কূর্মবৃত্তি, আরেক রকম

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ছুটির দিনের সকালবেলা চুনি আর চুনির দাদাজানের এই কানাগলির বাসায় কেউ আসে না, তারাও কোথাও যায় না। কেউ তাদের চায় না, তারাও কোথাও অনাহুত হয়ে ধরা দেয় না। দুজনেই খ্যাপা, মাথার দোষ আছে বলে লোকে। কথা বলতে গেলে হয় সানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলে, নয় বায়ুগ্রস্তের শূন্য চাহনি নিয়ে বসেই থাকে—ঘণ্টা কাটলেও রা কাড়ে না। চুনি ও চুনির দাদাজান উভয়েই অত্যন্ত অজনপ্রিয়। চুনি ইশকুলে মারপিট করে, অল্পবিস্তর হাতটানও, ঝগড়ায় চুনি কদাচ পিছু হটে না। বর্ষার পর থেকে তার নাকে পোঁটা পড়তে থাকে, ময়লা ইউনিফর্মের পকেটে সে লুকিয়ে রাখে কবেকার পড়ে যাওয়া দুধদাঁত। চুনির দাদাজানের সঙ্গে বসলেই দাদাজান সমাস জিজ্ঞেস করে, ট্রান্সলেশন জিজ্ঞেস করে, কবেকার বাঁধাই টেস্টপেপার থেকে কারেকশন করতে বসায়, আজকাল যে এসব কেউ করে না, তা নিয়ে কেউ বলতে এলেই তেড়ে যায়। কেউ যদি খেলতে চায়—দাদাজান ক্যারম খুব ভালো খেলে কিন্তু চুরি করে। লুডুতেও। মোটের ওপর দাদাজানকে জিততে হবে। চুনিকেও। খেলুড়ি না পেয়ে তারা নিজেরাই কানাগলির এই এঁদো বাসাটায় খেলতে বসে। চীনা কাগজের ঘুড়ি ওড়ায় আর একে অন্যের ঘুড়ি কাটে। কাটা ঘুড়ির পেছনে হইহই করে দৌড়ায়। এসবই হয় নিমগাছতলার বেতের চেয়ার দুটিতে বসে বসে। যেমন—
(সেদিন সকাল থেকেই চুনির মন খাপ্পা। মাঝে মাঝেই সে বিশ্বসংসারের ওপর বেজায় বিরক্ত হয়ে ঘুম থেকে ওঠে, সমস্ত জগৎ যে তাকে প্রবঞ্চিত করার জন্য রামধনুর এই তলা থেকে ওই তলা অব্দি ফাঁদ পেতে রেখেছে, সেটা দিব্য বুঝতে পেরেই এই মন খারাপ।)
‘দাদাজান, তুমি আমার মায়েরে তোমার বউয়ের গোলাপবালা দুইটার একটাও দিলা না, ফুটকলাই হাতে বউ আনলা, সেই বউ রানল-বাড়ল-খাওয়াইল, নিজে খাইতে পায়লো আগা-বুকার তরকারি, তোমার এই দিমু দিমু শুনতে শুনতে আমার মা মইরাও গেল, তবু তোমার দেওনের সময় হইল না। তুমিও ঘটিগো মতন হাড়কেপ্পন। তোমারে উদ্দিশ কইরা জসীম উদ্দীন তাঁর “কেরপন মোল্লা”র গল্প লিখছেন।’
‘যা যা! ঘরে খাওন আছিল না, চিনার জাউ খায়া কতদিন রইছি, হোগলা বিছায়া শুইছি...কেডা খবর রাখে।’
‘আমার নানাবাড়ি থেকে কত কিছু আসত ঈদে-চান্দে। আর তুমি খালি এক বেলা আমাদের মুদি দোকানে নিয়া গিয়া বলতা কে কী কিনবি বল। তা-ও এমন দোকানে যেইখানে কাঠ-পেনসিল ছাড়া কিছু কেনার নাই! এলাকার দোষ যাইব কই। ঘটি ঘটিই থাকব। আবার কত আবদার—দাদাজান কি দাদু ডাকবি আমায়, দাদুভাই।’
