সং+সার

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শেষ হয়েছে ঈদ। তবে আনন্দের রেশ রয়ে গেছে এখনো। এ সংখ্যায় থাকছে তিনটি রসগল্প

ঝুমুর আমার দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে আছে। টেলিভিশনে দেখেছিলাম, মায়া হরিণ ধরার আগে এভাবেই তাকিয়ে থাকে বাঘ। এই সাতসকালে মায়া হরিণ হওয়ার ইচ্ছে নেই আমার। চোখ সামান্য খুলে ওকে দেখছিলাম। এখন তা বন্ধ করে ঘুমিয়ে থাকার ভান করি। আমার চোখ খুবই ছোট। এই চোখ কখন সামান্য খুলল, বন্ধ হলো—তা ঝুমুরের লক্ষ করার কথা নয়। এটা ভেবে একটু নিশ্চিন্ত হই। তখনই ঝুমুর গাছের আম গুঁতানোর মতো করে খোঁচা মারে আমার মুখে।

বিস্ময়াহতভাবে বলি, ‘কী হয়েছে!’

‘চোখ বন্ধ করসো কেন!’

‘কখন করলাম?’

‘ফাজলামো করো।’

ঝুমুর ঝামটা মেরে ঘুরে বসেছে। আমি শুয়ে থেকেই হাত রাখি ওর পিঠে। সে হাত সরিয়ে দেয়। অবাক হয়ে দেখি, তার পিঠ কাঁপছে থরথর করে। উঠে করুণ গলায় বলি, ‘আবার স্বপ্ন দেখেছ!’

ঝুমুরের পিঠ আরও থরথর করে ওঠে। রিখটার স্কেলে আট মাত্রার ভূমিকম্পের মতো। সে ধরা গলায় বলে, ‘তুমি করসো এসব!’

‘কী সব?’

‘তুমি জড়ায় ধরেসো তাকে!’

‘কাকে!’

‘ওই মেয়েটাকে।’ ঝুমুর কেঁদে ওঠে শব্দ করে, ‘আমি নিজের চোখে দেখসি।’

মানুষ তো নিজের চোখেই স্বপ্ন দেখে। কিন্তু ঝুমুরকে এটা বলা যাবে না। আমি বরং বোকার মতো ভাব ধরে থাকি, ‘তুমি আমাকে কিছু বললে না কেন তখন?’

‘বলছি তো। আমি ডাকসি তোমাকে। তুমি শোনোনি!’

‘বলো কী! এত সাহস আমার!’

করুণভাবে মাথা নাড়ে ঝুমুর। এতই সাহস আমার।

নুয়ে পড়া গলায় বলি, ‘সরি ঝুমু। আর করব না এমন!’

ঝুমুর তবু বর্ষার মেঘ হয়ে থাকে। তাকে আমি আগে বুঝিয়েছি কয়েকবার। স্বপ্ন মানে স্বপ্ন। সে মন দিয়ে শোনে। তারপর স্বপ্ন দেখে একই কাণ্ড করতে থাকে।

নতুন করে আজকে বুঝিয়ে লাভ নেই। বাথরুমে যেতে হবে আমার। আমি সজলের সোনার দোকানের ম্যানেজার। আমি না যাওয়া পর্যন্ত দোকান খোলে না। তবে শুক্রবার দেরি করে গেলেও হয়। কিন্তু আজ এই পরিস্থিতিতে দেরি করার কোনো মানে নেই।

আমরা থাকি দোতলার ছোট্ট এক রুমের ফ্ল্যাটে। আলাদা বাথরুম আছে, রান্নাঘর আছে। হয়ে যায় আমাদের। সেই বাথরুমের দরজা বর্ষাকালে ভেজা পাউরুটির মতো হয়ে যায় কিছুটা, ঠেলে বন্ধ করা যায় না। বন্ধ করার দরকারও পড়ে না আমাদের।

বাথরুম করতে করতেই টের পাই, ঝুমুর দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ভাগ্যিস ছোট বাথরুম করছি। সেটা শেষ করে সবে বদনাটা হাতে নেব, ঝুমুর কঠোর গলায় বলে, ‘কী করো তুমি!’

‘মনে হয় বড় বাথরুম—হাগু!’

‘মনে হয় মানে কী! ঠাট্টা করো আমার সাথে!’

