আয়নায় বিম্বিত জীবন

প্রথমা প্রকাশন থেকে হালে নতুন কলেবরে প্রকাশিত প্রবীণ কথাসাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদের আয়না আমাদের নিয়ে যায় বিগত বিশ শতকের বিশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ত্রিশ দশকজুড়ে ঘটমান সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিবেশের এমন এক আবহে; এবং এই গল্পগ্রন্থের পাঠ স্মরণ করিয়ে দেয় সেই কালের সঙ্গে বর্তমানের ব্যবধান শুধুই কালগত। আবুল মনসুর আহমদের দেখা সেই কালটির ঘটনাধারার জের হয়তো আমরা এখনো টেনে নিয়ে চলেছি।

আলোচ্য বইয়ের ভূমিকায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছেন, ‘আয়না আবুল মনসুর আহমদের প্রথম বই—সাতটি গল্পের একটি সংকলন। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে, তবে গল্পগুলো লেখা হয়েছিল বেশ আগে, ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এগুলো ছাপা হতে শুরু করেছিল, প্রধানত সওগাত-এ।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘আবুল কালাম শামসুদ্দীনকে বইটি উৎসর্গ করতে গিয়ে তিনি যা বলেছিলেন—“এই হাসির পেছনে যে কতটা কান্না লুকানো আছে, তা তুমি যেমন জান, তেমনি আর কেউ জানে না।”—সে কথা প্রণিধানযোগ্য।’

মোট সাতটি গল্পের সমাহার আয়না। গল্পগুলোর শিরোনাম ‘হুযুর কেবলা’, ‘গো-দেওতা-কা দেশ’, ‘নায়েবে নবী’, ‘লীডরে কওম’, ‘মুজাহেদিন’, ‘বিদ্রোহী সংঘ’ও ‘ধর্ম-রাজ্য’।

>আয়না
আবুল মনসুর আহমদ
প্রচ্ছদ: অশোক কর্মকার, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: জুলাই ২০১৭, ১২০ পৃষ্ঠা, দাম: ২৫০ টাকা।

ভণ্ড পীরের গল্প ‘হুযুর কেবলা’। ধর্মের নামে কত তার ছলাকলা। তার পরিবেষ্টনের অশিক্ষিত ধর্মভীরু লোকজন ধরতে পারে না এই ভণ্ডামি। মজার ব্যাপার, হুযুর কেবলা মেয়েমহলে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বেশিক্ষণ থাকতে ভালোবাসে। একবার সফরে গিয়ে যে বাড়িতে সে ওঠে, সেটি তার মুরিদ রজবের। হুযুরের দৃষ্টি যায় রজবের স্ত্রী কলিমনের দিকে। হুযুরের দেহাশ্রিত রুহ কলিমনকে বিয়ে করার ব্যাপারে তাকে আদেশ করে। এটি জেনে প্রতিবাদ করে তার প্রধান শিষ্যদের একজন—এমদাদ। প্রতিবাদের ফলও এমদাদ হাতেনাতে পায়—ভণ্ড পীরের নির্দেশে মারপিট করে গ্রামের বাইরে বের করে দেওয়া হয় তাকে। বৃহত্তর দেশ পরিসরে এখনো যে এ ধরনের কর্মকাণ্ড চলছে, গল্পটির পাঠ নতুন করে আমাদের তা স্মরণ করাবে।
‘গো-দেওতা-কা দেশ’ গল্পের আধার ইংরেজদের কুমন্ত্রণায় গো-হত্যা নিয়ে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ, হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরকে নিধনের বিবরণ, শেষে মানুষের অভাবে দেশটির গো-দেবতার দেশে পরিণত হওয়া। কী প্রখর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে ভরা এই গল্প! পাঠ শেষে মন বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।
‘নায়েবে নবী’তে-ও তুলে ধরা হয়েছে এক ভণ্ড মৌলভির চরিত্র। অন্যদিকে ‘লীডরে কওম’ গল্পের মাধ্যমে আবুল মনসুর বলেছেন ইসলাম সাহেব নামের এক লোকের কথা। কীভাবে তিনি ধর্মভীরু লোকজনের চোখে ও মনে ধুলো দিয়ে পত্রিকার মালিক হয়ে গেলেন, দেখলেন বিত্তের মুখ, হয়ে উঠলেন মুসলিম বঙ্গের অদ্বিতীয় নেতা—এ গল্পে আছে তার প্রায় বিস্তারিত বিবরণ।
‘মুজাহেদিন’ গল্পে তুলে ধরা হয়েছে ধর্ম ব্যবসায়ীদের কথা। নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য তারা স্বসম্প্রদায়ের দুই দল বিশ্বাসীর মধ্যে বিবাদ বাধিয়ে কীভাবে লক্ষ্য হাসিল করে, এ গল্প তার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
‘বিদ্রোহী সংঘ’ ধারণ করেছে এমন একটি সংঘের সদস্যদের কথা, যারা প্রথাবিরোধী। কিন্তু দেশমাতার সেবায় কোনো ধরনের কষ্ট স্বীকারে অনীহ এরা। ভেতরে-ভেতরে ভীত রাজশক্তির ভয়ে। অথচ বিশ্বমানবতার কথা বলে এরাই মুখে ফেনা তোলে। গল্পটি এদেরই মুখোশ-উন্মোচক।
বইয়ের শেষ গল্প ‘ধর্ম-রাজ্য’। মসজিদের সামনে ঢোল-করতাল বাজানোর পরিণতিস্বরূপ হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সহিংস রক্তাক্ত দাঙ্গা বাধল। দুই সম্প্রদায়ের অনেকেই নিহত হলো। আবুল মনসুর আহমদ গল্পের শেষটা করেছেন এইভাবে: “হিন্দু মৃতদেহ ‘আর্য বীর’ এবং মুসলমান মৃতদেহগুলো ‘শহীদ’ লেখা কাপড় দিয়ে আবৃত করা হলো।”
এ বইয়ের গল্পগুলো লিখতে গিয়ে যে ভাষাভঙ্গির আশ্রয় লেখক নিয়েছেন, তার ফলে তাঁর নিজস্ব একটি ভাষাগত শৈলী দাঁড়িয়ে যায়। বাংলা সাহিত্যে তাঁকে আলাদা স্থান দিতে হয়। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘আয়নার ফ্রেম’ নাম দিয়ে এ বইয়ে যে ক্ষুদ্র ভূমিকা লিখেছেন, তার ভেতর দিয়েই স্পষ্ট হয়ে যায় আবুল মনসুর আহমদের সাহিত্যিক উচ্চতা।