কাঠগড়ায় রবীন্দ্রনাথ

৪ আগস্ট ২০১৭ তারিখে প্রথম আলোর ‘শিল্পসাহিত্য’ পাতায় মাহবুব আলম ‘গোয়েন্দা নজরদারিতে রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামে একটি চমৎকার নিবন্ধ লিখেছেন। লেখাটি তথ্যবহুল এবং সুলিখিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর যাপিত জীবনের একটি দীর্ঘ সময় ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতে ছিলেন, সে বিষয়ে লেখক যথার্থ তথ্য-উপাত্ত দিয়েছেন। আমার এই প্রতিক্রিয়ার উদ্দেশ্যও এক—মাহবুব আলমের লেখার সঙ্গে এ-বিষয়ক আরও কিছু তথ্য যোগ করা।
রবীন্দ্রনাথকে গোয়েন্দারা ‘দাগি’ বলে শুধু তাঁদের নথিপত্রে উল্লেখ করেননি, দিলীপ মজুমদারের বন্দীহত্যা বন্দীমুক্তি ও রবীন্দ্রনাথ বইয়ের ভূমিকায় প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘শুনেছি কলকাতায় থাকাকালীন কবি যখন ঘোড়ার গাড়িতে চেপে রাস্তা দিয়ে যেতেন সেই সময় জোড়াসাঁকো থানা থেকে পুলিশ হেঁকে জানিয়ে দিত অমুক নম্বর আসামী যাচ্ছে।’
লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস থেকে জনৈক মি. ফ্লেচার শান্তিনিকেতনের রাজনৈতিক চরিত্র এবং সরকারের প্রতি আনুগত্য ইত্যাদি সম্পর্কে পরপর দুটি চিঠিতে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের (রাজনৈতিক) কাছে বিস্তারিত খবর পাঠানোর অনুরোধ জানান। তার পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ ও বিশ্বভারতীর রাজনৈতিক চরিত্র ও কার্যকলাপ সম্পর্কে ডিআইবির যে প্রতিবেদন পাওয়া যায়, তা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। সেখানে লেখা হয়েছে, ‘বোলপুর আশ্রম সম্বন্ধে নথিভুক্ত তথ্যের পরিমাণ সামান্যই। বাংলাদেশ ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ কখনো এর সম্পর্কে বেশি তথ্যাদি সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়নি। কেননা পুলিশের কর্মকর্তারা শান্তিনিকেতনের কাছেপিঠে গেলেই মহামান্য গভর্নর বাহাদুরের কাছে পুলিশি হস্তক্ষেপের প্রভূত অভিযোগ আসে। পক্ষান্তরে এর প্রতিষ্ঠাতা ড. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর কর্মচারী ও সহযোগীদের সম্পর্কে বেশ কিছু সুনিশ্চিত খবর আছে, আর তার মধ্যে কিছু খবর এতই সুনির্দিষ্ট ধরনের যে, এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক পরিমণ্ডল সম্পর্কে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে।’
শুধু রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর এদেশীয় বন্ধু-সহযোগী শান্তিনিকেতনের শিক্ষকেরা নন, কবির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বিদেশি ব্যক্তিরা গোয়েন্দাদের সন্দেহভাজনের তালিকায় ছিলেন। এর মধ্যে অ্যান্ড্রুজ, পিয়ারসন, সিলভ্যাঁ লেভি, স্টেন কোনো, বেনোয়া, বার্নাড বে উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে পুলিশের কৌতূহল কতটা হাস্যকর রূপ নিয়েছিল, সে বিষয়ে তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন মাহবুব আলম। তবে বীরভূম জেলার বোলপুর থানার ভিলেজ ক্রাইম নোটবুকের তৃতীয় অংশে পুলিশ যে বিবরণ দিয়েছে তা তুলনাহীন, ‘কে এই আলখাল্লাপরা, দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ ভদ্রলোক, যিনি শান্তিনিকেতনে প্রতিদিন পায়চারি করেন? গোয়েন্দারা ছুটলেন, গোপন রিপোর্ট দিলেন ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ভদ্রলোক ধর্মপ্রাণ মুসলমান। কিন্তু পুলিশের বড় কর্তারা এতেও সন্তুষ্ট নন। ফলে জোর তদন্ত শুরু হলো। এবার গোপন রিপোর্ট এল, ভদ্রলোক একজন কবি। বীরভূমের এসপি তখন ইংরেজ সাহেব। ওপরওয়ালা তাঁকে এ ব্যাপারে আরও জোর তদন্তের নির্দেশ দিলেন। সুপার নিজে তদন্ত করে গোপন রিপোর্ট দিলেন, ‘শুনেছি তিনি একজন কবি, নাম রবীন্দ্রনাথ। নামডাকও আছে। তবে তিনি পুলিশের সঙ্গে বড় দুর্ব্যবহার করেন।’
