বাজিকরদের কাণ্ড-কীর্তি

এ বছর সাহিত্যে নোবেল কে পেয়েছেন, সেটি নিশ্চয় জানা হয়ে গেছে এতক্ষণে। এখন জেনে নিন সাহিত্যে নোবেল নিয়ে বাজিকরদের নানা কাহিনির খবর

পাঠক, এই লেখাটি না পড়লেও এখন চলবে আপনার। কারণ, এর মধ্যেই আপনি জেনে গেছেন এ বছর সাহিত্যে নোবেলজয়ী লেখকের নাম। তবে সাহিত্যে নোবেল নিয়ে এবার কী কী কাণ্ড ঘটিয়েছেন বাজিকরেরা, কোন কোন লেখকের পক্ষে বাজি ধরেছিলেন তাঁরা, কারা ছিলেন বিশ্লেষকদের পছন্দের তালিকায় ইত্যাদি জানতে আগ্রহী পাঠকেরা পড়তে পারেন অকিঞ্চিৎকর এ লেখাটি। এর পাঠ আপনাকে আরও জানিয়ে দেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের ইঁদুরদৌড়ে বাজিকরদের খাতায় কোন কোন লেখক ছিলেন আগুয়ান। নানা পত্রপত্রিকা ও অনলাইনভিত্তিক পোর্টালে যথারীতি এবারও প্রকাশিত হয়েছিল লেখকদের নামের বাহারি তালিকা, যেটি তৈরি করেছিলেন বাজিকরেরা।
বাজিকরদের অন্দরমহলে প্রবেশের আগে জানিয়ে রাখি, সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সেক্রেটারি সারা দানিয়ুসের ভাষ্য: নোবেল পুরস্কারের জন্য এ বছর বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল সব মিলিয়ে ১৯৫ জন সাহিত্যিকের নাম। পরে সেখান থেকে ৫ জনের একটি নাতিদীর্ঘ তালিকা তৈরি করা হয়। তবে সুইডিশ একাডেমি কখনোই এই হ্রস্ব তালিকাটি প্রকাশ করে না, এমনকি নাম ঘোষণা হওয়ার পরও।
সাহিত্যে নোবেলকে কেন্দ্র করে এবারও কাণ্ড হয়েছে বিস্তর। বাজিকরেরাও ছিলেন দারুণ সক্রিয়। প্রতিবছরের মতো এবারও বিশ্বের বনেদি পত্রিকাগুলো হরেক রকমের খবর ছেপেছিল নোবেলের ‘ভূগোল’ নিয়ে। অনেকের মতে, সাহিত্যের নোবেল বিশ্বব্যাপী ঘুরে বেড়ায়, অর্থাৎ একবার আমেরিকা মহাদেশের একজন সাহিত্যিককে দেওয়া হয় তো আরেকবার এটি পাবেন ইউরোপ মহাদেশের কেউ। কিন্তু এই ‘ভূগোল’ বিবেচনায় বাদ পড়ে যান গুরুত্বপূর্ণ অনেক লেখক। যেমন বহু বছর পরপর নোবেল পেতে দেখা যায় এশিয়া কিংবা আফ্রিকা মহাদেশের সাহিত্যিকদের। সংগত কারণেই বাজিকরদের লম্বা তালিকায় এই দুই মহাদেশের সাহিত্যিকেরা খুব একটা স্থান পান না। ফলে অনেককেই বলতে শোনা যায়, ‘নোবেলের রাজনীতি’ বড়ই জটিল।
এ বছর সাহিত্যে নোবেল পাবেন বলে বিশ্বব্যাপী সাহিত্যিকদের যে দীর্ঘ তালিকা তৈরি করেছিলেন বাজিকরেরা, তা নিয়ে কথা তো হবেই। এর আগে গেলবার বব ডিলানের নোবেলপ্রাপ্তি এবং বাজিকরদের কীর্তি নিয়ে দুটো কথা বলা যাক। ২০১৬ সালে ডিলানকে বাজিকরেরা রেখেছিলেন একেবারে নিচের কাতারে। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলেছিলেন, ডিলান সাহিত্যে নোবেল পেলে তাঁরা আর কখনো নোবেল নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করবেন না। লেখক-সমালোচক ও দ্য নিউ রিপাবলিক পত্রিকার বার্তা সম্পাদক অ্যালেক্স শেফার্ড বলেছিলেন, ‘ডিলান যদি নোবেল জেতেন, আমি আমার বই ব্লাড অন দ্য ট্র্যাকস চিবিয়ে খাব।’ কিন্তু শেষমেশ বব ডিলান যখন শেষ হাসি হেসেছিলেন, শেফার্ড কি কথামতো চিবিয়ে খেয়েছিলেন তাঁর বই? অবশ্যই না। যাহোক, নোবেল নিয়ে শেফার্ড এবারও ছিলেন বেশ উচ্চকণ্ঠ।
