বিশ্বভরা প্রাণ

দ্বিজেন শর্মা ও দেবী শর্মা, যখন যৌবন। ছবি: সংগৃহীত
দ্বিজেন শর্মা ও দেবী শর্মা, যখন যৌবন। ছবি: সংগৃহীত

গভীর রাতের শেষ, আবছা ভোর, চাঁপা রঙের শাড়ি পরনে... গেট দিয়ে নিঃশব্দে ঢুকি; স্তব্ধ রমনার বৃক্ষরাজি, মেঘলা আকাশ অনেকটাই নেমে এসেছে। এক পা-দুপা হাঁটি, যেমন করে দুজনে হেঁটেছিলাম অনেক দিন, বরিশালে বেলস পার্কের ঝাউ আর পামগাছে শোভিত লাল সুরকির রাস্তায়, পাশে চিকচিকে কীর্তনখোলা। তেমনি চাঁপা রঙের শাড়িটা আজও উজ্জ্বল।

হঠাৎ তীক্ষ্ণ একটা শিনশিনে আওয়াজ বৃক্ষরাজিকে কাঁপিয়ে দিয়ে মিলিয়ে যায়, পরক্ষণেই ঝিরঝিরে কান্না নামে পাতা বেয়ে, পাশের বিশাল গাছ আমাকে টেনে নেয়, বলে, ‘আমার শরীরের এইখানটায় হাত রাখো, এইখানটা সে জড়িয়ে ধরেছিল, এখনো উত্তাপ ছড়াচ্ছে।’

তারপর কিছু বকুলবীথি—কেউ তার কাণ্ডে, কেউ পাতায়; কেউ ফুল বাড়িয়ে দিল। ওপারে কিশোর ডাকাবুকো ম্যাগনোলিয়ার ত্বর সয় না, বড় বড় পাতা অহংকারে গায়ে বুলিয়ে দিল, বুক চিতিয়ে বলল, ‘দেখো, আমার কুঁড়ি এসেছে, আমার তুলনা কে, বলো?’

নাগেশ্বর তার গঠনসৌষ্ঠবে, সুবাসে সমস্ত দিকটা আলো করে দাঁড়িয়ে আছে। কে আমাকে নিয়ে চলল নাগলিঙ্গমের সান্নিধ্যে। সমস্ত শরীরে রাজ-ঐশ্বর্য নিয়ে সদম্ভে দাঁড়িয়ে আছে নাগলিঙ্গম। ওই যে গোল চত্বরটা, পাশেই স্টিলের কেয়ারির ওপর মাধবীলতা, গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলে শোভিত, যেন হেসে উঠল: এ যে প্রিয়তমা! কত প্রতীক্ষা এর জন্য!

প্রত্যেকে যে তার সর্বস্ব দিয়ে সেজেছে। এখন কোন ঋতু, কোন সময়, কোন দিন! কৃষ্ণচূড়া, বোগেনভেলিয়া, জারুল, কেসিয়া—সবাই একেকটি মোমবাতির মতো জ্বলে উঠল। কী উৎসব আজ, ছোট চত্বরটিতে বসে গা এলিয়ে দিলাম, তারপর একটি-দুটি করে বাহারি প্রজাপতি এসে চাঁপা রঙের শাড়ির ওপর বসল, ঢেকে দিল শরীর—কৈশোর-যৌবন-প্রৌঢ়ত্ব। ছোট ছোট পাখিরা নির্ভয়ে এগিয়ে এল—সুকণ্ঠে গান ধরল পাখপাখালি। মিশে গেল একসময় অস্তিত্ব।

চাঁপা রঙের চারদিকে প্রজাপতি এসে ঘিরে ধরেছে। তাকিয়ে দেখি, সমস্ত মহিরুহ আন্দোলিত। তার পাতায়-কাণ্ডে ফুলে ফুলে কিসের শিহরণ! প্রতিটি কণায় বুঝি সেই মানুষটির অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। আজ তাই এই আনন্দের শিহরণ। তারা আত্মস্থ করেছে সেই প্রাণকে। তাই এই আনন্দ উৎসব—‘আকাশভরা সূর্য-তারা/ বিশ্বভরা প্রাণ/ তাহারি মাঝখানে/ আমি...’

১৫সেপ্টেম্বর২০১৭, সিদ্ধেশ্বরী, ঢাকা