ছোট পত্রিকার শহীদ কাদরী স্মরণ

‘না, না, তার কথা আর নয়, সেই/ বেরিয়েছে সকালবেলায় সে তো—শহীদ কাদরী বাড়ি নেই!’—নিজের এই কবিতার মতোই শহীদ কাদরী পাকাপাকিভাবে ‘বাড়ি’ ছেড়েছেন গত বছরের আগস্ট মাসে। এখন হাজারো ডাকাডাকি করেও তাঁকে আর জাগানো যাবে না। তবে বাংলা কবিতার ইতিহাসে যে কজন কবি কিংবদন্তিতুল্য মর্যাদা পেয়ে জেগে আছেন, শহীদ কাদরী তাঁদের অন্যতম। যদিও তিনি কলম তুলে রেখেছিলেন মৃত্যুর বহু আগেই। এ সময় শহীদ কাদরী বাড়ি তো ছিলেন কিন্তু নিজ ভূমি থেকে অনেক দূরে। তাই পাঠকদের ডাকেও আর তেমন একটা সাড়া দেননি এই কবি।
কিন্তু মৃত্যুর পর আবারও নতুন করে বেঁচে উঠেছেন তিনি।
শহীদ কাদরীর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে আস্ত সংখ্যা বের করেছে দুটি ছোট পত্রিকা—শালুক ও শঙ্খচিল। বৈচিত্র্যময় লেখা এবং স্মারকে এই কবিকে মলাটবদ্ধ করেছে পত্রিকা দুটি।
মৃতপ্রায় ছোট পত্রিকার জগতে ওবায়েদ আকাশ সম্পাদিত শালুক বেশ নিয়মিতই বের হয়। গত বছর পত্রিকাটি পদার্পণ করেছে ১৮ বছরে। সেই ধারাবাহিকতায় গেল বছরের শেষ মাসে শালুক প্রকাশ করে ‘শহীদ কাদরী সংখ্যা’।
শহীদ কাদরীকে নিয়ে নানা ধরনের ৬০টির বেশি লেখা ছাপা হয়েছে এখানে, যার মধ্যে কিছু লেখা আছে, যা পুনর্মুদ্রিত। এতে বেলাল চৌধুরী, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও হুমায়ূন আহমেদের লেখাও রয়েছে। এ ছাড়া শহীদ কাদরীর নাটকীয় জীবন, তাঁর অসামান্য সব কবিতা, কবিতার জগৎ থেকে নির্বাসন এবং শেষে আবার কবিতায় ফিরে আসা—সবকিছুকেই ছুঁয়ে গেছে পত্রিকাটি। শহীদ কাদরীকে জানতে হলে মলাটবদ্ধ এই পত্রিকাটি ভবিষ্যতে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

>

শালুক
সম্পাদক: ওবায়েদ আকাশ
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, সংখ্যা ২১, প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০১৬, ৬৮৭ পৃষ্ঠা, দাম: ৪০০ টাকা।

শঙ্খচিল
সম্পাদক: মাহফুজ পাঠক ও ইকবাল মাহফুজ
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা, সংখ্যা ৪, প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০১৭, ৩৫০ পৃষ্ঠা, দাম: ১৫০ টাকা।