এই ৩ অক্টোবর নিউ রিপাবলিক-এ প্রকাশিত এক লেখায় তিনি বলেছিলেন, জাপানের কথাশিল্পী ‘হারুকি মুরাকামি এ বছর নোবেল পাবেন না, নিশ্চিতভাবে বলতে পারি আমি।’ যদিও অনলাইনভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল লেডব্রুকসের তালিকা অনুযায়ী মুরাকামি পুরস্কারের দৌড়ে ছিলেন দ্বিতীয় স্থানে। অবশ্য কয়েক বছর আগে থেকেই নোবেল তালিকায় ঘুরেফিরে আসছিল মুরাকামির নাম।
একইভাবে কেনিয়ার ঔপন্যাসিক নুগুগি ওয়া থিয়োঙ্গার নামও কম শোনা যায়নি বিগত বছরগুলোয়। এবারও কি বোদ্ধা, কি বাজিকর—সবাই মনে করেছিলেন সাহিত্য নোবেল ২০১৭ নুগুগি ওয়া থিয়োঙ্গারই। অ্যালেক্স শেফার্ডের মতও ছিল এমন।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস গতবারের মতো এবারও নগুগিকে সবচেয়ে ‘নির্ভেজাল ও যোগ্য’ প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল। তা ছাড়া দ্য নিউইয়র্কার-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেও নুগুগিই সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী। এ বিষয়ে অনেকেই একমত যে আফ্রিকা মহাদেশে জে এম কোয়েটি্জের পর নোবেল জয়ের সব রকম যোগ্যতা রাখেন নগুগি। কিন্তু যোগ্যতা থাকলেই কী, নোবেল কমিটির মতই তো চূড়ান্ত।
চলুন এখন পিছিয়ে যাই দুবছর। ২০১৫ সালের নোবেলজয়ী লেখক স্ভেতলানা আলেকসিয়েভিচের নাম ছিল না বাজিকর ও বিশ্লেষক কারও তালিকাতেই। এরপর থেকে বোধ করি খানিকটা সতর্ক হয়েছেন সবাই। বিশ্লেষক ও বাজিকর—দুপক্ষের তালিকাতেই এখন একটু কম পরিচিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিকদের নাম থাকে, ছিল এবারও। এবার এ তালিকায় ছিল নরওয়ের ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার জন ফসে, চীনের কথাসাহিত্যিক ইয়ান লিয়াঙ্কে, আইরিশ ঔপন্যাসিক জন ব্যানভাইল কিংবা অস্ট্রেলিয়ার ঔপন্যাসিক জেরাল্ড মারনেমের নাম। শেফার্ড তো তাঁর লেখায় বেশ জোরেশোরে বলেছিলেন (তিনি অবশ্য সব কিছুই বলেন খানিকটা জোরের সঙ্গেই), ‘এবার নোবেল জিতবেন কোনো অস্ট্রেলীয় লেখক। হয়তো ঔপন্যাসিক ডেভিড ম্যালোফ বা পিটার ক্যারে কিংবা কবি লেস মারের মধ্যে যেকোনো একজন।’ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালের পর অস্ট্রেলিয়া থেকে কেউ সাহিত্যে নোবেল পাননি। এদিকে শেফার্ডের লেখা পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকাভিত্তিক পত্রিকা সোয়েটান-এর নিয়মিত কলাম লেখক ফ্রেড খোমালো ব্যঙ্গ করে বলেছেন, ‘নোবেল কমিটি এত বোকা না যে শেফার্ডের কথায় নোবেল দেবে; আমার মতে, নোবেল পাবেন ডেভিড গ্রোসম্যান। আমি তাঁর পক্ষে বাজি ধরলাম।’