আমি আর কথা বাড়াই না। যথাসম্ভব গম্ভীর চেহারা করে চা বানাই, শুধু ঝুমুরের জন্য বানাই। তারপর দুটো টোস্ট বিস্কুট পিরিচে দিয়ে রাখি তার সামনে। কাপড়চোপড় পরি। ঝুমুর স্থির চোখে সবকিছু দেখে। কাপড় পরা শেষ হলে ‘যাচ্ছি আমি’ বলে দ্রুত দরজার দিকে পা বাড়াই।

ঝুমুর ছুটে এসে জাপটে ধরে আমাকে, ‘রাগ করসো!’

কিছু বলি না। ঝুমুরের চোখে শিশিরের জলকণা। একটা ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে চোখ দিয়ে। আমার কাঁধে হাত রাখে সে, ‘আর করব না।’

আমি সোনার দোকানের দিকে পা বাড়াই। সেখানে খামোখা আসি আগে আগে। সকালের দিকে সোনা কিনতে আসে না কেউ। আসে টারসেল লাগাতে, সোনা ধুয়ে নিতে, কিংবা এমনি এমনি নেড়েচেড়ে দেখতে। সোনার দোকানে এসি আছে। মার্কেটে ঘুরে আগুন হয়ে একটু এসি খেতেও কেউ কেউ আসে।

সোনার দোকানে বেশি আসে মেয়েরা। এদের দেখে, একটু পরপর চা বা মুড়ি মাখা খেয়ে সময়টা ভালোই যাওয়ার কথা। তবু এখানে মন বসে না আমার। সোনা ব্যবসা মানে চালাকি। এই চালাকি ভালো লাগে না। আমি ছিলাম চাচার গার্মেন্টসের শিফট–ইন–চার্জ। গার্মেন্টস মানে বড় একটা দরজির দোকানের মতো কিছু। সাব–কন্ট্রাক্টিংয়ের কাজ হতো এখানে। রানা প্লাজার ঘটনার পর তাদের কাজ পাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। চাচা সব বন্ধ করে কানাডা চলে গেছেন, ছেলের কাছে।

কয়েক মাস বেকার থেকে বন্ধুর দোকানে কাজ নিয়েছি আমি। ঝুমুরকে বিয়ে করেছি চার মাস হলো। সিনেমার নায়িকার মতো দেখতে একটা মেয়ে। তার ছবি দেখামাত্র পাগল হয়ে বিয়ে করেছি। ওর সবই ভালো, কিন্তু স্বপ্ন দেখে দেখে কী যে কাণ্ড শুরু করে সে! তার প্রতিটি স্বপ্ন আমাকে নিয়ে। প্রতিটি স্বপ্নে কাউকে না কাউকে জড়িয়ে ধরি আমি। আমি! যে আমি জীবনে কোনো দিন কোনো মেয়ের হাত পর্যন্ত ধরতে পারিনি সাহস করে!

তবু ভালো, স্বপ্নগুলো থামে এখানে। তবু ভালো, এটুকু দেখে ঘুম ভেঙে যায় তার। না হলে কী যে অবস্থা হতো, এটা ভেবে গলা শুকিয়ে যায় আমার। এমন তো হতে পারে, আরও কিছু দেখল সে একদিন স্বপ্নে! গর্ভবতী কাউকে দেখল হাত ধরে হাঁটছে আমার! কিংবা গর্ভবতী হওয়ার আগের কর্মকাণ্ড!

আমি নিশ্চিত, খুনই করে ফেলবে সে সেদিন আমাকে।

২.

ঝুমুরকে অনেক কষ্টে ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি করাই। মানসিক ডাক্তার বললে সে যাবে না হয়তো। তাকে স্বপ্নবিশারদের কথা বলি। স্বপ্নবিশারদ ডাক্তার স্বপ্নের মানে বলে দিতে পারে। আমি প্রায়ই স্বপ্ন দেখি ন্যাংটো হওয়ার। এর মানেও জানা দরকার। এসব শুনে সে রাজি হয়েছে।

ধানমন্ডিতে নামকরা এক ডাক্তারের কাছে এনেছি তাকে। সেখানে বসে অপেক্ষা করছি। আমাদের উল্টো দিকে বিরাট দাড়িওয়ালা এক লোক বারবার তাকাচ্ছে ঝুমুরের দিকে। ঝুমুর ভয়াবহ রূপসী মেয়ে। কিন্তু বুড়ো এ জন্য তাকাচ্ছে না তার দিকে। এ জন্য তাকালে ঝুমুরের দিকে তাকিয়ে বারবার টাটা বাইবাই বলে হেসে উঠত না।

আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, ঝুমুরও তাকে উত্তরে টাটা বাইবাই বলে চলেছে। ডাক্তারের ওয়েটিংরুমে লোকজন মুগ্ধ হয়ে দেখছে এসব। বিপুল আনন্দেই হয়তো একটা ছোট বাচ্চা হাততালি দিয়ে ওঠে হঠাৎ। অসহ্য লাগে। ঝুমুরকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বাইরে চলে যাই সিগারেট খেতে। ফিরে এসে দেখি, ঝুমুর বুড়ো লোকটার পাশে বসে আছে। বুড়োর পাশের দশাসই মহিলার সঙ্গে গল্প করছে।

ঝুমুরের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করি। সে পাত্তা দেয় না। তাতে অবশ্য কিছু আসে-যায় না। তাদের বাইবাই করা থেমেছে। এতেই খুশি হয়ে থাকি।

এর আগে আমি পাগলের ডাক্তার দেখিনি। সামনে একজন পুরো টাকমাথা, লালচে চেহারার লোক বসা। তাকে দেখলে আর যা-ই হোক ডাক্তার মনে হবে না। তিনি হাসিমুখে বলেন, ‘নাম কী?’

‘আবিদুর রহমান।’

সামনে থাকা একটা কাগজ দেখে অবাক হন তিনি। বলেন, ‘ঝুমুর আক্তার কে?’

গাধা শ্রেণির ডাক্তার মনে হচ্ছে। আমি ঝুমুর আখতারকে দেখিয়ে বলি, ‘উনি!’

‘ও আচ্ছা!’ যেন এতক্ষণে তিনি যেন বুঝতে পারেন, আমি ঝুমুর আখতার না। ওর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলেন, ‘কী সমস্যা আপনার?’

‘সমস্যা নাই তো!’

ডাক্তার বলেন, ‘শরীর ভালো আপনার?’

ডাক্তারের পেছনে একটা কঙ্কালের ছবি। তির চিহ্ন দিয়ে কঙ্কালের হাড্ডিগুড্ডির নাম লেখা। ঝুমুর মন দিয়ে তা দেখে কিছুক্ষণ।

তারপর ডাক্তারকে সরাসরি বলে, ‘আপনি স্বপ্নের ডাক্তার?’

ডাক্তার আবারও হাসেন। বোধ হয় হাসির রোগ আছে তার।

ঝুমুর বলে, ‘কী ডাক্তার আপনি?’

‘মানসিক ডাক্তার।’

‘মানসিক ডাক্তার মানে কী? পাগলের?’

‘না না, তা হবে কেন? এটা বলে ডাক্তার আমার দিকে সমর্থনের জন্য তাকান। আমি প্রবলবেগে মাথা নাড়িয়ে সমর্থন করি। কিন্তু কাজ হয় না তাতে।’

আমার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকায় ঝুমুর। ঘাবড়ে যাই আমি। হড়বড় করে বলি, ‘আমি খুব আজেবাজে স্বপ্ন দেখি! কাপড়চোপড় থাকে না গায়ে! পুরা ন্যাংটা!’

ডাক্তার অবাক হয়ে তাকান আমার দিকে। বলেন, ‘রোগী কে?’

 ‘আমি! আমি!’ আমি শুদ্ধ করে বলি, ‘আমরা দুজনই।’

এক টানে উঠে দাঁড়ায় ঝুমুর। বলে, ‘আমি রোগী না।’

সে তার ব্যাগ দিয়ে বাড়ি মারে আমার মাথায়। তারপর ছুটে বের হয়ে যায়।

৩.

গুনগুন করে গান গাইছে ঝুমুর। ওর গানের কথা কখনো বুঝতে পারি না আমি। এত আস্তে গায় যে শুনতে হলে কাছে যেতে হবে। কাছে গেলেই সে থেমে যাবে, তাকাবে রাগী চোখে। তার চেয়ে চুপচাপ জানালার দিকে চোখ রেখে বসে থাকি আমি।

আমাদের রুমের একটাই জানালা। সেই জানালার দৃষ্টি থেমে গেছে মরচে ধরা টিনের এক দেয়ালে। দেয়ালের অন্য পাশ থেকে কারও খুনখুনে কাশির শব্দ শোনা যায় দিনরাত। সেই শব্দ বাঁচিয়ে ঝুমুরের গান শোনা বর্ষার কাদায় বকুল ফুল কুড়ানোর চেয়েও কঠিন কিছু।

জানালা বন্ধ করে দিই আমি। তখনই ঝুমুর বলে রাগত গলায়, ‘উঠলে কেন তুমি! বলেছি না চুপচাপ বসে থাকতে।’

‘হয়নি তোমার!’

‘কীভাবে হবে!’ কোমরে দু-হাত রেখে বলে ঝুমুর, ‘যা গিদড় তুমি। এ কদিনেই যা অবস্থা করেসো বাসার!’

