে ব্রত হন। তাঁর সমালোচনা গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: কবিতার বিচিত্র কথা, রবীন্দ্রসাহিত্য পাঠ, তারাশঙ্কর, সত্যেন্দ্রনাথের কবিতা ও কাব্যরূপ, বঙ্কিমসাহিত্য পাঠ, সাহিত্য পাঠকের ডায়েরি ইত্যাদি। তিনি ১৪টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন (১৯৩৩-৯২)।

ফিরোজা বারী: রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লিখে দিয়েছিলেন দু–লাইনের একটি অটোগ্রাফ ‘কবিতিকা’
ফিরোজা বারী: রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লিখে দিয়েছিলেন দু–লাইনের একটি অটোগ্রাফ ‘কবিতিকা’

পরিচয় পত্রিকায় ‘গল্পগুচ্ছের রবীন্দ্রনাথ’ পাঠ করে কবি শান্তিনিকেতন থেকে ১৯৪১-এর ১৯ জুন শ্রীরামপুর, ৪৫ বরদা স্ট্রিটের ঠিকানায় এই চিঠি লেখেন। সদ্য এমএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হরপ্রসাদের বয়স তখন মাত্র চব্বিশ বছর। কবির চিঠির পাঠ:

 উদয়ন ১৯/৬/ ৪১.

কল্যাণীয়েষু,

পরিচয়ে ‘গল্পগুচ্ছ’ সম্বন্ধে তুমি যে আলোচনা করেছ, সে আমার কাছে অত্যন্ত আনন্দজনক হয়েছে। নিজের রচনার প্রশস্তি এই আনন্দের একমাত্র কারণ নয়। ছোটগুল্পগুলি আমার অন্যান্য নানা রচনার অপেক্ষা অনেক বেশি প্রিয়। তরুণ বয়সে পল্লীভ্রমণকালে আমি বাংলাদেশের হৃদয় থেকে যে মধু সংগ্রহ করেছি ও ভোগ করেছি তাহা আমার চিরস্মরণীয়। অথচ আমার গল্পে পল্লীজীবনের এই সৌন্দর্য জানি না কি কারণে বাঙালী পাঠকের কাছে যথোচিত সমাদর পায়নি। মনে আছে Thompson আমাকে বলেছিলেন এই গল্পগুলি মোপাসা প্রভৃতি ফরাসী গল্পলেখকের সঙ্গে গৌরবে সমপর্যায়ভুক্ত। আমার এই প্রিয়গল্পগুলি এতদিন পরে তোমার লেখনী থেকে প্রচুর সম্মান পেয়েছে দেখে আমি যেন অপ্রত্যাশিতভাবে পরিতৃপ্তিলাভ করেছি। এবং সেজন্য মনে মনে তোমাকে কৃতজ্ঞতা অর্পণ করেছি।

তোমার যে বইগুলি আমাকে পাঠাবে লিখেছ সে আমি সযত্নে পাঠ করব যদিচ আমার দৃষ্টি এখন ক্ষীণ এবং আমার মন এখন যথোচিত সজীব নয়। সেইজন্য ইচ্ছা করলেও সাহিত্য রসভোগে আমি এখন প্রায় বঞ্চিত থাকি। ইতি

 শুভার্থী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় তাঁর বানানরীতি অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে।

স্বীকৃতি: সর্বানন্দ চৌধুরী, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সংগ্রহ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার; রবীন্দ্রভবন; শ্রীমতী পিয়ালী চন্দ; মাইনুল হাসান চৌধুরী, আখতার হোসেন খান ও ফখরুল আলম।