পিতৃতান্ত্রিকতার স্বচ্ছ ছবি

আমাদের সাহিত্যজগতের মনস্বী প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর অতি সম্প্রতি প্রকাশিত প্রবন্ধের বই পিতার হুকুম। এই বইয়ে সংকলিত প্রবন্ধগুলো সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখক তাঁর ‘মুখবন্ধ’-এ বলেছেন, ‘বইটির বারোটি প্রবন্ধের মধ্যে দুটি লিখিত হয়েছিল বক্তৃতার প্রয়োজনে। “ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক পরাজয়” প্রবন্ধটি বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতির সুবর্ণজয়ন্তী (২০১৬) উপলক্ষে আমি পাঠ করেছিলাম। “তব গৃহ নহে অন্ধকূপ”ও একটি বক্তৃতা। এটি ছিল “সেলিনা বাহার জামান স্মারক বক্তৃতা”। সর্বশেষ রচনাটি একটি সাক্ষাৎকার। বিভিন্ন সময়ে লেখা এই রচনাগুলো মিলে একটি বক্তব্য তৈরি করেছে, এই বিবেচনায় সেগুলোকে একত্র করে এ বই। মূল বিষয়টি হচ্ছে পিতৃতান্ত্রিকতা, তাই এই পিতার হুকুম নামকরণ। পিতাই হুকুম দেন, মাতা শোনেন, তা মাতারা যে ভূমিকাই পালন করুন না কেন। ব্যাপারটা এখনো এ রকমেরই।’
মুখবন্ধের পাঠ শেষ করে আমরা যখন বইটির মূলে প্রবেশ করি, অর্থাৎ প্রবন্ধগুলোর পাঠ শুরু করি, তখন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বৈদগ্ধ্যে মুগ্ধ হতে থাকি নিয়ত। চেতনার অনড়তা হোঁচট খেতে থাকে বারবার। ‘ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক পরাজয়’ শিরোনামের প্রবন্ধটি পাঠের পর বুঝি, পিতৃতান্ত্রিকতার স্বরূপ, বিশেষত সাহিত্যের বিস্তৃত পরিসরে কতটা গভীর, দৃষ্টান্তের পর দৃষ্টান্ত দিয়ে সেটি তুলে ধরেছেন লেখক। প্রাচীন গ্রিক সাহিত্য, ভারতীয় পুরাণ থেকে শুরু করে বিশ্ব ও বাংলা সাহিত্যের লেখক-কবিদের দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে পিতৃতান্ত্রিকতাকে কীভাবে জায়মান রাখা হয়েছে, তা-ও লেখক তুলে ধরেছেন প্রায় চুলচেরা বিশ্লেষণে। আবার যাঁরা এর বিরোধিতা করেছেন, তুলে ধরেছেন, তাঁদের কথাও। এ বইয়ের যেখানে তিনি বলছেন, ‘পুঁজিবাজদের বৃদ্ধ দানব এখন দুঃসহ হয়ে উঠেছে। তার পিতৃতান্ত্রিকতাকে যদি পরাভূত করা না যায়, তাহলে মুক্তি আসবে না; না পুরুষের না নারীর।’ তখন তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত না হয়ে পারি না।
বইয়ের ‘পিতৃতান্ত্রিকতার অবরোধ ও ইতিহাসের মুক্তি’, ‘মাতৃভাষা, পিতৃতান্ত্রিকতা ও মায়ের মুখ’, ‘কর্তার ইচ্ছা’, ‘তব গৃহ নহে অন্ধকূপ’, ‘প্রমীলাদের নীরব লড়াই’, ‘জননীর পাশে শওকত ওসমান’, ‘মনের ছায়া, মতের ছবি’, ‘তাদের জোরটা কোথায়’ ও ‘সাক্ষাৎকার: আমার মা’ প্রবন্ধগুলোর পাঠ পাঠকমাত্রকেই এই বার্তা দেবে যে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থারই ঔরসে জন্ম পিতৃতান্ত্রিকতার। সেই পিতৃতান্ত্রিকতা সমাজ ও প্রগতির চরম অন্তরায়। যারা নারী ও পুরুষের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারে অঙ্গীকারবদ্ধ, উল্লিখিত প্রতিটি প্রবন্ধের পাঠ তাঁদের আলোড়িত করবে, অঙ্গীকারের অনুকূলে করবে উদ্বুদ্ধ।

পিতৃতান্ত্রিকতা যে সমাজ-প্রগতির প্রবল অন্তরায়, সে কথা তুলে ধরে লেখক আরও বিস্তারিতভাবে বলেন, ‘পিতৃতন্ত্রের উচ্ছেদ যেমন মাতৃতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা দিয়ে ঘটবে না, তেমনি ঘটবে না এক পিতৃতন্ত্রের জায়গায় অন্য পিতৃতন্ত্রের প্রতিস্থাপনার ভেতর দিয়ে। মুক্তিকামী ভাই ও বোনদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া চাই পিতৃতান্ত্রিকতার উচ্ছেদ ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। এক দেশে নয়, সব দেশে, দেশে দেশে। এই সংগ্রামে সন্তোষের কোনো জায়গা নেই, একে ক্রমাগত এগিয়ে যেতে হবে, কেননা, থামার অর্থ হলো পিতৃতান্ত্রিকতার অভ্যুদয়ের জন্য সুযোগ করে দেওয়া। যেটা বারবার ঘটেছে। মানুষের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস এ ধরনের দুর্ঘটনার দ্বারা আকীর্ণ। তাই আন্দোলন ও সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই।’
প্রাবন্ধিক হিসেবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সবচেয়ে বড় গুণ, তিনি তাঁর বক্তব্য পরিষ্কার করতে গিয়ে অতি-ভণিতার আশ্রয় নেন না। নিজের সিদ্ধান্ত তুলে ধরেন নিজের মতো করে। যেখানে দৃষ্টান্ত প্রয়োজন, সেখানে যথাদৃষ্টান্ত তুলে ধরতেও কসুর করেন না। এ বইয়েও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ফলে যাঁরা যথার্থ নারীমুক্তির লক্ষ্য থেকে পিতৃতান্ত্রিকতার অবসান চান, পিতার হুকুম তাঁদের জন্য অবশ্যপাঠ্য একটি বই।

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২০৭ পৃষ্ঠা

দাম: ৪০০ টাকা।