দেশভাগের এক আইকনিক ছবির রহস্য

>দেশভাগের পরপর লাইফ ম্যাগাজিনে বিএস কেশবন নামে এক গ্রন্থাগারিকের ছবি ছাপা হয়। ছবিতে দেখা যায়, তিনি গ্রন্থাগারের বই ভাগাভাগি করা নিয়ে চিন্তিত। সম্প্রতি এই আলোচিত ছবির পেছনের কাহিনি নিয়ে দিল্লির দ্য ক্যারাভান পত্রিকায় একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। অনুবাদ করেছেন প্রতীক বর্ধন
ডেভিড ডগলাস ডানকানের তোলা সেই আইকনিক ছবি: বই ভাগ করা নিয়ে চিন্তিত যুবক গ্রন্থাগারিক বিএস কেশবন
ডেভিড ডগলাস ডানকানের তোলা সেই আইকনিক ছবি: বই ভাগ করা নিয়ে চিন্তিত যুবক গ্রন্থাগারিক বিএস কেশবন

১৯৪৭ সালের ১৮ আগস্ট মার্কিন ম্যাগাজিন লাইফ-এ বিএস কেশবন নামের এক ব্যক্তির ছবি ছাপা হয়, যিনি কিছুদিনের মধ্যেই স্বাধীন ভারতের প্রথম জাতীয় গ্রন্থাগারিক হন। ডেভিড ডগলাস ডানকান নামের এক আলোকচিত্রী এই ছবি তুলেছিলেন। এতে দেখা যায়, যুবক কেশবন চুলের মধ্যে হাত গুঁজে এক টেবিলে বসে আছেন। তাঁর দুই পাশে বইয়ের বড় স্তূপ। বামের বইয়ের স্তূপের ওপর সাদা প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘পাকিস্তান’, আর ডানের বইয়ের স্তূপের ওপর সাদা প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘ভারত’। ছবির ক্যাপশন ছিল এ রকম: ‘ইম্পিরিয়াল সেক্রেটারিয়েট লাইব্রেরিতে একজন পরিচালক দেড় লাখ ভলিউম বই দুই রাষ্ট্রের জন্য সমানভাবে ভাগ করার চেষ্টা করছেন।’ এরপর ১৯৯৭ সালের আগস্টে ভারতের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকীর স্মৃতিচারণামূলক সংখ্যায় টাইম ম্যাগাজিন (সেই সময় লাইফ-এর মূল প্রকাশক) ছবিটি পুনর্মুদ্রণ করে।