কেবল শহীদ কাদরী ও তাঁর কবিতা নিয়ে আলোচনায় নয়, এখানে কবির অপ্রকাশিত কবিতা, গদ্য, নির্বাচিত কবিতা, অনূদিত কবিতা, সাক্ষাৎকার এবং তাঁর দুই স্ত্রীর সাক্ষাৎকারও স্থান পেয়েছে, যা একে আরও বর্ণিল আর তথ্যবহুল করে তুলেছে। সবশেষে সংযোজন করা হয়েছে শহীদ কাদরীর দুর্লভ সব আলোকচিত্র। এই পত্রিকারই এক সাক্ষাৎকারে শহীদ কাদরীর প্রথম স্ত্রী নাজমুন নেসা পিয়ারী শহীদকে ‘একজন আপাদমস্তক কবি’ বলে সম্বোধন করেছেন।
কিন্তু জীবনের অন্য সব বিষয়ে শহীদ ছিলেন আনাড়ি। যে কারণে তাঁকে ঠকতেও হয়েছে বারবার। দেশ ছেড়ে প্রবাসে থিতু হয়েছিলেন তিনি। ছিলেন কবিতা থেকে দূরে। তবে তাঁর এই সব সিদ্ধান্ত কি সঠিক ছিল? নিজের সিদ্ধান্তে সন্দেহ পোষণ করেছেন কবি নিজেও। সাদ কামালীর নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শহীদ বলেন, ‘আমি এ পর্যন্ত আমার ব্যাপারে যতগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি, সবই শেষ পর্যন্ত আমার জন্য গভীর মনস্তাপের কারণ হয়েছে।’ এর অর্থ কি এই যে কবিতা থেকে দূরে থাকার বিষয়টি শেষ দিকে কবির মনে আক্ষেপ তৈরি করেছিল?
যাহোক, যে কবিতাগুলো শহীদ কাদরী লিখেছেন, সেগুলো দিয়েই তিনি বেঁচে থাকবেন আরও অনেক বছর। আর শহীদ কাদরীকে বোঝার জন্য ভবিষ্যতে শালুক-এর এই সংখ্যাটি গুরুত্বপূর্ণ রসদ হয়ে পাঠকের সামনে হাজির হবে বারবার।
শালুক-এর চেয়ে আকারে ছোট হলেও মাহফুজ পাঠক ও ইকবাল মাহফুজ সম্পাদিত ছোট কাগজ শঙ্খচিল আগাগোড়া শহীদ কাদরীময়। এখানেও রয়েছে বৈচিত্র্যময় নানান লেখা। এই পত্রিকায়ও স্থান পেয়েছে পূর্বপ্রকাশিত কিছু লেখা, গুরুত্বের দিক দিয়ে সেগুলো বারবার পড়ার মতোই। এই বিবেচনায় বলা যায়, আলোচ্য লেখাগুলো সম্পাদকদ্বয়ের বুদ্ধিমান নির্বাচনই বটে। ৩৫০ পৃষ্ঠার এই পত্রিকাটি কবি ও ব্যক্তি শহীদ কাদরীর প্রতিনিধিত্ব করে। কবির বন্ধুস্থানীয় এবং আত্মজন ছাড়াও এখানে লিখেছেন তরুণেরা।
গত শতকের পঞ্চাশের দশকের গুরুত্বপূর্ণ এই কবিকে নিবেদন করে কবিতাও লিখেছেন তরুণেরা। এমনকি শহীদকে নিয়ে লেখা গান আর অণুগল্পও স্থান পেয়েছে এখানে। বিশেষত, এই অংশে তরুণদের অংশগ্রহণই ছিল বেশি। এটি প্রমাণ করে, দিন দিন শহীদ কাদরী ও তাঁর কবিতা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।
শঙ্খচিল-এ স্থান পেয়েছে বিভিন্ন চিত্রশিল্পীর আঁকা শহীদ কাদরীর প্রতিকৃতিও। এ ছাড়া তাঁর বিভিন্ন সময়ের স্মৃতিবাহী আলোকচিত্র তো আছেই। সংযুক্ত হয়েছে শহীদ কাদরীকে নিয়ে দেশ ও দেশের বাইরের বিখ্যাত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিকের মূল্যায়ন। এই বিভাগটি পত্রিকাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। এর বাইরে শহীদ কাদরীকে লেখা এবং শহীদ কাদরীর লেখা বেশ কিছু চিঠিও প্রকাশিত হয়েছে। এসবই শঙ্খচিল ‘শহীদ কাদরী সংখ্যা’র গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।
সব মিলিয়ে আগামী দিনে শহীদ কাদরীকে জানতে হলে, কবিতার পাশাপাশি তাঁর জীবন সম্পর্কে জানতে হলে শালুক ও শঙ্খচিল—এই দুই পত্রিকা পাথেয় হয়ে কাজ করবে পাঠকদের জন্য।