ভালোবাসার গানগুলো গাইতে হবে এখনই

>
শহীদ কাদরী (১৪ আগস্ট ১৯৪২—২৮ আগস্ট ২০১৬), প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
শহীদ কাদরী (১৪ আগস্ট ১৯৪২—২৮ আগস্ট ২০১৬), প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
শহীদ কাদরী। আমাদের এ সংখ্যা ১৯৫০–এর দশকের এই কবিকে ঘিরে। তাঁর বেশ কিছু কবিতা এখনো অপ্রকাশিত, কিছু অগ্রন্থিত। অপ্রকাশিত ও অগ্রন্থিত কবিতাবলি নিয়ে অচিরেই প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হচ্ছে কবির শেষ মৌলিক কবিতার বই গোধূলির গান। সেই পাণ্ডুলিপির অপ্রকাশিত কয়েকটি কবিতা ছাপা হলো এই আয়োজনে, কবির জন্ম ও মৃত্যুর মাসে

আমাদের শেষ গানগুলো

হন্তারকদের অস্ত্রের ছায়ায় লালিত আমরা
প্রত্যেকে আজ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মানুষ।
এমন এক দুঃসময়ের মধ্যে আমরা
বসবাস করছি, যখন
দেশে-দেশে উত্থান ঘটছে আণবিক অস্ত্রের
আমাদের শেষ গানগুলো এখুনি গাইতে হবে—
মানবিক বন্ধনের, প্রেমের,
অপার ভালোবাসার গানগুলো গাইতে হবে এখনই
অন্ধকার সময় থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য
গানগুলো আমাদের সম্বল।
রাত্রি যেমন নক্ষত্রের পক্ষে
গাছগুলো যেমন নতুন পত্রালির উত্থানের পক্ষে
নদীগুলো যেমন কল্লোলিত ধ্বনির পক্ষে
ফাঁসির আসামি যেমন ক্ষমাপ্রাপ্তির পক্ষে
আমাদের গানগুলোকে
দাঁড়াতে হবে সন্তানসম্ভবা মহিলাদের পক্ষে
পর্বতচূড়া আর সমুদ্রের বিস্তারের পক্ষে
এই গ্রহের প্রতিটি
ঘাসের শিখার পক্ষে।
এখন সেই দুঃসময়, যখন
আমাদের গাইতে হবে
আমাদের শ্রেষ্ঠ গানগুলো

উত্তর নেই
না। উত্তর জানে না কেউ,
না ওই সোনালি সোমত্ত গাছ, না ওই যে
অ্যাকুয়ারিয়ামের লাল, নীল, রুপালি মাছ।
এমনকি রবীন্দ্রনাথেরও
উত্তর ছিল না জানা।
আমাদের মধ্যে কেউ কেউ কেন
লাশকাটা ঘরে যাবে,
হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠবে
কোনো কোনো রাষ্ট্রনায়ক,
গায়ক পক্ষীরাও নিহত হবে শখের শিকারির
অমোঘ নিশানায়
ইতিহাসও নিরুত্তর। কেন নৃপতিরা
সাম্রাজ্য বিস্তার করেন!
কেন আমার পুত্রের পুত্ররা
ফড়িংয়ের ডানা ছেড়ে দেয় বাগানের
ঘাসের বিস্তারে আর
যুদ্ধফেরত স্বাধীনতার
ক্রাচে ভর দেওয়া সৈনিকেরা লাফিয়ে লাফিয়ে
ফড়িংটাকে হাঁটতে দেখে
সোল্লাসে তালি
বাজাবে

প্রতিশ্রুতিগুলো
কোনো প্রতিশ্রুতির ওপর তোমার আস্থা নেই আর
তুমি বলবে: ‘প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ
করাই হচ্ছে নিয়ম’
যদি বলি, শপথ এই প্রবল রাত্রির বৃষ্টির
শপথ, শপথ আমাদের
গানপাগল নদীগুলোর শপথ
বৈশাখের আকাশের
কালো মেঘগুলোর শপথ
তুমি বলবে: ‘এসব কথায় চিড়ে ভিজবে না’
তাহলে গ্রহণ করো
এই গোলাপটি।
এই জগদ্বিখ্যাত পুষ্প কথার বরখেলাপ করে না
সে তার কথা রাখবে।
সে কিছুটা সৌরভ বিলিয়ে
ম্লান হয়ে অস্ত যাবে তোমার
হাতের তালুতে, প্রিয়তমা।
কেউ তো তার কথা রাখবে।

