রঙে রঙে সুরালাপ

বিভাজন কিংবা সুরক্ষা—যে জন্যই দেয়াল তৈরি হোক না কেন, Ñএ নিয়ে আছে নানান কথা। যুগ যুগ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা এই দেয়াল হয়ে ওঠে ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। ইটের দেয়াল হোক আর মনের দেয়ালই হোক, তার পরতে পরতে থাকে আনন্দ-বেদনার নানান গল্প।
রোদ-বৃষ্টি-ঝড়, দাবদাহ ও ছায়ায় দেয়ালের গায়ে তৈরি হয় গল্পের রঙিন মানচিত্র। কখনো-বা নতুন আস্তর বা নতুন রঙে ঢাকা পড়ে পুরোনো বৃত্তান্ত। দেয়ালে তারপরও শেওলা ধরে এবং শেওলা ধরা সেই দেয়ালে আবার তৈরি হয় ঋতুবৈচিত্র্যের আলপনা। এই নতুন-পুরোনো অস্তিত্বের সুর নিয়ে ক্যানভাসে শিল্পী গল্প সাজান। বিশেষত নির্বস্তুক বা বিমূর্তবাদী শিল্পীদের চিত্ররচনার উৎস-উপাদান দেয়ালের রং, রেখা, টেক্সচার। সংগীতের সুর-লহরির মতো রঙের খেলা আছে এই স্যাঁতসেঁতে দেয়ালে। কথাগুলো বলা রেজা আসাদ আলী হুদা, সবার কাছে িযনি অনুপম হুদা নামে পরিচিত—তাঁর ‘অস্তিত্বের আখ্যান’ শিরোনামের একক িচত্র প্রদর্শনী প্রসঙ্গে।
আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ গ্যালারিতে চলমান প্রদর্শনীতে প্রধানত তিনটি সিরিজচিত্র সজ্জিত হয়েছে। ‘ভূ-দৃশ্য’, ‘দেয়াল বৃত্তান্ত/গল্প’ ও ‘অস্তিত্ব’। এসব সিরিজচিত্রের সঙ্গে সংগতি রেখে ‘অস্তিত্বের আখ্যান’, ‘গীতধর্মী ছবি’, ‘অস্তিত্বের সুর’ ইত্যাদি চিত্র এঁকেছেন তিনি। তেলরঙে একটি ছবি বাদে সব কটিই ক্যানভাসে অ্যাক্রেলিক মাধ্যমে আঁকা। শিরোনামে ভিন্নতা থাকলেও রং, রেখা, টেক্সচারে প্রতিটি ছবিতে আছে ঐক্য। বোঝা যায়, ক্যানভাস শিল্পীর মনের রঙে রঙিন।
গ্রাফিক ডিজাইন বিষয়ে চারুকলায় শিক্ষকতা করছেন অনুপম। টেলিভিশন মিডিয়ার সেট ডিজাইনে তাঁর পদচারণ। তাই তাঁর কাজে ডিজাইনের মূলনীতি যথার্থই দৃষ্টিনন্দন। রং ব্যবহারেও রয়েছে পরিপক্বতা ও পরিমিতি।
বিভিন্ন পুরোনো স্থাপনার দেয়াল থেকে তিনি তাঁর চিত্রের বিষয়বস্তু নির্দিষ্ট করেন এ শিল্পী। বাদ পড়ে না নদী-ভূমি-অরণ্যের রং, রেখা, টেক্সচার। রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, জোছনার বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যানুভূতিতাড়িত রঙের সুর ক্যানভাসে তুলে আনতে চান শিল্পী, যা দর্শকের কাছে নির্বস্তুক (বিমূর্ত) মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে কি নির্বস্তুক? নাকি সচরাচর পরিচিত বস্তুর সঙ্গে মেলানো যায় না বলে বিমূর্ত?
শেওলার সবুজ, সরিষাখেতের হলুদ, সবুজ ধানখেত, নদীর কাদামাটি, বালুচর, বৃষ্টির পানি, ঝরনাধারা, চাঁদের আলো প্রভৃতি প্রাকৃতিক দৃশ্য ও মুহূর্ত অনুপমের হৃদয়ে যে সুর তোলে এবং যেসব রং-রেখা তাঁকে ভাবায়, তা দিয়েই ছবি আঁকেন তিনি। এ যেন প্রকৃতির নানা অস্তিত্বের সারসংক্ষেপ, শিল্পীর চোখে দেখা রঙের সুর।
পানাম নগরী, লালবাগ কেল্লা, মহাস্থানগড়ের প্রাচীর, কুষ্টিয়ার নদী ও সরিষাখেত তাঁর চিত্রজমিনে এসেছে বারবার। শিল্পী সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-ভালোবাসার স্মৃতিময় অনুভূতির রঙে সাজান নিজের ক্যানভাস। এসব যেন তাঁর অস্তিত্ব। মাটির দেয়ালের মধ্যে বাংলার খুঁজে পান ঐতিহ্য। কাঁচা মাটির দেয়ালের মেটে রং, ধূসর হলুদ, মরিচা ধরা টিন, তাঁর ছবিতে যেমন দৃশ্যমান, তেমনই মাটির দেয়ালে বিছিয়ে রাখা রঙিন কাপড় যেন ভিন্ন অনুভূতি দেয়।
তবে অনুপম তাঁর কাজে মোহাম্মদ ইউনুসের করণ-কৌশল, রং, রেখা, টেক্সচার দ্বারা বেশি অনুপ্রাণিত। এ জন্য নির্দ্বিধায় অনুকরণ-অনুসরণ করেছেন। তাই দর্শক কাজগুলোর স্বাতন্ত্র্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে পারেন।
২০০৮ সালে নির্বস্তুক ঘরানার কাজ করতে শুরু করেন অনুপম। একই সময়ে দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে পেয়েছেন পুরস্কার। তাঁর ক্যানভাসে মোহাম্মদ ইউনুসের অনুসরণ উতরিয়ে নিজস্ব শৈলী তৈরি হলে বাংলাদেশের চিত্রকলায় নির্বস্তুক আঙ্গিকে নতুন মাত্রা আসবে বলে আশা করা যায়।
প্রদর্শনীটি চলবে আজ ৬ অক্টোবর পর্যন্ত।