সময়ের কবিতায় সময়হীনতার প্রকাশ

একধরনের কবিতা আছে, যা জন্ম থেকেই দারুণ সাবলীল। যেন ভাব, আবেগ আর অনুভূতির কাব্যিক প্রকাশের মতো সহজ কিছু আর হতে পারে না। কবি যে যুগেরই হোন না কেন, তাঁর কবিতা হয় সব কালের। ‘মৃত একা অপেক্ষা করছে জীবিতের’ বা ‘বুড়ো বৃক্ষ শোন, পাতা ঝরছে খুব বাতাসের ডানায়’—এই সব বিষণ্ন অনুভব, ছেড়ে যাওয়ার শোকের প্রকাশ একুশ শতকের কবি সালেহীন শিপ্রার হাতে হলেও এদের জীবন হয়তো, দুনিয়ার শুরু থেকে শেষ—সব শতাব্দীজুড়ে।
তরুণ কবি সালেহীন শিপ্রার প্রকাশ্যহওয়ারআগে কবিতাসংকলনটির প্রকাশ ২০১৭ সালের মে মাসে। ‘জীবনানন্দ দাশ তরুণ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার’ পেয়ে বই হয়ে বের হয়েছে এটি। বইয়ে আছে পঁয়ত্রিশটি কবিতা। প্রথম কবিতার প্রথম চরণ ‘বেপথু আলোর রশ্মি’, আর শেষ কবিতা শেষ হয়েছে ‘পাখির চোখের জল’ দিয়ে। ‘আলোর রশ্মি’ থেকে ‘চোখের জল’—একটি নাতিদীর্ঘ কিন্তু গভীর আর মায়াময় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হয় বইটি পড়তে গেলে। সহজ, সংক্ষিপ্ত শিরোনামের কবিতাগুলো অপ্রত্যাশিতভাবে স্বাভাবিক। যেন সমস্ত শব্দ, বাক্য নিজেদের স্বভাবে ফুটে আছে। বর্তমানের জটিল জীবন থেকে কি একটু দূরের? প্রকৃতি, প্রেম আর বিরহঘেঁষা অজস্র ‘রোমান্টিক ইমেজ’ ছড়িয়ে আছে পাতায় পাতায়।
‘কম্পিত সুখ, দুঃখগুলোও মুগ্ধ থরোথরো
কারণ তুমিই সে মেঘ করে আসো, বৃষ্টি হয়ে ঝরো…’
(পদ্মপাতায় রাত্রিদুপুর)
নানা ধরনের মগ্নতার স্বাদ দেয় কবিতাগুলো। কখনো নিজের মধ্যে মগ্ন হয়ে যাওয়ার আবেশ সৃষ্টি করে। কখনো দূরে চলে যাওয়া প্রিয় মানুষের স্মৃতির ভেতর হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতি দেয়। আবার কখনো প্রকৃতি, প্রেম আর জীবনদর্শনের আলো-অন্ধকারে ডুবে যাওয়ার সুখ সৃষ্টি করে।
‘কেননা তোমার চুলে মাঝে মাঝেই অন্য অন্ধকারের
গন্ধ লেগে থাকে।’
(বিশ্বাস)
স্মৃতি আর স্মৃতিহীনতার এক অদ্ভুত দোলাচলের দেখাও মেলে একটানা কবিতাগুলো পড়তে গেলে। যেমন, ‘মনে পড়বেই’ আর ‘অন্য পৃথিবী’—এ দুটি পাশাপাশি পৃষ্ঠার কবিতা পরপর পড়তে গেলে একই সঙ্গে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা আর মনে রাখার আগ্রহ চোখে পড়ে। একটা কবিতা ‘ভুলে যাবার মন্ত্রে’র কথা বলে, আরেক কবিতায় ভুলে গেলে পড়ে থাকার ‘নিঃশব্দ’ আর ‘নিঃস্ব’ অনুভূতির কথা আছে। ‘হেমন্ত মুখর’, ‘রক্তফুল’, ‘বন্ধু’ ইত্যাদি কবিতায় মানুষের এই মনে রাখা ও ভুলে যাওয়ার চিরন্তন দ্বন্দ্ব প্রকাশ পেয়েছে বিচিত্র মাত্রিকতায়।

ইংরেজি রোমান্টিক কবিতায় বা আমাদের লোকসাহিত্যের গীত, পদ, পালায় বারবার প্রকৃতিকে ব্যবহার করা হয়েছে মানুষের মনের ভাব, জীবন-মৃত্যু, প্রেম-বিরহভাবনার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপমা হিসেবে। এখনকার যুগের সাহিত্যে সাধারণত এসব উপমা, উৎপ্রেক্ষার ব্যবহারকে আমরা অলিখিতভাবে বর্জনীয়ই ধরে নিয়েছি। কিন্তু মেঘ, বৃষ্টি, ফুল, পাখি আদতে সব যুগের, সব মানুষের এবং এখনকার একজন কবির সম্পূর্ণ অধিকার আছে এই সব সময়হীন উপাদান কবিতায় উপস্থিত করার। সালেহীন শিপ্রা তাই যখন ‘ঘাস’, ‘বৃষ্টি’, ‘গোলাপ’, ‘রোদ’ বা ‘মেঘ’কে আশ্রয় করে একের পর এক কবিতা গড়ে তোলেন, সেসব পড়ে সেকেলে মনে হওয়ার অবকাশ পাওয়া যায় না। বরং অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ—সব যুগে বিচরণের সামর্থ্য নিয়ে কবিতাগুলো আরও জীবন্ত হয়ে ওঠে। ‘যদিও নিজের দোষ, তবু উসিলা খুঁজি আর/ মেঘের বরাতে বলি—ঝরে পড়ার সাহস হলো না বলেই ভাসছি এখনও’। (মেঘের বরাত)

প্রকাশ্যহওয়ারআগের কবিতাগুলোকে চাইলে কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়। ‘প্রবল প্রকাশ্য প্রেম থেকে’ বা ‘স্টেশন’—অন্ত্যমিলসহ কবিতা যেমন আছে, তেমনি পুরোপুরি গদ্যে লেখা কবিতাও রয়েছে। উদাহরণ, ‘গহন’, ‘লাল আলো’, ‘কান্নার আলো’। আছে ‘পুরোনো প্রেমিকে’র মতো নিরীক্ষাধর্মী কবিতাও। ডায়েরি বা চিঠি লেখার ঢঙে ব্যক্তিগত সুরের কবিতা আছে কিছু। আবার ‘পথ’-এর মতো চিন্তাশীল, দার্শনিক, নৈর্ব্যক্তিক কবিতাও দেখতে পাই। ‘বাড়ি ফেরার পথটা কাছে এলেই/ কেমন দীর্ঘ হয়ে যায়’—মানবজীবনের এমন রূপক প্রকাশের উপস্থিতি আসলেই চোখে পড়ার মতো। এই বইয়ের বিচিত্র, বিভিন্ন কবিতা তাই একসঙ্গে থেকেও আলাদা।

প্রকাশ্যহওয়ারআগে

সালেহীনশিপ্রা

প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: মে ২০১৭, ৪৮ পৃষ্ঠা, দাম: ১২০ টাকা।