কথাটা পুরোপুরি ভুল বলেনি ঝুমুর। গত কয়েক দিন তাকে খুঁজতে খুঁজতে জান বের হয়ে গেছে আমার। পিরোজপুরে ওর বাবা-মা থাকেন। তাঁদের কিছু জানাইনি। কিন্তু ঢাকায় ওর যত বন্ধুকে চিনি, সবাইকে ফোন করেছি। ওর এক দূর সম্পর্কের মামা আছেন লালমাটিয়ায়। তাঁর বাসায় গিয়েছি। তাঁরা কিছু বলতে পারেননি।

ঝুমুরের জন্য চানখাঁরপুলে এক পীর বাবার কাছেও গিয়েছিলাম। তিনি হারানো জিনিস খুঁজে বের করতে পারেন। ডিম বা চালপড়া দেন, সেটা সবাইকে খাওয়াতে বলেন। চালপড়া দিলে চোরের সারা শরীরে বুটি ফুটে ওঠে। ডিমপড়া দিলে চামড়া ফুলে ওঠে ডিমের মতো। ডিমপড়াতেই আমার আগ্রহ ছিল বেশি। কিন্তু আমার হারানো গেছে বউ। কাকে আমি চাল বা ডিম খাওয়াব।

রাতে বাসায় ফেরার পর রান্না করতে ইচ্ছে হতো না। রুটি-কলা খেয়ে খেয়ে দিন গেছে। সেই কলার খোসা কালচে হয়ে সেঁটে আছে মেঝেতে। তিন দিন পর সে তার এক বন্ধুর সঙ্গে ফিরে এসেছে বাড়িতে। তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছি আমি। তখন সে নাক কুঁচকে বলেছে, ‘কী অবস্থা করে রাখসো বাসার!’

বন্ধুকে বিদায় করেই ঘর পরিষ্কার করতে লেগে গেছে। আমাকে চুপচাপ বসে থাকতে বলেছে। সাবান মাখিয়ে আমাকে নাকি গোসলও করিয়ে দেবে পরে।

তাকে জিজ্ঞেস করি না, কই ছিল। শুধু পরদিন সকালে বের হওয়ার সময় করুণ কণ্ঠে বলি, ‘আর কখনো চলে যেয়ো না।’

ঝুমুর হাসে, ‘আর নিবা পাগলের ডাক্তারের কাছে?’

‘না!’ সজোরে মাথা নাড়ি, ‘কোনো দিন না!’

আমাকে কাছে টেনে নেয় ঝুমুর। সারা শরীরে হাত বোলায়। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আঁতকে উঠে বলি, ‘কী করো এখন!’

সে হি হি করে হাসে।

৪.

সোনার দোকানে ঠিকমতো ডিউটি করিনি তিন-চার দিন। যেতাম দেরি করে, ফিরতামও তাড়াতাড়ি। আজও আমার একটু দেরি হয়ে যায়। দোকানে ঢুকে দেখি, সজল মুখ থমথম করে বসে আছে কাউন্টারে। সে দোকানের মালিক। একসময় আমার বন্ধু ছিল। এখন সম্পর্কটা মনিব গোছের। মনিবের এত তাড়াতাড়ি আসার কথা না দোকানে। প্রথমে সে কিছু বলে না। এক কাপ চা খায়। মুখ মোছে রুমাল দিয়ে। তারপর ভয়াবহ খবরটা জানায় আমাকে—কাল দোকান থেকে খোয়া গেছে জড়োয়ার একটা সেট, রুবি আর পান্না বসানো তিন ভরির সেট; ছোট সেট, কিন্তু এখনকার দামে আড়াই লাখ টাকার ওপরে। দোকান বন্ধের সময় প্রতিদিন গুনে রাখা হয় সবকিছু। কাল গোনার সময় দেখা গেছে সেটটা নেই। দোকান থেকে সঙ্গে সঙ্গে মালিককে জানানো হয়েছে। সে এসে দেখে জড়োয়া সেট নেই, আমিও নেই।

সজল এসব বলে থামে। তারপর স্পষ্ট জানায়, সেট না পাওয়া গেলে আমাদেরই টাকাটা দিতে হবে। সে চলে গেলে আমরা তিনজন পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকি। আড়াই লাখ টাকা আমরা কীভাবে দেব। রহমত হঠাৎ ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। আমি তাকে বলি, ‘চিন্তা করো না, সজলকে বোঝাব আমি।’

সারা দিন দোকানে মন বসে না কারও। দুপুরে খাবার সময় দোকান বন্ধ রেখে আঁতিপাঁতি করে খুঁজি। তিনজন তিনজনের দিকে সন্দেহের চোখে তাকাই। ঝুমুরের সঙ্গে সকালের দুর্দান্ত সময়টা সেই চোরাবালিতে কোথায় হারিয়ে যায়।

