বই বনাম ঘোড় দৌড়ের ময়দান
স্কুলে থাকতে ‘র্যাপিড রিডার’ বলে একটা বাড়তি বই আমাদের পড়তে হতো। পড়তে হতো বলাটা ঠিক হলো না। কারণ, বইটিকে পাঠ্যসূচিভুক্ত করার উদ্দেশ্য যদিও ছিল ছাত্রছাত্রীদের দ্রুতপঠনে তালিম দেওয়া, বাস্তবে আমরা এটাকে অন্যান্য পাঠ্যবইয়ের মতোই বিবেচনা করতাম। ফলে দ্রুতপঠন অনুশীলনের আগ্রহ ছাত্র-শিক্ষক কারও মধ্যেই দেখিনি। ব্যতিক্রম হয়তো ছিল, তা ব্যক্তিগত পর্যায়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পর একজন শ্রদ্ধেয় জ্যেষ্ঠ শিক্ষক টিউটোরিয়াল ক্লাসের ফাঁকে আমাদের দু-তিনজনকে দ্রুতপঠনের কিছু কায়দা রপ্ত করানোর চেষ্টা চালিয়েছিলেন। র্যাপিড রিডিং না বলে নবপর্যায়ের এই দ্রুতপঠনের নাম স্পিডরিডিং। একটা ৩০০ পৃষ্ঠার বই তিন ঘণ্টায় শেষ করা ছিল স্পিডরিডিংয়ের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্য প্রথম যে সবক তিনি আমাদের দিয়েছিলেন তা হলো—প্রথাসিদ্ধ পাঠরীতি ত্যাগ করা।
সেটা কেমন? প্রথাসিদ্ধ পাঠনরীতি হলো বই খুলে বাক্যের গোড়ার শব্দটি দিয়ে শুরু করে কমা, ড্যাশ, সেমিকোলন ইত্যাদি উতরে দাঁড়ি বা ফুলস্টপে পৌঁছানো। তারপর আবার নতুন বাক্য ধরে একইভাবে এগোনো। এ রীতি ভাঙার প্রধান সূত্রটি হলো পড়ার সময় দৃষ্টিকে সরলরেখার মতো লাইন ধরে টেনে না নিয়ে কোনাকুনি, আড়াআড়ি চালনা করা। ফলে বাক্যের দুই, তিন, চারটা শব্দের পরই দৃষ্টিকে কোনাকুনি ধাবিত করতে হবে পরের বা তার পরের লাইনে; সেখানেও দুই, তিন বা চারটা শব্দের পর আবার তারপরের বা আরও পরের লাইনে। প্রথম দিকে ধীরে ধীরে, তারপর কিছুদিন যেতে অভ্যাসটা আয়ত্তে আসার পর গতি বাড়াতে হবে। সহজ-সরল বিষয়-আশয়, যেখানে ভাষার অত্যধিক মারপ্যাঁচ নেই, বক্তব্য-বিষয়ও খুব ভারী নয়, সেসব ক্ষেত্রে এই পঠনরীতি নাকি অত্যন্ত কার্যকরী। যে কারণে ৩০০ পৃষ্ঠা খতম করার জন্য তিন ঘণ্টা যথেষ্ট সময়।
কয়েক দিন কসরতের পর ‘আমাকে দিয়ে হবে না’ ঘোষণা দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। একে তো চোখে ব্যথা করত, তার ওপর যত সহজ-সরল বই-ই হোক, কয়েক পৃষ্ঠা ঝোড়ো বেগে এগোনোর পর দেখতাম তেমন কিছু মনে থাকছে না।
আমাদের সেই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক কে এম এ মুনিমকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এতে লাভ কী? আমার সময়ের অভাব নেই, আর পড়তে তো চাই আরাম করে, আর বইটা যদি হয় মজার তাহলে তো রয়েসয়ে—যাতে তাড়াতাড়ি শেষ না হয়ে যায়! জবাবে তিনি বলেছিলেন, এটা একটা কায়দা, কখনো তো এমন হতে পারে, তোমাকে অতি অল্প সময়ে দুটো মোটাসোটা বই পড়ে ফেলতে হবে।