(নিমগাছে একটা কাক এসে নিম ফল ঠোকরাচ্ছে। পাশের বাড়ির দীপা আবার ফেল করেছে বোধ হয়। দীপার মা গুমগুম করে কিল মারছে দীপাকে, দীপাও তার স্বরে চেঁচিয়ে কাঁদছে। সকালবেলা তিতে কথা বলে আর শুনে দুজনেরই মেজাজ গুম। এখন তোষামুদে কিছু না বললে চুনি প্রাতরাশটাও বরাদ্দ করবে না বলে দাদাজান কথা হাতড়ায়। আশ্বিনের শেষে কোন কোন ধান পাকত, সেই ধানের নাম ভ্রু কুঁচকে মনে করতে চেষ্টা করে। পারে না। অঘ্রান মাসে বিলের পানি বের হওয়ার মুখে পুঁটি মাছ ধরত মোড়লদের তিন নম্বর ছেলের সঙ্গে, তার নাম মনে করতে পারে না। সন্ধ্যা নামতে সেই তালের ডোঙা-ভাসানিয়া জলে উধাও তারার তীক্ষ্ণ ছায়া মনে করতে পারে না। অ্যাকর্ডিয়ানের হাঁপর কতটা কুঁচকে নিজের কাছে টেনে আনলে সুর বের হয়, ততটা ভ্রু কুঁচকেও লাভ হয় না। অতএব দাদাজান বিড়বিড় করে...)
‘এক যুগীতে সরু শলার পাটি বুনাইত, আরেক যুগীতে তাঁত বুনাইত, এই দুই যুগীতে বিয়া হইত না। তেলিগো সব মোছলমান। আর মোছলমানের ভিতরে আমরা সবচেয়ে নিকৃষ্ট জাত। আমরা জোলা।’
‘মোছলমানের জাত আছে নিকি? জাত না খোয়াইলে কেউ মোছলমান হবার পারে?’
‘আত্রাফের জাত গুনবার একরকম রীতি আছে। তরে আমি জাত গোনা শিখায়া দিমুনে। ইশকুল থিকা আসবার সময় কটা মার্বেল নিয়া আসিস।’
(এই আজব কারখানায় চুনির মন টানে না। সে সকালের রোদে নিজের হাত মেলে খড়ি তোলে। বাসি বিনুনি খুলে ফেলে আঙুল দিয়ে চুল চিরে চিরে জট ছাড়ায়, ঝরা চুলের নুটি পাকায় হাতের তেলোয়, থুতু দিয়ে সেটা বাইরে ফেলে। দাদাজান কথা খুঁজে পেয়ে খুশি হয়ে ওঠে।)
‘মাটির জালায় পুঁটি রাইখ্যা খড়ম পায়ে মাড়াইতে হইত, মাড়াইত আমার ছোট ফুপু। গায়ে ইঁদারার জলে ধুইতে ধুইতে লাল হইয়া যাওয়া থান।’
‘মোছলমানের ঘরে তো বিধবাদের বিয়া হয়। তোমরা তোমাদের ছোট ফুপুর বিয়া দিলা না কেন?’
‘আমরা হিন্দু-অধ্যুষিত এলাকার লুক। সেই জন্য হয়তো।’
(চুনির মুখ আপনা থেকে বেঁকে যায়।) ‘ঘরে একটা খাটাইবার স্থায়ী মুনিষ পাইলে কেউ কি ছাড়ে? বিনা পয়সার দাসী।’
‘টরটরাইয়া কথা কস লো ছেমড়ি।’
‘তুমি তইলে মুর্শিদাবাদের কথা কও। মাটির রং কেমন আছিল সেইখানে? আইট্যাল লাল মাটি না লাঙল চালাইতে সুবিধা এমন? চাষের জিনিস কেমন আছিল? নদীর ধার দিয়া শণের খেত আছিল? আখ হইত? বিদ্যুতের তারে সেপাই বুলবুলি? হাটের দিন কিন্যা আনতা পাউরুটি-বিস্কুট? তেলকল আছিল? গরু আছিল তোমাগো গোশালে?’