বাড়ি ফিরে ঝুমুরকে কিছুই বলি না। ‘শরীর খারাপ’ বলে শুয়ে পড়ি। রাতে সত্যি জ্বরে গা পুড়ে যায়। ঝুমুর আমাকে ধরে ধরে নিয়ে যায় বাথরুমে। ওষুধ খাওয়ায়। মাথায় জলপট্টি দেয় সারা রাত।

গভীর ভালোবাসা নিয়ে দেখি ওকে। ছয় বছর আগে স্কুল থেকে একটা ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল ঝুমুর। দুদিন পর ফিরে এসেছিল। সেই ছেলে তাকে বিয়ে করেনি। হোটেলে রেখে উধাও হয়ে গিয়েছিল। ঝুমুরকে বিয়ে করার সময় এসব জানতাম না আমি। খোঁজাখুঁজি করার সময় ওর এক বন্ধুর কাছ থেকে শুনেছি।

ঝুমুর তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অস্ফুট কণ্ঠে বলে, ‘কী!’

আমি মাথা নাড়ি, ‘কিছু না।’

ভেজা ভেজা দু-ঠোঁটে, কপালে চুমু দেয় ঝুমুর। গালে হাত বুলিয়ে বলে, ‘জ্বর কমে না সোনা!’

ঘরে জোছনার ঘুমপাড়ানি আলো। সেই আলোয় অবাক হয়ে দেখি ওকে। এমন একটা মায়াবতীকে কেমন করে দুঃখ দিয়েছিল ছেলেটা!

৫.

আমার বুদ্ধিতে শেষে ডিমপড়া দিতে রাজি হয়েছিল সজল। কিন্তু ডিমপড়া তাকে দিতে হয়নি। তার আগেই গয়না ফেরত দিয়ে গেছে রহমত। সজল খুশি হয়ে আমাকে ছুটি দিয়েছে। ঝুমুরকে নিয়ে শাকিব খানের ছবি দেখে, সারা শহর রিকশায় ঘুরে রাতে বাসায় ফিরি।

বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ বকবক করি দুজন। জড়াজড়ি হয়ে ঘুমাই। কতক্ষণ পর জানি না, হাত বাড়িয়ে দেখি নেই সে। দরজা ঠেলে বাইরে আসি। দেখি আমাদের এক চিলতে বারান্দায় বসে চা খাচ্ছে ঝুমুর। তার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে সুন্দর চেহারার এক যুবক! ঝুমুর ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখে। কেমন করে যেন হাসে। তারপর সেই যুবকের হাত ধরে সিঁড়ির দিকে রওনা দেয়। অমানুষিক গলায় চিৎকার করে উঠি আমি, ‘ঝুমুর!’

ঝুমুর হতবাক হয়ে উঠে বসে। আমার কপালে হাত রাখে। কী হয়েছে তোমার!

ভোরের অপার্থিব আলো ঝুমুরের সারা মুখে। আমার কপালে হাত রাখা এই ঝুমুরটাই সত্যি, অন্য ঝুমুর নয়।

ঝুমুর বলে, ‘স্বপ্ন?’

আমি মাথা নাড়ি।

ঝুমুরের ভ্রু কুঁচকে যায়, ‘কী স্বপ্ন?’

‘তুমি একটা ছেলের হাত ধরেছ!’

ঝুমুর হাসে, ‘দেখসো তুমি!’

‘আর ধরবে?’

‘সত্যি দেখসো?’

আমি মাথা নাড়ি।

ঝুমুর বালিশ দিয়ে ধাক্কা মারে আমাকে, ‘এত দিন লাগল তোমার দেখতে!’

‘মানে!’

‘এত দিন লাগল!’ ঝুমুর আরও জোরে জোরে মারে আমাকে, ‘আর আমি দেখি এক শ বার!’

হাত-পা কুঁকড়ে কোনোমতে বাঁচাই নিজেকে। বলি, ‘এক শ বার আমারও দেখতে হবে?’

‘হ্যাঁ, দেখতে হবে।’

আমার গালে হাত রাখে ঝুমুর। বলে, ‘ভালোবাসলে দেখে মানুষ এসব!’

ভালোবাসলে আসলেই কি হারিয়ে ফেলার স্বপ্ন দেখে মানুষ? আমি জানি না। কিন্তু ঝুমুরের আবছা মুখের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিই, আরও বহুবার স্বপ্নটা দেখব আমি তাহলে।