কোনাকুনি পড়ার কায়দাটা স্পিডরিডিংয়ের প্রথম ধাপ। যাঁরা একে রপ্ত করে ফেলেন, তাঁরা যে সব সময় এভাবেই পড়েন তা নয়। স্পিডরিডিংয়ের প্রাথমিক লক্ষ্য মিনিটে ৩০০ থেকে ৫০০ শব্দ পড়ে ফেলা—অর্থাৎ এক থেকে দেড় পৃষ্ঠা। ক্রমে যা বেড়ে দাঁড়াবে ৯০০ থেকে ১ হাজার ২০০ শব্দে। প্রথম দিকে বইয়ের পৃষ্ঠায় বাজপাখির শাণিত দৃষ্টি রেখে চোখ বোলালেই হলো, মূল জায়গাগুলোয় দৃষ্টি ঠিক ঠোকর খাবে। কায়দাটা মোটামুটি রপ্ত হয়ে গেলে দৃষ্টি আপনি লাফিয়ে লাফিয়ে এগোবে। আর এর ফলে আরামে বা ধীরেসুস্থে পড়ার আনন্দ না পাওয়া গেলেও যা পাওয়া যায় তা নাকি এক ভিন্ন আনন্দ, ভিন্ন স্বাদ।
কৌতূহলকর ব্যাপার হলো, পাশ্চাত্যে অল্পবয়সীদের দ্রুতপঠনে প্রশিক্ষণ দিতে ওয়ার্কশপ-সেমিনারেরও আয়োজন করা হয়ে থাকে। প্রিনস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমনি এক সেমিনারে বিশেষজ্ঞ হিসেবে যোগদানকারী একজন স্পিডরিডিং প্রশিক্ষক জানিয়েছেন, তাঁর তত্ত্বাবধানে মাত্র দুই সপ্তায় ২০ জন আন্ডারগ্রেড ছাত্রছাত্রী তাদের পড়ার গতি গড়ে পাঁচ থেকে সাত গুণ বাড়াতে পেরেছে। শুধু পড়া না, বিষয়বস্তু আত্মস্থ করতেও। এতে তাদের প্রচুর সময় যেমন বেঁচেছে, তেমনি অবসরে পঠিত বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনারও সুযোগ তারা পেয়েছে বলে প্রশিক্ষকের দাবি।
যুক্তি যেমনই হোক, দ্বিতীয়বার স্পিডরিডিং আয়ত্ত করার কোনো চেষ্টা আমি করিনি। তবে বিস্মিত হয়েছি অনেকের অবিশ্বাস্য স্পিডরিডিং বা দ্রুতপঠনের অভ্যাসের কথা শুনে বা পড়ে, এমনকি চেনা-জানা দু-একজনের ক্ষেত্রে দেখেও। এর মধ্যে বিশ্বখ্যাত অনেকেই আছেন। আগাথা ক্রিস্টির কথা বহুল আলোচিত। ভদ্রমহিলা বেঁচেছিলেন ৮০ পার করে আরও কয়েক বছর। দীর্ঘ কর্মময় জীবনে গল্প ও উপন্যাস মিলিয়ে লিখেছেন ৪০টিরও বেশি বই, যার বেশ কটাই বেস্টসেলার। লেখালেখির তুঙ্গ পর্যায়ে—যৌবনে ও মধ্যবয়সে আগাথা ক্রিস্টি নাকি বছরে ২০০-র বেশি বই পড়তেন। কিন্তু তাঁকেও যিনি টেক্কা দিয়েছিলেন তিনি একসময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোজভেল্ট; দিনে অন্তত একটা বই পড়তেন এমন জনশ্রুতি রয়েছে।
খোঁজ করলে অনেকের নামই পাওয়া যাবে। তালিকা বড় করার কারণ দেখি না। তবে একজনের কথা বলতেই হয়, রেকর্ড বইতে তাঁর নাম অনায়াসে স্থান পেতে পারে। হ্যারিয়েট ক্লোজনার নামের এই মার্কিন নারীর বিষয়ে এমন কিছু চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া গেছে, যার বদৌলতে তাঁকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ স্পিডরিডার বলাই হয়তো সংগত। পেশায় গ্রন্থাগারিক এই নারী ৩১ হাজারেরও বেশি শুধু আমাজনের বুক রিভিউই করেছেন। যে সময়ের মধ্যে এই অবিশ্বাস্য কীর্তিটি তিনি করেছেন, তাতে প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয়টা বই তাঁর পড়ে ফেলার কথা। অত্যন্ত