উত্তরাধিকার-এর শহীদ কাদরী

শহীদ কাদরী, িনউইয়র্ক। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
শহীদ কাদরী, িনউইয়র্ক। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

শহীদ কাদরীর কবিতার বই কয়টি? এক না একাধিক—এ নিয়ে তর্কের অবকাশ না থাকলেও তাঁর কবিতার পাঠকমাত্রই জানেন, মূলত বই তাঁর একটি—উত্তরাধিকার। কারণটা এ জন্য নয় যে উত্তরাধিকারকে তিনি টপকাতে পারেননি, বরং স্পষ্ট করে বললে, উত্তরাধিকার-এর পর কবিতা তাঁকে অনেকটাই ছেড়ে গিয়েছিল—তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমাকে মনে রেখেই কথাটা বলা।
অন্যভাবে বললে, উত্তরাধিকার-এর পথ তিনি পরে আর মাড়াননি। একজন কবি বা লেখকের পক্ষে ফেলে আসা পথ মাড়ানো কোনো কাজের কাজ নয়; কিন্তু শহীদ কাদরীর বেলায় যা ঘটেছে, তিনি তাঁর প্রথম কবিতার বইয়ে যে আনকোরা কাব্যভাষাকে নক্ষত্রপুঞ্জের মতো বুনেছিলেন, সে চর্চায় পরবর্তী সময়ে ছেদই পড়েনি, মনে হয়েছে তিনি আগ্রহী ছিলেন না সেই প্রতিশ্রুতিকে আরও সংহত করতে। কেন? কেউ কেউ বলে থাকেন, এ তাঁর বাঁকবদল। নতুন ভাষায় নতুন কবিতা লেখা। নতুন স্বর—হ্যাঁ, তা হয়তো ছিল, উদ্দীপনার জোগানও সম্ভবত ছিল কিছু কবিতায়। ছিল না যা, তা তাঁর নিজস্ব বাগ্ভঙ্গিমা।
কথাগুলো বলার কারণ হয়তো (হয়তো কেন, নিশ্চয়ই) উত্তরাধিকার-এর প্রতি এই গদ্যকারের দুর্বলতা। এতটাই যে পরবর্তী পর্যায়ে বিদেশে বসে অনেকটা গুণগ্রাহীদের অনুরোধে ও চাপে শহীদ কাদরী যখন দীর্ঘ বিরতিতে কবিতায় ফিরে এসেছিলেন, আমার মনে হয়েছে, নিজেকে তিনি খুঁজে পাননি। কবিতায় যান্ত্রিকতা ভর করেছে, অনুভূতির প্রকাশকে সোজাসাপটা করতে গিয়ে এমন অনেক শব্দ-উপমা ব্যবহার করেছেন, যা তাঁর স্বরচিত কাব্যভাষার সঙ্গে একদমই যায় না।

চট্টগ্রামের পুথিঘর থেকে প্রকাশিত কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা উত্তরাধিকার-এর প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ
চট্টগ্রামের পুথিঘর থেকে প্রকাশিত কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা উত্তরাধিকার-এর প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ

উত্তরাধিকার-এর বড় গুণ, এতে যান্ত্রিকতা নেই। তাজা-টাটকা ভাষা, কোথাও কোথাও টান টান প্রায় গদ্যগন্ধি হয়েও মাদকতাময়, সেই সঙ্গে লক্ষ্যভেদী চিত্রকল্প। সেই কবে, প্রথম যৌবনে মাথায় গেঁথে বসা পঙ্ক্তিগুলো তো আজও ছেড়ে যায়নি। না যাওয়ার একমাত্র কারণ—সেসবের ভিন্ন, একেবারে আলাদা স্বর। তাঁর সমসাময়িক বা পূর্বসূরি কারও কি প্রতিধ্বনি মেলে এ পদ্ধতিগুলোয়?
এই সাঁঝে, প্রলয় হাওয়ার এই সাঁঝে
(হাওয়া যেন ইসরাফিলের ওঁ)
বৃষ্টি পড়ে মোটরের বনেটে টেরচা,
ভেতরে নিস্তব্ধ যাত্রী, মাথা নিচু
ত্রাস আর উৎকণ্ঠায় হঠাৎ চমকে
দ্যাখে,—জল,
অবিরল
জল জল জল
তীব্র, হিংস্র
খল...
(বৃষ্টি, বৃষ্টি)