হত্যার স্মৃতি
বহুবার আমি বাল্যকালে ফড়িংয়ের ডানা ছিঁড়ে
ছেড়ে দিয়েছি ফুটবল খেলার মাঠে। ঘাসের মধ্যে
ফড়িংটা লাফিয়ে লাফিয়ে হেঁটে গেছে
ক্রাচে ভর দেয়া আহত সৈনিকের
মতো তার ভবিতব্যের দিকে। এয়ারগানের
ট্রিগার টিপে ছড়িয়ে দিয়েছি ছররা
কাকগুলোর শরীরে। কা-কা করতে করতে
সেই সব কাক লুটিয়ে পড়েছে কলকাতার
ফুটপাতে। এখন যদিও আমি পিঁপড়েদের
পক্ষ অবলম্বন করছি, একদা অসংখ্য
পিঁপড়ে পিষে গেছে নটিবয় শুয়ের তলায়।
এই সব হত্যার স্মৃতি হঠাৎ হানা দিল
সেদিন দুপুরবেলায়, আমার ছায়াচ্ছন্ন কৈশোরে।

মৃত্যু
আমাদের প্রত্যেকের মাংসের গভীরে
বসবাস করেন
একজন গায়ক পক্ষী।
একদিন
হঠাৎ বাতাসে
উড্ডীন হয়ে
কোথায় যেন চলে যান
সম্ভবত অন্য কোনো
সতেজ বৃক্ষের ডালে। আমাদের মৃত্যু হয়।

প্রার্থনা করেছি আমি উত্থান তোমার কণ্ঠস্বরের
আমার পেছনে যতগুলো সাঁকো ছিল
একে একে ভেঙে পড়ছে।
এই ভাঙনের শব্দ থেকে আমি
কেবল নিস্তার চেয়ে
প্রার্থনা করেছি তোমার কণ্ঠস্বরের উত্থান

অনেক হত্যার সাক্ষী আমার আহত চোখজোড়া
তাদের অন্বিষ্ট আজ
বন্য মোরগের মতো গহন বনের দুর্গ,
যেখানে শিকারি তার
বন্দুকের নল নিয়ে পৌঁছুবে না কোনো দিন।
সেইমতো আমাকে অন্তত দাও
তোমার চুলের তিমিরাচ্ছন্ন আড়াল।
আমাকে শোনাও
ইমন কল্যাণ কিংবা আশাবরি—
আমাকে নিস্তার দাও ভাঙনের শব্দ থেকে
আমাকে নিস্তার দাও

প্রতিদিন কয়েক শ মানুষকে
গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে
কেন যে আইখম্যান আপন বাসায় ফিরে এসে
নিপুণ আঙুলে বাজাতেন তাঁর
লিভিং রুমের গ্র্যান্ড পিয়ানোটিকে?
মৃত্যুগামী মানুষের আর্তনাদ থেকে
হন্তারকদের প্রতিনিধি আইখম্যানও কি চেয়েছিল
নিস্তার একদা?

স্বীকার করছি আমি
একদা শিকারিদের সঙ্গে বনে বনে
ঘুরেছি আমিও; কিন্তু আমার স্বজন কিংবা শত্রু
কেউ নিহত হননি
আমার অপাপবিদ্ধ হাতে।
আমি আর কোনো ভাঙনের শব্দ শুনতে চাই না
আমাকে তোমার
সজল চোখের পল্লবের ছায়ার নিচে
একটু দাঁড়াতে দাও।
আমাকে নিস্তার দাও ভাঙনের শব্দ থেকে।

ছুরি-বেঁধা মানুষের চিৎকার
বন্দুকের গুলির শব্দ
ছররা খাওয়া কাকের আর্তনাদ
কারও ঘর ভেঙে পড়ার
মর্মঘাতী আওয়াজ, দেশে দেশে সৈনিকদের
কুচকাওয়াজ, আর কিছু জাহাঁবাজ—
রাজনীতিবিদের উল্লাস ইত্যাদি করাল ধ্বনি
থেকে আমাকে নিস্তার দাও।