‘গেরামে গরু মরলেই লোকে ঋষিপাড়ায় গিয়া হাতের সুখ কইরা নিত, ঋষিরা বিষ দিয়া গরু মারত তো, নইলে চামড়া পাব কই। শীতকালে চাষায় ক্ষেতে পায়ে দিব কী?’
‘এইপারে না ওইপারে? কোন পারের কথা কও তুমি?’
‘পারাপার নাই রে। গরুরে কত খেসারি খাওয়াইছি।’ (শ্বাস ফেলে দাদাজান। শ্বাসের শব্দটা শুনে মন সামান্য আর্দ্র হয়ে আসে চুনির। তার ঘুড্ডি কাটা আপাতত শেষ। কাটা ঘুড্ডি ইলেকট্রিক তারে বাকি বেলা গোত্তা খাবে।)

আরেক দিনের কথা। সেদিন চুনি বেশ করে রেঁধেছে। চুনি রান্না করতে শিখেছে সাত বছর বয়সে। সফটেক্সের ব্যবহার শিখেছে বয়ঃসন্ধিতে, আপনা থেকে। মানুষের আত্তীকরণের ক্ষমতা ও বিবর্তনে টিকে থাকার ক্ষমতা নিয়ে কোনো একটি অভিসন্দর্ভের বিষয় হতে পারে সে। সে-ই গৃহকর্ত্রী। এখন দুজন বর্ষার দুপুরে ঢ্যালা খিচুড়ি মারছে। খুশিয়াল হাসিতে দাদাজানের তেকোনা হনু তাল মিছরির মতন চকচকে হয়ে আছে। হাতা ভরে খিচুড়ি নিতে নিতে দাদাজান বলে, ‘আহা, তুলাইপঞ্জি চাইলের খিচুড়ি, তাতে গাওয়া ঘি আর হাতের পাঞ্জার সমান বিশাল বেগুনভাজা! কী খাইতাম। খুব বেগুন হইত সেই অঞ্চলে। ময়ানে ঘি দিতে উসখুস করে লোকে এইকালে, আর আমরা খাইতাম ঘিয়ে ভাজা।’ চুনির মুখ বাঁকতে গিয়েও বাঁকা হয় না। দাদাজানের মন ভালো থাকলে বর্ষায় টলমল নদীতে কাঁসারিগো মালবোঝাই নৌকার গল্প হয়, নদীতে মোচার খোলায় জশনের দীপ ভাসানোর গল্প হয়। বাইরে বৃষ্টি ক্ষ্যান্ত দিয়ে এখন জালালি কবুতরের ডানার মতন নীল নম্র মেঘের স্তূপ। তাদের বাড়ির চৌহদ্দিতে অনেক কবিরাজি গাছ—নিম-অর্জুন-রিঠা-বহেড়া।
দাদাজানের বাপ ছিল গাঁয়ের কবিরাজ, পিত্তশূলের ব্যারাম সারানোর ওষুধ আবিষ্কার করে ফেলেছিল বুড়া। অনুপান লিখে রাখার কাগজখানা শুধু হারিয়ে ফেলেছিল। কপিলা গাছে একটা ইষ্টিকুটুম এসে সারা পাড়া জানান দিয়ে শিস দিল। সেই দিকে তাকিয়ে দাদাজানের চোখ ভগবানগোলা থেকে চালান হয়ে আসা ভেড়ার মতন ঘোলা হয়ে এল একটু।
‘চুনি রে, তুই কুটুমপাখির গল্প জানোস?’