আবার অনেকেই বলেছেন, টমাস ট্রান্সট্রোমারের পর কোনো কবি নোবেল পাননি। তাই এবার পুরস্কারটি যদি কোনো কবি পেতেন...। এমন ভাবনাকে আমল দিয়ে এবার বাজিকরদের ভাবনা ছিল, এস্তোনিয়ার কবি ডরিস কারেভা পেতেও পারেন নোবেল। অন্যদিকে কারও কারও পছন্দ ছিল একই দেশের আরেক কবি জান ক্যাপলিনস্কির প্রতি। তবে প্রতিবারের মতো এবারও আলবেনীয় কবি ও ঔপন্যাসিক ইসমাইল কাদেরির নাম প্রথম ১৫ জনের মধ্যে রেখেছিলেন বাজিকরেরা।
অন্যদিকে সমালোচক ও বোদ্ধারা কবি হিসেবে এবার সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রেখেছিলেন কোরিয়ার কবি কো উনকে। তাঁর সাড়াজাগানো কবিতা সংকলন দ্য থ্রি ওয়ে টেভার্ন-এর ইংরেজি অনুবাদ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। বৌদ্ধদর্শন ও প্রাচীন ঐতিহ্য তাঁর কবিতার মূল উপজীব্য।
বেশ কয়েক বছর ধরে সিরিয়ার কবি আদোনিসকেও মিলান কুন্ডেরার মতো এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে নোবেল-নির্বাচকদের মধ্যে। কিন্তু এই দুই কবি-লেখকের যেকোনো একজন নোবেলের মাল্য পাওয়ার যথেষ্ট যোগ্য বটেন।
এবার বলি এ বছরের নোবেল পুরস্কারে যেসব লেখক ছিলেন সবচেয়ে আলোচিত, তাঁদের কথা। যে তিনজন সাহিতিক্যের নাম প্রায় সবার তালিকায় প্রথম পাঁচের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিল, তাঁরা হলেন কানাডার ঔপন্যাসিক মার্গারেট এটওড, স্প্যানিশ ঔপন্যাসিক ও অনুবাদক জেভিয়ার ম্যারিয়াস ও পর্তুগিজ ঔপন্যাসিক অ্যান্তোনিও লবো অ্যানতিউন্স। আবার অস্ট্রেলীয় ঔপন্যাসিক পিটার হ্যান্ড কিংবা হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক পিটার নাদাসকে নিয়েও প্রতি ১০ জনে ১ জন ধরেছিলেন বাজি। এসেছিল আর্জেন্টিনার সিজার এইরা কিংবা ইসরায়েলের লেখক এমোস ওজ বা হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাজলা ক্রাসনাহোরকাইয়ের নামও। অনেক বাজিকর বলেছিলেন, এবার তাঁদের যেকোনো একজন সুইডিশ একাডেমির ফোন পেলে আমরা অখুশি হব না।
বব ডিলানকে নোবেল দেওয়ার পর চিন্তার দিক থেকে খানিকটা টালমাটাল হয়ে গেছেন যাঁরা, তাঁরা কিছুটা সন্দেহের সুরেই কথা বলছিলেন এ বছর। এমন একজন সমালোচক হলেন জিম হেইঞ্জ। তিনি মনে করেছিলেন, এবারও পুরস্কারটি যেতে পারে আমেরিকায়। ফলে ডন ডেলিল্লো, ফিলিপ রথ, জয়েস ক্যারল উটস কিংবা থমাস পিনচন—এমন আমেরিকান লেখকদের নাম মুখে এনেছিলেন কেউ কেউ, জিম হেইঞ্জের কথা মনে রেখে। এ প্রসঙ্গে পুনরায় স্মরণ করা যেতে পারে শেফার্ডের কথা। তিনি বলেছিলেন, ‘গত বছর ডিলানকে নোবেল দেওয়ার পর এবার যদি রথ কিংবা ডেলিল্লোকে দেওয়া হয়, তবে এর চেয়ে হাস্যকর আর কিছু হবে না।’ এদিকে হেইঞ্জের সন্দেহকে একপ্রকার উড়িয়ে দিয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদসংস্থা বেটিং মি ডট ইউকেতে প্রকাশিত প্রবন্ধে লি আ জ্যাকসন মত দিয়েছিলেন, এবার সাহিত্যে নোবেলজয়ীর নাম ঘোষণার মাধ্যমে সুইডিশ একাডেমি আবার তার পুরোনো ঐতিহ্যে ফিরে যাবে। অর্থাৎ গতবারের মতো কোনো চমক এবার থাকবে না বলে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তাঁর।
অন্যদিকে দ্য গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে এবার বলা হয়েছিল, কেউ এবার ইংরেজ কোনো সাহিত্যিককে নোবেল পাওয়ার দৌড়ে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না। আর বাজিকর ও বিশ্লেষকদের এমন ধারণায় সায় দিয়ে অনলাইনভিত্তিক পত্রিকা লেইস্টে-এ প্রকাশিত এক লেখায় সমালোচক জুলিয়া উইক বলেছিলেন, ‘এবার পুরস্কার যাবে হয় কানাডায় নতুবা কেনিয়ায়।’
পাঠক, নিশ্চয় এতক্ষণে বুঝেছেন, এই লেখার গতি-প্রকৃতি অনেকটাই বাজিকর ও বিশ্লেষকদের পছন্দ-অপছন্দ নির্ধারণ করেছে। লেখাটির শেষদিকে এসে অ্যালেক্স শেফার্ডের ‘কে জিতবে ২০১৭-এর নোবেল সাহিত্য পুরস্কার’ শিরোনামের একটি রচনা আমাকে খানিকটা সাহায্য করেছে। শেফার্ড তাঁর প্রবন্ধের শেষপ্রান্তে এমন কিছু লেখকের নাম নিয়েছিলেন, যাঁরা নিজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বপাঠকের কাছে খুব একটা পৌঁছাননি, তবে নিজ দেশে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ও সমাদৃত। যেমন কাতালানীয় কবি ও সাংবাদিক জোয়ার মার্সে, নরওয়ের ছোটগল্পকার ম্যারেথা লিন্ডস্টর্ম, রোমানিয়ার কবি মিরসিয়া কার্টারেস্কো, বেলজিয়ান কবি লিওনার্ড নোলেন্স, মেহিকান ঔপন্যাসিক সার্জিও পিতো, চীনের কবি বেই দাউ, ইতালির নাট্যকার দারসিয়া মারাইনি, স্প্যানিশ ঔপন্যাসিক অ্যান্তোনিও মোনজ ম্যালিনা প্রমুখ। তাঁদের কথা উল্লেখ করলাম ওরহান পামুকের একটি কথা মনে পড়ায়। নোবেল পাওয়ার পর এক সাক্ষাৎকারে পামুক বলেছিলেন, ‘পুরস্কার পাওয়ার আগে আমাকে আমার দেশের মানুষ ছাড়া কেউ চিনত না। নোবেল আমাকে বিশ্বে পরিচয় করিয়েছে, আমার সাহিত্যকে বিশ্বব্যাপী নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।’
শুরুতে বলেছিলাম, এ লেখাটি না পড়লেও আপনার তেমন কিছু যাবে-আসবে না। কারণ, সাহিত্যে নোবেল কোন লেখকের গলায় উঠেছে, সেটি আপনি এতক্ষণে জেনে গেছেন। তবু এই লেখার মাধ্যমে আমরা জেনে নিলাম কারা, কোন কোন কবি-লেখক-সাহিত্যিক ছিলেন এবারের নোবেলের তালিকায়, বিশ্লেষক ও বাজিকরেরা কাদের নিয়ে লড়েছিলেন এবার। পাঠক, এ লেখাপড়া শেষে আপনার চোখ এখন তো কেবল তাঁর দিকেই নিবন্ধ, যিনি পেয়েছেন এবারের যিনি নোবেল।