যান্ত্রিকভাবে হলেও কাজটা কী করে করা সম্ভব এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। উঠেওছিল। জবাবে ভদ্রমহিলা জানিয়েছেন, ছোটবেলা থেকেই দ্রুতপঠনের নানা কৌশলের চর্চা ও অভিজ্ঞতা তাঁকে এতই পারদর্শী করে তুলেছিল, একটা বই—বিশেষত সেটা যদি হতো রোমান্স নভেল-জাতীয় কিছু, তাহলে কিছু দূর এগিয়েই তিনি আন্দাজ করে ফেলতেন গল্প কোথায় কী অবস্থায় গিয়ে ঠেকবে, কোন চরিত্রের ভাগ্যে কী ঘটবে। ফলে বাকিটুকু শেষ করতে দরকার পড়ত দ্রুত পৃষ্ঠা ওলটানো। ফলে শ দেড়েক পৃষ্ঠার একটা বইয়ের জন্য এক ঘণ্টা যথেষ্ট সময়।
এ তো গেল বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিদের কথা। চেনা-জানা দু-একজনের কথা বলি। ঢাকা কলেজে আমার শিক্ষক ও কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানকে ক্লাস নেওয়ার সময়টুকু ছাড়া টিচার্স কমনরুমে সহকর্মীদের আড্ডাবাজির মধ্যেও সারাক্ষণ বইতে ডুবে থাকতে দেখেছি। অনেক বছর পর বইপড়া নিয়ে কথা তুলতে বলেছিলেন তিনি বাছবিচার করে পড়েন না। যে বই পড়া দরকার তা তো পড়েনই, তবে হাতের কাছে তেমন কিছু না থাকলে ধারাপাতও পড়েন—হয়তো কথার কথা। কবি বেলাল চৌধুরীর কথা অনেকেই জানেন। বইপত্রের খোঁজখবর যেমন রাখেন, পড়েনও দেদার। আমার ভারতীয় বন্ধু কানাড় ভাষার খ্যাতিমান লেখক বিভেক সান্ভাগ আমাকে বলেছে, একটা সময় ছিল যখন সে দিনে দু-তিনটা বই অবলীলায় পড়ে ফেলতে পারত। আরেক বন্ধু আফসান চৌধুরীকে একসময় দেখেছি, দিনে গড়ে মাঝারি আকারের দেড়টা বই পড়তে। আবার ৩০০ পৃষ্ঠার খটমট বই এক দিনে শেষ করতেও; শুধু শেষ করাই শেষ কথা নয়, সদ্য পড়া ঢাউস বই নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনায়ও মত্ত থাকতে। তবে কত বেশি বই কত কম সময়ে পড়ে ফেলা যায় এমন জেদ বা বাহাদুরি তাঁর ছিল না। আফসান চৌধুরীর বেলায় যা বিস্ময়কর তা দ্রুতপঠন সত্ত্বেও তাঁর স্মৃতিশক্তির প্রখরতা। জাভেদ আনসারি নামে একজনকে জানতাম, এখন দেশের বাইরে থাকেন, যিনি কাজকর্মের ব্যস্ততা মধ্যেও বইয়েই ডুবে থাকতেন। পড়তেন থ্রিলার, সপ্তায় চার-পাঁচটা বইপড়া তাঁর রুটিনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। যে কয়েকজনের কথা বললাম, এঁরা অতিপঠনে অভ্যস্ত হলেও তথাকথিত স্পিডরিডার নন।
স্পিডরিডিং কি আদৌ পড়া? জীবনে অনেক ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো মানানসই হতে পারে, কিন্তু পড়ার ক্ষেত্রে? পড়া তো কেবল বইয়ের পাতায় নিজেকে ধরে রাখাই নয়, একটা ভালো বই পড়তে গিয়ে অদেখা লেখকের সঙ্গে নীরব যোগাযোগ গড়ে তোলা। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ওলটাতে ওলটাতে সেই কাল্পনিক যোগাযোগকে ধীরে ধীরে পল্লবিত করা। স্পিডরিডিংয়ের ঘোড়দৌড়ে এ কি সম্ভব?