(চুনি মাথা নাড়ল।)
‘কুটুমপাখির বিয়া হওনের কথা চান্দের লগে। গায়ে হলুদ দিতাছে, কালো পাখি তো, সইরা সবতে মিল্যা তারে খুব হলুদবাটা ডলতাছে। চান্দের মনও খুশি। সে ঘরে গিয়া দ্যাখে, তার মায়ে একখান আস্ত মৈষ আগুনে ঝলসায়া খাইবার লাগছে। চান্দে তো দেইখা বেহুঁশ—মায় করে কী! মায় কানতে কানতে কইল, বাছা রে, তর বউ আইব, আমারে তো আর খাইতে দিব না, আমি এই বেলা সাধ কইরা খায়া নিই। মায়ের দুঃখে চান্দের চোখে জল আইল, সে বিয়া ভাইঙা দিল, বিয়ার কনের গায়ের হলুদ গায়েই রইয়া গেল।’
‘এই গল্প আমার পোষায় না গো দাদাজান। মায়ের চোখের পানি মুছল। চান্দের জিভের পানিও নিশ্চয় কোথাও আর কোনো পাখির বাসায় গিয়া পুরা হইল। খালি মুছল না বউ-পাখির গায়ের হলুদ।’
‘তৈলে অন্য গল্প শুনবি? আমাগো গ্রামে পুকুরে নাইতে গিয়া এক মেয়ের পায়ে জড়ায়া গেল দীঘল চুলের রাশ। সে পুষ্কুনি থিকা উইঠ্যা যেইখানে যায়, সেইখানে তার পায়ে পায়ে চুল যায়, যদ্দুর সে যায়—চুল তত লম্বা হইয়া যায়, যেন শিকলি। সারা দিন এমন গেল। রাইতের বেলা চুলের গোছা তার পায়ে ধইরা টান দিল পুকুরের তল থিকা। সেই টানে মেয়েটা পুকুরে আইসা তলায়া গেল গিয়া। এই গল্প আমার মায় কইত, সত্য।’
(দাদাজান এখন অনেকক্ষণ কাঁদি মহকুমার সেই গ্রামটাকে মনে করবে। মহারাজা মনীন্দ্র নন্দীর নামে স্কুল ছিল একটা। যেখানে দাদাজান মাদ্রাজি হেডমাস্টারের বেত খেত। যেখানে রেবতী মাসি সরস্বতী পূজার পরে খেতে দিত আঁজলাভরা কুল। যেখান থেকে সেই অলৌকিক চুলের টান পড়ত ডাঙার মানুষকে জলের দিকে নিয়ে যেতে। হিজলের বিল। বাদা জমিতে বনখেজুর আর তালগাছ। শ্যামা ধানের খেত। কূপ শুকিয়ে যেত সেখানে। সাঁওতালদের ঘর। হিংসায় পুড়ে যাওয়া ভিটে। যেখান থেকে অপশন দিয়ে তারা সাত ভাই পিঠ ফিরিয়ে চলে এসেছিল ঢাকায়।)
‘তুমি চালান হইয়া গেলা কবে মুর্শিদাবাদে? জন্মাইলা তো ষোলঘর। কবিরাজবাড়ি।’
‘আহা, আমার বাপজানের শখ আছিল ছেলেগো ব্যারিস্টর বানাবে—পড়ালেখার বড় সমঝদার। মায়ের দুধ ছাড়তেই তাই ভাইয়ের কাছে পাঠায়া দিল আমারে। ভাই ছিল মুর্শিদাবাদে। দারোগা। মহারাজা তারে ঘুষ দিতে আসছিল, সে নেয় নাই।’ (‘আর তুমি লুডুর ঘঁুটি চুরি কইরা পাকায়া ফেল’—মনে মনে ভাবল চুনি। কী ভেবে যেন হাসল দাদাজান।)
‘ওরে আমার বড় ভাইয়ের সন্তান আমার চাইতে বয়সে বড়। আমি শুইতাম ভাই-ভাবির মাঝখানে, কোলের ছেলের মতন। সৎভাই কিন্তু। কেউ বিশ্বাস যাইব এই কালে?’