অথবা
এইক্ষণে আঁধার শহরের প্রভু,
বর্ষায়, বিদ্যুতে
নগ্ন পায়ে ছেঁড়া পাৎলুনে একাকী
হাওয়ায় পালের মতো শার্টের ভেতরে
ঝকঝকে, সদ্য, নতুন নৌকোর
মতো একমাত্র আমি
(বৃষ্টি, বৃষ্টি)
এ কবিতা শহীদ কাদরীর সে সময়ের বোহেমিয়ান কবিসত্তার যেন এক আপাদমস্তক দর্পণ। এখানে সন্ত্রাস আছে, আছে একাকিত্ব, নগরমানসের উদ্ভ্রান্তি ও মনস্তাপ; সেই সঙ্গে সভ্যতার ভবিতব্যহীন প্লাবনে ভেসে যাওয়া এক উদ্দাম, অনিশ্চিত যাত্রা। একই সঙ্গে অঝোর বর্ষণে নিমজ্জিত, ছিন্নভিন্ন মনোজগতের সংবেগ ও চিৎকার। লক্ষণীয়, এ কবিতার বৃষ্টি গ্রামবাংলার বৃষ্টি নয়, একান্তই শহুরে—‘আরবান’ বৃষ্টি।
শহীদ কাদরী ছিলেন আমাদের একমাত্র নাগরিক কবি। শামসুর রাহমানের প্রথম দিকের কবিতায় (প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে ও রৌদ্র করোটিতে স্মর্তব্য) নাগরিক এক কবিসত্তাকে পেলেও তাঁর অভিজ্ঞতাগুলো তাঁর নিজের ভাবতে খটকা লাগে। ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হয়ে পড়ে যদি সেই কবিতাগুলো ইংরেজি অনুবাদে পড়া যায়। বস্তুতপক্ষে মূল কবিতা পড়ার বহু বছর বাদে ইংরেজি অনুবাদ হাতে আসার পর আমার কাছে এ প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল—কার কবিতা পড়ছি?
শহীদ কাদরী ধার করা অভিজ্ঞতায় লেখেননি। বরং যেখানে তাঁর অভিজ্ঞতাকে অচেনা ঠেকেছে, সেখানেই দেখা মিলেছে এক রহস্যঘোর পরাবাস্তব আবহের।
রাতে চাঁদ এলে
লোকগুলো বদলে যায়
... ... ...
যেন সারি সারি মুখোশ দুলছে কোনো
অদৃশ্য সুতা থেকে
আর হাওয়া ওঠে
ধাতুময় শহরের কোনো সংগোপন ফাটল
কিংবা হাঁ-খোলা তামাটে মুখ থেকে
হাওয়া ওঠে, হাওয়া ওঠে
সমস্ত শহরের মিনারচূড়োয় হাওয়া ওঠে

(ওড়ে কত শুকনো কাগজের
মতো স্বগতোক্তি
খড়কুটোর মতো ছোট ছোট স্বর,
নৈরাশ্যের কালো ফুল।)
(ইন্দ্রজাল)
...আমার জানালা থেকে
নিরুপায় এক জোড়া আহত পাখির মতো চোখ
রাত্রিভর দেখবে শুধু
দূর দরদালানের পারে
আবছা মাঠের পর নিঃশব্দে ছিন্ন করে
জোনাকির জাল
ছুটে গেল যেন এক ত্রস্ত ভীত ঘোড়ার কঙ্কাল।
(জানালা থেকে)

