বাজান, সদর কত দূর

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘মা, পানি পানি।’ মা বলে, ‘ঘুমাতো বাজান। কুতায় পানি।’ মা নূরজাহান বেগম চোখ বন্ধ করেই বলে। পানি পানি শুনে বাবারও ঘুম ভেঙে যায়। বাবা রহিস আলী বলে, ‘ঘুমাই ঘুমাই কথা বলা আর গেল না তোমার পোলার।’
এর কিছুক্ষণ পর ছেলে নান্টু ঘুমিয়ে পড়েছিল। শেষ রাতের দিকে আবার সে চিৎকার করে ওঠে। ‘মা, আমার বালিশ ভিজা গেছে। ঘরে পানি ঢুকতাছে।’ নান্টু উঠে দাঁড়ায়।
‘বাবা, তাড়াতাড়ি ওঠো। ঘরে পানি আসতাছে।’ বাবার নাক ডাকছে। গভীরভাবে ঘুমাচ্ছে সে। মায়ের ঘুম ভেঙে গেল। সে-ও উঠে দাঁড়িয়েছে।
‘এই যে নান্টুর বাবা। ওঠেন। ওঠেন।’
মাটির ঘর নান্টুদের। বিছানা পেতে মাটিতেই শোয় তারা। ছোটমতো একটা বারান্দা আছে। সেখানে থাকে একটি ছাগল। বেশ কয়েক দিন হয় দুটি বাচ্চা হয়েছে।
ছাগলটা অনবরত ভ্যা ভ্যা করছে। মায়ের সঙ্গের বাচ্চা দুটিও ভ্যা ভ্যা করছে।
একটি কুকুরও আছে তাদের। নান্টু তার নাম দিয়েছে বাঘু। সেটাও ঘেউ ঘেউ করছে।
এর মধ্যে রহিস আলীর ঘুম ভেঙে গেছে। ‘হায়, হায়, সর্বনাশ হইয়া গেছে। ঘর তো দেহি ভাইসা গেল!’
নান্টুর মা কাঁথা-বালিশ গোছানোর কাজে ব্যস্ত। নান্টু একটি বেঞ্চিতে বসে আছে। তার কোলে দুটি ছাগলের বাচ্চা।
সকাল হয়েছে। নান্টুর মা কান্নাকাটি শুরু করে। ‘হায় আল্লাহ, আমার পাঁচ কেজি চাইল ডুইবা গেল। অহন কী খামু?’
ছাগলটি ভ্যা ভ্যা করছে। কুকুরটা লাফিয়ে উঠেছে বেঞ্চির ওপর।
রহিস আলীর ছোট একটি কোষা নৌকা আছে। নৌকা নিয়ে সে মাছ ধরে। ভোরবেলা যায় মাছ ধরতে। সেই মাছ বাজারে বিক্রি করে চাল-ডাল কেনে। কিন্তু আজ আর তা হলো না।
রহিস আলী বললে, ‘নায়ে ওঠো।’ নান্টুর মা নায়ে ওঠে। ছাগলটা ওঠাল। নান্টু উঠল ছাগলের বাচ্চা নিয়ে। নায়ে হাঁড়ি-পাতিল তোলা হলো। কাঁথা-বালিশ তোলা হলো। নায়ে আর জায়গা নেই। কুকুরটা কুঁই কুঁই করছে।
‘আমরা কই যাইতাছি বাজান?’
‘জানি না রে বাপ!’
‘বাজান! বাঘুরে নিবা না?’
‘মানুষ যাইতে পারে না, কুত্তা লইয়া চিন্তা তোর।’
নান্টুর চোখে পানি এসে যায়। ‘বাজান ওরে নিয়া চলো। নায়ে জায়গা অইব। আমি বাঘুরে কোলে নিয়ে বইসা থাকব নে।’ নান্টু কুকুরটার দিকে হাত বাড়ায়। আর কুকুরটা লাফিয়ে ওঠে নৌকায়।
চারদিকে থই থই পানি। বাড়িঘর ডুবে গেছে। নান্টুর মা বলে, ‘এমুন বন্যা জীবনে দেহি নাই। দুই দিনে সব ভাইসা গেল।’
‘মা, খিদা লাগছে।’ নান্টু বলে।
নান্টুর মা একটা পলিথিন থেকে মুড়ি বের করে। ‘নান্টুর বাবা, এই মুড়ি ছাড়া আর কিন্তু কোনো খাওন নাই।’
নান্টু মুড়ি মুখে দেয়। তার হাত থেকে ছাগলের বাচ্চা দুটিও মুড়ি খায়। ছাগলটাও। বাঘু জিব বের করে আছে। নান্টু বাঘুকেও মুড়ি দেয়।
‘সব খাওয়াইস না বাবা। তোর বাজানের জন্য কিছু রাখ।’ কথা শুনে রহিস আলী বলে, ‘আমার খাওন লাগব না নান্টুর মা। তুমি খাও। আমি সদরে যাইয়া খামুনে।’
নৌকাটা ডুবু ডুবু অবস্থা। নান্টুর বাবাকে কয়েকবার পানি সেচতে হলো। হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। বাঘু আকাশের দিকে মুখ উঁচু করে কয়েকবার ঘেউ ঘেউ করে। তারপর লেজ গুটিয়ে নান্টুকে ঘেঁষে দাঁড়াল। নান্টু বাচ্চা দুটিকে জড়িয়ে ধরে আছে। বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাজান, সদর আর কত দূর?’
বাবা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘প্যাট প্যাট করিস না তো!’
ভিজে চুপসে গেছে সবাই। ছাগলের বাচ্চা দুটি ঠান্ডায় কাঁপছে।
‘মা, আমরা সদরে কাগো বাড়ি থাকুম?’ নান্টু প্রশ্ন করে মাকে। ‘তা তো জানি না বাবা।’ মা বলে।
‘বাজান, আমরা কুথায় থাকুম?’
বাবা আরও ক্ষেপে যায়। ‘আবার কথা কস!’
বৃষ্টি থেমে গেছে। ছাগলটা একটা শাপলা পাতায় মুখ দিতে গিয়ে ধুপুস করে পড়ে যায় পানিতে। সঙ্গে সঙ্গে নান্টুর বাবা লাফিয়ে পড়ে। তারপর পাঁজাকোলা করে নৌকায় তোলে ছাগলটা।
‘বাজান, ছাগলের খুব খিদা লাগছে।’
‘খালি ছাগলের কথা ভাবলে অইব? তোর মায়ের খিদা লাগে নাই? আমার লাগে নাই?’
দুপুর পার হয়ে যায়।
নান্টু আবার বলে, ‘বাজান, আর কত দূর?’
নান্টুর মা বলেন, ‘নান্টুর বাপ। সদরে গেলে কি আমরা রিলিফ পামু?’
রহিস আলী কোনো উত্তর দেন না।
ছাগলটা মুড়ির খালি পলিথিনটা চিবুতে থাকে।
নান্টু আর নান্টুর মা করুণ চোখে সেদিকে তাকায়।
প্রচণ্ড রোদ উঠেছে। গরমও পড়েছে ভীষণ। রহিস আলী সামনে তাকিয়ে লগি ঠেলছে। তার কালো পিঠ বেয়ে ঘাম ঝরছে।
রহিস আলী শুনেছে, সদরে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে বন্যায় ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়া লোকজন আশ্রয় নিয়েছে। খাওয়া-দাওয়া ফ্রি। সেদিকেই ছুটছে তার ডুবু ডুবু নৌকাটি।