এই ছবি নিয়ে যথেষ্ট বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছবিটি অন্তর্জালে বেশ আলোচিত হয়েছে, যেখানে প্রায়ই ভুলভাবে বলা হয়, ছবিটি কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে তোলা। আর ইম্পিরিয়াল সেক্রেটারিয়েট লাইব্রেরি দিল্লিতে অবস্থিত, যার বর্তমান নাম সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েট লাইব্রেরি। আমি যখন এই লাইব্রেরির সঙ্গে যোগাযোগ করি, তখন তথ্য কর্মকর্তা ওয়াই অরবিন্দনাথ রাও নিশ্চিত করেন, এই ছবিটি ১৯৪৭ সালে তাঁদের গ্রন্থাগার থেকে তোলা। বিএস কেশবনের ছেলে একাডেমিশিয়ান ও প্রাবন্ধিক মুকুল কেশবন আমাকে নিশ্চিত করেন, তাঁর পিতা তখন ওই গ্রন্থাগারের পরিচালক ছিলেন।
বছর দুয়েক আগে দ্য গার্ডিয়ানও ছবিটি ছাপে এবং ক্যাপশনে যথারীতি ভুল করে লেখে, এটি ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে তোলা। এ বছরের প্রজাতন্ত্র দিবসে হিন্দুস্তান টাইমস আইকনিক ভারতীয় আলোকচিত্রবিষয়ক এক লেখায় ছবিটি ছাপে এবং একই ভুল করে। উভয় পত্রিকায় ছবির উৎস হিসেবে টুইটার অ্যাকাউন্ট @IndiaHistorypic উল্লেখ করা হয়, যার অনুসারীর সংখ্যা দুই লাখের বেশি।
তবে গ্রন্থাগারের ভুল পরিচিতির চেয়ে গুরুতর বিষয় হচ্ছে, ছবিতে বই ভাগাভাগির ব্যাপারটা বোঝানো হলেও বাস্তবে ওই দুই গ্রন্থাগারের বই ভাগাভাগি হয়নি।
অন্বেষা সেনগুপ্ত দেশভাগের প্রশাসনিক পরিণতি নিয়ে লিখেছেন। তিনি আমাকে ফোনে বলেছেন, শুধু রাজ্য পর্যায়ের গ্রন্থাগারের বই ভাগাভাগি হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় বা সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে থাকা গ্রন্থাগারের বই ভাগাভাগি হয়নি। কলকাতা মাদ্রাসা লাইব্রেরির বই ভাগাভাগি হয়েছিল বলে তিনি জানিয়েছেন। ওই গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ গর্বভরে বলে, তাদের ওখানে বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো পারসিক পাণ্ডুলিপি আছে। অন্বেষা আমাকে বলেন, ‘ওই পাণ্ডুলিপিগুলো খোলা ট্রাকে ঢাকা নেওয়া হয়েছিল। ফলে বৃষ্টিতে তার অনেকগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। আর এখন কলকাতা মাদ্রাসা লাইব্রেরিতে শুধু ১৯৪৭ সাল-পরবর্তী সময়ের ক্যাটালগ আছে।’
মুকুলও বলেছেন, দেশের প্রধান গ্রন্থাগারের বই কখনো ভাগাভাগি হয়নি। তিনি আমাকে বলেছেন, ইম্পিরিয়াল সেক্রেটারিয়েট লাইব্রেরির বই ‘ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু সেটা কখনো বাস্তবায়িত হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরির বইও ভাগাভাগি করার ব্যাপারে প্রাথমিক প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটাও বাস্তবায়িত হয়নি। ব্যাপারটা হলো, কোন নিয়মের ভিত্তিতে আপনি বই ভাগ করবেন? এটা অবাস্তব।’
কিন্তু তারপরও একটি প্রশ্নের উত্তর বাকি থেকে যায়, সেটা হলো, মুকুলের বাবার ছবি কীভাবে তোলা হলো? তবে এ ব্যাপারে মুকুল অতটা নিশ্চিত নন। তিনি ১৯৯৭ সালে টাইম ম্যাগাজিনে ছবিটি দেখার স্মৃতিচারণা করেন, ছবিটি তিনি বাবাকে দেখিয়ে বলেন, ‘দেখো, তোমার ছবি ছাপা হয়েছে, তুমি ন্যাশনাল লাইব্রেরির বই ভাগ করছ।’ উত্তরে তাঁর বাবা শুধু হেসে বলেছিলেন, ‘এটা কখনো হয়নি।’ আমি মুকুলকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার বাবা কি এটা বলতে চেয়েছেন যে বই ভাগাভাগি করাই হয়নি, নাকি এই ছবিটি কখনো নেওয়া হয়নি। তিনি বললেন, তাঁর বাবা প্রথম কথাটিই বলেছেন।
প্রাথমিকভাবে মুকুল সন্দেহ করেছিলেন, ছবিটি কোনোভাবে কারিগরি করা হয়েছে: ‘দেখুন, ছবির ভেতরটা কতটা অযৌক্তিক। বইয়ের ওপর যে সাদা বোর্ড দুটি রয়েছে, সেগুলো খুব বেশি সাদা’, ওই সময়ের তুলনায়। ‘এটা ভালো ছবি নয়’, যার ‘ফ্রেম হাস্যকর’। তিনি বলেন, ‘টাইম ম্যাগাজিনের মতো একটি পত্রিকা এই ছবি ছেপেছে দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি।’
কিন্তু পরবর্তীকালের এক ই-মেইল আলাপচারিতায় মুকুল স্বীকার করেন, ছবিটি অসম্পাদিত হলেও বানানো হতে পারে। তিনি বলেন, ‘আলোকচিত্রী সম্ভবত নাটকীয় ছবির মাধ্যমে দেশভাগের মতো বিস্ময়কর ঘটনা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। সে কারণে ভারত ও পাকিস্তান নামাঙ্কিত দুটি সাদা বোর্ডের মাধ্যমে তিনি কেশবনকে বই ভাগাভাগির নাটকে কুশীলব হতে রাজি করিয়েছিলেন।’
আমি ছবিটির বিষয়ে রাহাব আলানা নামের এক আলোকচিত্রী ও দিল্লির শিল্পবিষয়ক অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের মত নিয়েছিলাম। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু প্ল্যাকার্ডের আক্ষরিক ও ভৌগোলিক অবস্থান দেখেছি, পাকিস্তান বামে আর ভারত ডানে। ভৌগোলিকভাবে এটা সঠিক। তিনি আরও বলেন, বইগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে খুবই ভারসাম্যপূর্ণ ছবি তৈরি হয়েছে। বইয়ের উঁচু স্তূপটা পাকিস্তানের, যেটি পেছনের দিকে চলে যাচ্ছে, আর সামনের অংশটা ভারতের, যেটি দর্শকের কাছাকাছি চলে আসছে।’
কিন্তু তিনি বলেন, ছবির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও তাতে ‘পরিস্থিতির বাস্তবতা হারিয়ে যায় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এভাবেই ছবি পাঠ করতে হয়। আলোকচিত্র সাংবাদিকের ছবি সম্পাদনা ও সেন্সর করতে হয়।’ আলানা বলেন, এই ছবিটি মানুষের হৃদয়ে দেশভাগের এক শক্তিশালী ঝংকার তোলে। ‘ব্যাপারটা যে প্রহসন, সেটা বোঝানোই আলোকচিত্রীর কাজ। আপনি তো ছবিটির মতো প্রকৃতপক্ষে ভারত ও পাকিস্তান ভাগ করতে পারেন না। গ্রন্থাগারে হয়তো আপনি সেটা পারেন, কিন্তু মানুষের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়বে।’