ভাবলে অবাক হতে হয়, কত অল্প বয়সে শহীদ কাদরী নিজেকে কবিতায় সঁপেছেন, তা-ও নিজের তৈরি কাব্যভাষায়! সেই সঙ্গে আরও অবাক হতে হয়, কত কম লিখেছেন! উত্তরাধিকার বেরিয়েছিল ১৯৬৭ সালে। সবসুদ্ধ চল্লিশটি কবিতা। তিনটি বাদে বাকি কবিতাগুলো লেখা একষট্টি থেকে সাতষট্টি—এই দীর্ঘ সাত বছরে; আর যে তিনটিকে তিনি বলেছেন ‘কৈশোরিক প্রচেষ্টায় নির্মিত’, সেগুলো লেখা আরও এক যুগ আগে—১৯৫৬-তে। সেই কৈশোরিক কবিতা তিনটিতেও (‘এই শীতে’, ‘নির্বাণ’, ‘শত্রুর সাথে একা’) কি তাঁর স্বতন্ত্র কাব্যভাষার উন্মোচন প্রচ্ছন্ন থেকে যায়?
...চোখের মণিতে তার পড়েছে ধরা
নির্বিকার চিরস্তন,—থেমে আছে অপরূপ
বিশাল বাসন্তী আকাশ সন্ধ্যার,—
গভীর ধ্যানীর মতো মোহন, তন্ময়।
(নির্বাণ)
আমি শুধু
একাকী সবার জরার মুখোমুখি।

এবং আরো একজনের চোখে দেখি
লক্ষ সূর্যের আসা-যাওয়া এবং সে-ও একা
আমারই আত্মার মতো
প্রাঙ্গণের তরুণ কুকুর।
(এই শীতে)
লক্ষণীয়, যে দ্বন্দ্বময়তা ও একাকিত্ব এক যুগ পরে লেখা উত্তরাধিকার-এর বিখ্যাত কবিতাগুলোয় নতুন ভাষা, চিত্রকল্প ও চিন্তার জোগান দিয়েছিল, তার আগাম সংকেত অতি অল্প বয়সে লেখা ‘এই শীতে’ কবিতায়ও স্পষ্ট। বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকায় যে সময় এ কবিতাটি ছাপা হয়েছিল, তখন শহীদ কাদরী ছিলেন সে পত্রিকায় প্রকাশিত কবিদের মধ্যে অনুজতম। আরও লক্ষণীয়, যে নিঃসঙ্গতা ‘এই শীতে’ এবং উল্লিখিত অন্য দুটি কৈশোরিক কবিতায় পাওয়া যায়, তা-ই যেন পরবর্তী সময়ে রূপ পেয়েছে জীবনের গভীরতর উপলব্ধিতে। নাম কবিতা ‘উত্তরাধিকার’-এ তারই তীব্র ব্যঞ্জনাময় আর্তি:
জন্মেই কুঁকড়ে গেছি মাতৃজরায়ন
থেকে নেমে—
সোনালি পিচ্ছিল পেট আমাকে
উগ্রে দিল যেন
দীপহীন ল্যাম্পপোস্টের নিচে...

কিংবা
...পৃথিবীতে নিঃশব্দে ঘনায় কালবেলা।
আর আমি শুধু আঁধার-নিঃসঙ্গ ফ্ল্যাটে
রক্তাক্ত জবার মতো

বিপদসংকেত জ্বেলে এক জোড়া
মূল্যহীন চোখে
পড়ে আছি মাঝরাতে কম্পমান
কম্পাসের মতো
অনিদ্রায়।
(উত্তরাধিকার)

উত্তরাধিকার-এর পর বাগ্ভঙ্গি বহুলাংশে বদলে গেলেও শহীদ কাদরী দূর পরবাসে মৃত্যুর কিছুদিন আগেও এ গ্রন্থের কবিতাগুলোর প্রতি তাঁর অপার মমতা ও আত্মিক নৈকট্যের কথা জানাতে ভোলেননি। হাসান ফেরদৌসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, এলিয়টের যেমন ওয়েস্টল্যান্ড, উত্তরাধিকার-এর ‘বৃষ্টি’ কবিতাটি তাঁর কাছে তাই। এটি তাঁর ‘ওয়েস্টল্যান্ড’।