‘খায়া-দায়া পিছনের বেড়ার ধারের সব ঢোলকলমি কাইট্যা দিবা আজকে। পোকা হইতেসে, সাংঘাতিক পোকা।’ (উঠতে উঠতে বলে চুনি।)
‘আমাদের বাড়ির বেড়া ছিল মাদারগাছের। অসার বিরিক্ষ, জ্বালানি হয় শুধু।’ কার ওপর বিরক্ত হয়ে ওঠে দাদাজান, এই তো হৃষ্ট ছিল তার মন।
চুনি কিন্তু সত্যিকারের মানুষ, মানে যাদের হস্তরেখা থাকে, শরৎকালে কৃমি হয়, যারা ভ্যাটকানো কমলা রঙের ইউনিফর্ম পরে রিকশায় করে স্কুলে যায়, মাঝে মাঝে বাসে করে চালান হয়ে যায় এয়ারপোর্টের দুইধার দিয়ে পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে ‘নতুন বাংলাদেশ গড়ব মোরা, নতুন করে আজ শপথ নিলাম’ গাইতে। ওর দাদাজানও সত্যিকারের মানুষ। যাদের মুখ জরায় ইকড়ি-মিকড়ি দাগে বুড়িয়ে আসে, যারা অবসরে আমকাঠের পিঁড়ি বানায় আর পড়শির মেয়ে দীপাকে ইংরেজি ট্রান্সলেশন করায়—‘ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগিনী মরিয়া গেল’ শুনে যাদের ছাত্রীরা মড়ার চোখে তাকিয়ে থাকে। ওরা কিছুটা স্থাবর, ওদের দুইজনেরই স্থায়ী ঠিকানা আছে—একটা কানাগলির ভেতরে; যে গলিতে নালা উপচে যায় বিলের পানি এসে, যে গলিতে অ্যাম্বুলেন্স ঢোকার প্রস্থ নেই। অথচ গলির মানুষগুলোর পরিধি আছে, আছে মুর্শিদকুলির কামান দাগলে চমকানোর মতন পিলে।
যেমন বলেছি, চুনিকে পথেঘাটে উত্ত্যক্ত করার লোক আছে। তার উঠন্তি বুকে ছোবল দিয়ে ক্যারমের ঘুঁটি ছোঁ মারতে গিয়ে লেগে গেছে—এমন ভান করার রোগাটে হাতের লোক আছে। দাদাজান মরে গেলে চুনির বিয়েতে দেওয়ার মতন আসলেই কিছু রেখে যাবে কি না, সেসব সামাজিক দুশ্চিন্তা আছে। চুনির দাদাজানের জন্য রাতের বেলা ভয় জাগিয়ে রাখার স্মৃতি আছে (সবচেয়ে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে নিজের কাছেও আবৃত্তি করতে যা ভয় হয়), চোরের লুটপাটের আওয়াজ আছে, ‘সেহরি খাওয়ার সময় হয়েছে’ বলে দুয়ারে ঢ্যাঁড়া দেওয়ার লোক আছে। এসব থেকে যে কচ্ছপের খোলে গিয়ে তারা দুই উঞ্ছজীবী লুকায়, তার নাম অতীতকাল।

পাড়ার স্কুলের হেডমাস্টারের সঙ্গে মিলে চুনির দাদাজান একটা গ্রামার বই লিখেছিল, সেটার কপি অনেক খুঁজে–পেতে পাওয়ার পরে সেদিন দুজনেরই মন দুইয়ের প্রতি প্রসন্ন। ছোট্ট হাতলভাঙা কাপ থেকে ওঠা দুধের গন্ধে চুনির দাদা উৎফুল্ল হয়ে বলে, ‘দার্জিলিংয়ে যখন আবগারি অফিসার আছিলাম, গাইয়ের দুধ খাইতাম, কী খাঁটি! শিশিরের জল খাইলে এমন হয়। একদিন মেঘ আইসা খোলা ঘরের জানলা দিয়া ঢুইক্যা উল্টা দিকের দেয়ালের জানালা দিয়া বার হইয়া গেল গিয়া। আকাশের রং ধোঁয়ার মতন, রাইতেও মাঝে মাঝে মৈষের চোখের মতন লাল। সেই আকাশ আর মেঘের মইধ্যে বইসা মায়ের জন্য কানলাম সেই রাতে। পরদিন চইলা আসলাম। ম্যালেরিয়াতে মরমু তবু মায়ের কাছেই থাকমু।’
এরপর চুপচাপ। দীপার বোন নীপার গানের মাস্টার এসেছে। বর্ষণক্ষান্ত বিকেলে হারমোনিয়াম প্রবল বেগে চেপে মাস্টারমশাই গাইছে—‘হে-এ-এ-এ আকাশবিহারী নীরদ বাহন জল...’। ঘরে ঊর্ধ্বাকাশে উড্ডীন মেঘ ভেসে এলে কেউ কেন মায়ের শোকে কাঁদবে, সেটা বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল চুনির। সে উসখুস করে বলল, ‘তারপর আইস্যা বিয়া কইরা ফেললা, (মাদারকাঠের মতন অসার, জ্বালানি হয় কেবল। এমন ম্যায়া) তুমি বিয়া কইরা ফেললা? খালি তোমার মা কইল বইলা?’