মুক্তির অধিকার বইয়ে শ্রীমতী মৈত্রেয়ী বসু গিরিডিতে ছুটি কাটানোর প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘রবীন্দ্র-সাহিত্যের সমঝদার লেখক শ্রী অজিত চক্রবর্তী একবার কবিগুরুর “প্রায়শ্চিত্ত” পরিবেশন করলেন। সমস্ত বারগণ্ডা রিহার্সাল দেখতেই মেতে উঠল। হঠাৎ পুলিশের নজর পড়ল। তারা দেখেশুনে বলল আর তো সব হলো, কিন্তু ঐ গানটি যেটায় আছে “আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে” ঐটি বাদ দিতে হবে। ওটি রাজদ্রোহী গান। তাই হল। “আগুন আমার ভাই, আমি তোমারি জয় গাই” গানটি কোনোরকমে বেঁচে গেল।’
১৯০৮ সালে খুলনার সেনহাটী জাতীয় বিদ্যালয়ের (বর্তমান দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটী গ্রাম) শিক্ষক হীরালাল সেন হুঙ্কার নামে একটি কবিতার বই প্রকাশ করেন। রাজদ্রোহের বিবেচনায় ওই বই বাজেয়াপ্ত করে হীরালালের বিরুদ্ধে মামলা করে ব্রিটিশ সরকার। বইটি রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। এই সূত্রে ১৯০৮ সালে খুলনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে সমন পেয়ে সরকার পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য কবিকে শেষ পর্যন্ত খুলনা আদালতের সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় (সূত্র: রবিজীবনী, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫)। এ প্রসঙ্গে কালিপদ রায় একটি লেখা ‘খুলনার ফৌজদারি আদালতে একটি স্বদেশি মামলায় ভারত সরকারের পক্ষে সাক্ষী রবীন্দ্রনাথ’ বীরভূমের লালমাটি পত্রিকায় (পৌষ ১৩৮৫) প্রকাশ করেছিলেন।
৪ ডিসেম্বর খুলনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জনস্টোনের আদালতে সাক্ষ্য দেন রবীন্দ্রনাথ। ওই দিন খুলনা আদালতে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন বৃদ্ধ উকিল কালিপদ রায়কে যা বলেছিলেন, সে সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে চিন্মোহন সেহানবীশ রবীন্দ্রনাথ ও বিপ্লবী সমাজ বইয়ে লিখেছেন, ‘উকিল মহাশয় কালিপদ বাবুকে বলেছিলেন, তাঁরা তখন শুনেছিলেন যে ছোটলাট অ্যান্ড্রু ফ্রেজারের নাকি গোড়ায় মতলব ছিল রবীন্দ্রনাথকেও হীরালাল সেনের সঙ্গে আসামি করে মামলা রুজু করা। কিন্তু সরকারপক্ষের আইনজীবীরা যখন জানালেন যে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে অভিযোগ টেকানো যাবে না বরঞ্চ গোটা মামলাই ফেঁসে যেতে পারে তার ফলে, তখন হীরালাল সেনের বিরুদ্ধে মামলায় সরকার তরফের প্রধান সাক্ষী হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে ডাকার সিদ্ধান্ত করা হয়। উদ্দেশ্য রবীন্দ্রনাথের মুখ দিয়ে বলিয়ে নেওয়া যে হুঙ্কার-এর কবিতাগুলি অত্যন্ত উত্তেজক ও রাজদ্রোহকর। রবীন্দ্রনাথ ওই মামলার প্রধান সাক্ষী ছিলেন কিন্তু কবির খুলনা আদালতে পৌঁছাতে কিছুটা দেরি হয়েছিল। হাকিম জানতে চান সাক্ষী আজ হাজির হতে পারবেন না, এমন কোন আবেদন জানিয়েছেন কি না। যখন জানা গেল তেমন কোনো দরখাস্ত আসেনি তখন নাকি হাকিম বলেছিলেন “আজকের দিনটা দেখুন, তারপর বাধ্য হয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে হবে।” আর ঠিক তখনই নাকি আদালতে পৌঁছান রবীন্দ্রনাথ।’
তবে সেদিন আদালতে কবির দেওয়া সাক্ষ্য সম্পর্কে কালিপদ বাবু লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের সাক্ষ্য মোটেই সরকারের পক্ষে যায়নি। কারণ তিনি নাকি বলেছিলেন “স্বাধীনতাকাঙ্ক্ষী তরুণের পক্ষে উত্তেজক কবিতা বা গান লেখা আদৌ অস্বাভাবিক নয়। ওকালতি তার পেশা নয়, সুতরাং কবিতা বা গান কী পরিমাণ উত্তেজক হলে সেটা আইনত দণ্ডনীয় হবে সেটা তাঁর জানা নেই।”’
ওই মামলায় হীরালালের সাজা হয়েছিল। কারামুক্তির পর ১৯১০ সালে হীরালালকে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমে নিয়োগ করেন রবি ঠাকুর। কিন্তু সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের তাড়ায় ১৯১২ সালের গোড়াতেই তাঁকে জমিদারির কাজে সরিয়ে নিতে বাধ্য হন। রবীন্দ্রনাথকে কেবল ব্যক্তিগতভাবে নয়, তাঁর প্রতিষ্ঠান শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের বিরুদ্ধেও তৎকালীন পুলিশের কতটা আক্রোশ ছিল, তা বোঝা যায় সেই সময় পূর্ববঙ্গ ও আসামের ডিরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশনের বিভিন্ন সময়ের গোপন প্রজ্ঞাপনের বয়ান থেকে।
শংকর কুমার মল্লিক
শিক্ষক, বাংলা বিভাগ
সরকারি বিএল কলেজ, খুলনা।