বীর ও বীরত্বের ইতিহাস-গাথা

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। ছবি: অমিয় তরফদার
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। ছবি: অমিয় তরফদার

মুক্তিযুদ্ধের নায়কেরা গ্রন্থের সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বইটির প্রকাশ-পরিকল্পনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘ভূমিকা’য় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘকালের স্বাধিকার আন্দোলন ও সংগ্রাম রূপান্তরিত হয় মুক্তিযুদ্ধে। এর প্রকৃত নায়ক এ দেশের সাধারণ মানুষ। কিন্তু যুদ্ধের সূচনা, পরিকল্পনা, লড়াই ও বিজয়ের পেছনে রয়েছে বিচিত্র ঘটনাধারার এক যোগফল। তাতে দেশের মানুষ তো অবদান রেখেছেনই, অনেক বিদেশিরও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অনুপ্রেরণা। রাজনীতি, কূটনীতি, যুদ্ধক্ষেত্র, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র, আন্তর্জাতিক অঙ্গন—নানা ক্ষেত্রে নানা ব্যক্তির অংশগ্রহণ ও অনুপ্রেরণা এই যুদ্ধে আমাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল। তাঁদের মধ্য থেকে নির্বাচিত কয়েকজনের অনন্য কাহিনি নিয়ে এ বই।’

বইয়ের শিরোনাম দেখেই প্রচণ্ড কৌতূহল বোধ করি। কেননা, এই বইয়ের পাতায় পাতায় আছেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহত্তম নায়কেরা।
বইটি শুরু হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দিয়ে। ‘বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে তাঁর সম্পর্কে নিবন্ধটি লিখেছেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তাঁর নিবন্ধটি এ বইয়ের অন্যান্য নিবন্ধের মতোই পরিসরে ব্যাপ্ত না হলেও শেখ মুজিব সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণ, তাঁর পূর্বাপর ভূমিকা সম্পর্কে লেখক যখন বলেন, ‘...টুঙ্গিপাড়ার সমাধি থেকে বেরিয়ে এসে তিনি পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন সারা বাংলাদেশে। যে বাংলাদেশের তিনি স্থপতি, সে বাংলাদেশের বস্তুগত অর্জনের প্রশংসা আজ পৃথিবীব্যাপী ধ্বনিত।’—তখন জাতির পিতাকে মনে করে মন আপনাআপনি শ্রদ্ধাবনত হয়ে ওঠে।
‘মুক্তিযুদ্ধের উজ্জ্বল নক্ষত্র’ তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে লেখাটি নিবন্ধটি লিখেছেন তাঁর মেয়ে শারমিন আহমদ। তাঁর মত এমন: ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা। তাজউদ্দীন আহমদ সেই প্রেরণাকে প্রবাহিত করেছিলেন সুনির্দিষ্ট পথে। পাকিস্তান কারাগারে অন্তরীণ বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাজউদ্দীন তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সাংগঠনিক দক্ষতা দিয়ে শক্তি সঞ্চার করেছিলেন এক আপসহীন স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে।’ পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তাঁর কৃচ্ছ্রতাপূর্ণ জীবন, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিরোধে তাঁর প্রয়াসের কথাও শারমিন তুলে ধরেছেন সুচারুভাবে।

>মুক্তিযুদ্ধের নায়কেরা
সম্পাদক: সাজ্জাদ শরিফ
প্রচ্ছদ: অশোক কর্মকার, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা,
প্রকাশকাল: জুলাই ২০১৭, ৯৬ পৃষ্ঠা, দাম: ২০০ টাকা।
মুক্তিযুদ্ধের নায়কেরা
মুক্তিযুদ্ধের নায়কেরা

সুলতানা নাজনীন ‘বীরশ্রেষ্ঠর অমর গাথা’ নিবন্ধে তুলে এনেছেন মুক্তিযুদ্ধের বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের বীরত্বসূচক আত্মত্যাগের কথা।
আসিফ নজরুল লিখেছেন ‘ব্যতিক্রমী সেক্টর কমান্ডার’ নিবন্ধে মুক্তিযুদ্ধে মেজর জিয়াউর রহমানের পূর্বাপর ভূমিকার কথা।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লিখেছেন ‘প্রবাসে উজ্জীবিত বাঙালি’ শীর্ষক নিবন্ধে মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে ব্যক্তিগতভাবে তাঁর ও প্রবাসী বাঙালিদের জাগর ভূমিকার কথা।
মহিউদ্দিন আহমদ ‘মুক্তিযুদ্ধের ধাত্রী’ নিবন্ধে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর চ্যালেঞ্জিং ও সাহসী ভূমিকার কথা তুলে ধরেছেন প্রায় সবিস্তারে।
এই বইয়ের আগ্রহোদ্দীপক নিবন্ধ ভি কে সিংয়ের লেখা ‘যুদ্ধের মূল পরিকল্পনাকারী কে’ নামের নিবন্ধটি। এতে তুলে ধরা হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান স্যাম মানেকশর পূর্বাপর ভূমিকার কথা।
মঈদুল হাসানের ‘কূটনীতির এক গোপন পর্ব’ নিবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দুই ভারতীয় শীর্ষ কূটনীতিক পি এন হাকসার ও ডি পি ধরের ভূমিকা।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা সুবিদিত। দেশটির জাতিসংঘে স্থায়ী প্রতিনিধি ইয়াকফ মালিক আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, তার প্রায় বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন ‘একাত্তরের সোভিয়েত বন্ধু’ নিবন্ধে হাসান ফেরদৌস।
শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির পালিত ভূমিকার কথা মফিদুল হক তথ্য সহযোগে যেভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর ‘বাংলাদেশের জন্য এক মানবতাবাদী সিনেটর’ নিবন্ধে, তার পাঠে মন আলোকিত হয়ে ওঠে।
মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গও। শরণার্থী শিবির ঘুরে তিনি লিখেছিলেন তাঁর সেই বিখ্যাত মর্মস্পর্শী কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। সুরারোপ করাও হয়েছিল। এই একটি কবিতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মার্কিন জনগণের সহানুভূতি অর্জনে কী পরিমাণ ভূমিকা রেখেছিল, আজ তা সত্যিই ইতিহাসের উপাদান। ‘কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের অনন্য রূপকার’ শীর্ষক সাজ্জাদ শরিফের এই নিবন্ধ আমাদের অনেক অজানা তথ্য জানায়, বিশেষত অ্যালেন গিন্সবার্গের ভূমিকা সম্পর্কে।
এই বইয়ের সর্বশেষ নিবন্ধ লুৎফুল হকের ‘ফরাসি লেখকের প্রতিবাদী কণ্ঠ’। ফরাসি চিন্তাবিদ অঁদ্রে মালরো সম্পর্কে লেখা এই নিবন্ধ আমাদের জানাচ্ছে, কী গভীর সহানুভূতিশীল ছিলেন তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি। ৬৯ বছর বয়সে তিনি যোগ দিতে চেয়েছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের পক্ষে সেই বুদ্ধিজীবীরাই কথা বলার অধিকার রাখেন, যাঁরা বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। আমি মুক্তিবাহিনীর অধীন একটি দল পরিচালনার দায়িত্ব চাই।’ কী গভীর বোধসিক্ত উচ্চারণ!
সব মিলিয়ে সাজ্জাদ শরিফের এ বইয়ের পরিকল্পনা ও সম্পাদনা সত্যিই প্রশংসনীয়। বইটি পাঠককে নতুন অনেক তথ্যের জোগান দেবে।