দাদিজানের গল্প আগেও কয়েক দিন হয়েছে, সেই গল্প গল্পের নায়িকার মতোই নির্বিশেষ। শুধু একবার চুনির দাদাজান ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘চুনি, তুমি কি ব্রাইডাল চেম্বারের গল্প জানতে চাও?’ সবেগে মাথা নেড়ে চুনি জানিয়েছিল, সে চায়। সেই গল্পে অপরিচিত মানুষের পাশে শুতে অনিচ্ছুক কেঁদে ফেটে পড়া একটি মেয়েশিশু ছাড়া তেমন কিছু নেই। বালিকা-বধূর বিভাময়তা আশা করে চুনি একটু মুখ তুলেছিল, বাল্যবিবাহের চারদিকে সেই রমণীয় বিভা সে দেখতে পেল না, হয়তো নেই।
‘দাদাজান, তুমি আপত্তি করো নাই ক্যান? ব্যাটা ছেলের কি মনের মানুষ লাগে না? (শুধু শরীলের?) ’
‘আমেরে আঁব কইব, মামারে কইব বাবা...এত দিন ঘটিগো লইয়া যা কিছু কইয়া লোকরঞ্জন করছি, তাই তো দেখি মা টরটরায়া কইয়া যাইতাছে—“ওরে তরে জনমভর বউ গাল পাড়ব ‘পুঁটি মাছের কাঙ্গাল’ বইলা। চব্বিশ পরগনার মাইয়া ভালো হইব ক্যামনে...আমার সেই চান্দের মায়ের মতন একখান মৈষ খাইয়া বইসা থাকতে হইব, পোলার বউ তো আর ভাত দিব না...” আর কী কইবার পারি, মা বড় ধন, কিসের মাসি কিসের পিসি কিসের বৃন্দাবন...’ দাদাজান প্রায় ফড়িংয়ের ডানার মতন তিরতিরে শব্দে বলে, পোড়া বাড়ির কালিময় ঘ্রাণ তার শ্বাসরোধ করে, হয়তো সে জন্য কিছুক্ষণ থেমে থাকে দাদাজান। আবার বলে, ‘জ্যোতি বসু কইয়া গেছে ঘটিতে আর বাঙ্গালে কুনোদিন মিশ খাইব না! বাপজান বাঁইচ্যা থাকতে কইত, “কুন ফায়াকুন” কয়্যা এগোরে মিশান যাইব না।’—বলে এই অযাচিত ফুটনোটের দায়ে মাথা নিচু করে কোঁচকানো দুই হাতের আড়ালে ‘হেড ডাউন’ করে বসে থাকে।
উৎকর্ণ চুনি কেবল উদ্ধার করতে পারে, তার মানে কেউ ছিল—মনোনীত কেউ।
‘তার নাম কী ছিল দাদাজান?’
দাদাজান মুখ তোলে না। কেশবিরল মাথার কুঞ্চিত তালু কেঁপে কেঁপে ওঠে শুধু। নিমগাছ থেকে দাঁড়কাক ডাকে কা কা। দীপাদের বাড়িতে কাপড় কাঁচতে আসা বুয়া খুব ঝগড়া করছে, সাবান যে চুরি করে সে ইসের বেটি—এইসব। দাদাজান মাথা না তুলেই বলে, ‘তার নাম ছিল...ইয়ে রুবি।’
চুনির হঠাৎ মনে পড়ল, তার নামখানা দাদাজানের দেওয়া। ‘আমার পেলাস্টিকের পুতুলের গালে তুমি সব সময় শিসকলম দিয়া খালি একটা বড় লাল তিল কেন দিতা? রুবির গালে আছিল? তিল?’