পোড়ামাটির গন্ধে

‘ম্যাডোনা’, িশল্পী: আকতারুন নাহার
‘ম্যাডোনা’, িশল্পী: আকতারুন নাহার

আকতারুন নাহার, সবার কাছে যঁার পরিচয় আইভী নামে, তাঁর শিল্পকর্ম মাটি দিয়ে গড়া। সেগুলো ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্য নয়, দ্বিমাত্রিক তলে খোদাই করা শিল্পকর্ম। এতে শিল্পী বর্ণনা করেছেন নানা বিষয়।

১৩৬টি মৃৎকর্মের মধ্যে রয়েছে টেরাকোটা, গ্লেজ টাইলস ম্যুরাল, ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিক ভাস্কর্য। কাঁচা মাটি বা কাদামাটিকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার একটা প্রক্রিয়া হলো মাটিকে পোড়ানো। পোড়ামাটির স্থায়িত্ব দীর্ঘ সময়ের। তাই প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন সভ্যতায় আমরা পোড়ামাটির ফলকচিত্র এখনো খুঁজে পাই।

তিনটি ধরনে আকতারুন নাহার কাজ করেছেন—পোড়ামাটির ফলকচিত্র, মৃৎপাত্র ও মোজাইক চিত্র। ফলকচিত্রের মাঝে ব্যবহার করেছেন আলংকরিক আকৃতি বা ফর্ম। ফলকের পুরো অংশেই সরু ও স্থূল রেখায় ফুল-পাতার নকশা খোদাই করে প্রকাশ করেছেন অলংকারধর্মিতা। পোড়ামাটির নিজস্ব একটি রং আছে। আকতারুন নাহার ফলকচিত্রে মাটির নিজস্ব রংকে রেখে দিয়ে কাজ সম্পন্ন করেছেন।

তাঁর কাজে ভর করে আছে বিস্তর জ্যামিতি। এটি হয়তো শিল্পীর ধরন। বাস্তবধর্মী মানুষ অথবা অবয়বের কথা না ভেবে তিনি শিল্পতলে নির্মাণ করেন জ্যামিতিনির্ভর মানুষ আর প্রকৃতি।

আশির দশকের শুরুতে শিল্পশিক্ষা সম্পন্ন করে দীর্ঘ সময় দর্শকের কাছে না এসে নিভৃতে শিল্প গড়েছেন আকতারুন নাহার। সেসব শিল্পের সম্ভার নিয়ে গ্যালারি কসমস ও জাতীয় জাদুঘর যৌথভাবে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। শিল্পীর মতে, ‘পোড়ামাটি ও টাইলস ম্যুরাল মাধ্যমে শিল্পের রসাস্বাদন সম্ভব। স্থাপত্যশিল্পের সঙ্গে এ মাধ্যমটি খুব ভালোভাবেই জড়িয়ে আছে।’

 ১৯৮০ সালে করা ‘মা ও শিশু’ শিরোনামের ম্যুরালচিত্রে দেখা যায় মা শিশুকে জড়িয়ে আছে। মা ও শিশুর মাথা দুটি বৃত্ত হিসেবে দেখানো হয়েছে। এ ম্যুরালটি হেনরি মুরের ভাস্কর্যে ব্যবহৃত হলো বা সুড়ঙ্গের কথা মনে করিয়ে দেয়। ফলকচিত্রে ত্রিমাত্রিকতার চেষ্টা বোঝা যায়।

 ‘থ্রি ওম্যান’, ‘ম্যাডোনা’, ‘ফিশারম্যান’, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট স্ট্রাগল অব লাইফ’, ‘হাংগার’, ‘ফ্যামিলি’ শিরোনামের ফলকচিত্রে মানুষের মুখগুলোতে দ্রোহের আভাস দেখা যায়। শিল্পীর বিষয় নির্বাচনে ক্ষুধা, দ্রোহ, আনন্দ, প্রকৃতি, বিষাদ প্রধান হয়ে উঠেছে।

আকতারুন নাহারের ফলকচিত্রে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে জ্যামিতিক অবয়বের মানুষ। আর সে মানুষগুলোকে বিভক্ত করেছে সূক্ষ্ম কিছু রেখা। টাইলস টুকরো করে তৈরি করা ‘মুনলাইট নাইট’ শিরোনামের কাজে ঊর্ধ্বমুখী রেখা, বৃত্ত, চৌকোনা আকৃতি স্থাপন বিষয়ের বর্ণনা বোঝা যায় না। মোজাইক চিত্রগুলোতে মানুষের অবয়ব তৈরি করেছে সূক্ষ্ম ভাঙা টাইলসে টুকরো জোড়া দিয়ে। কোলাজধর্মী এ কাজগুলোতে রঙের সমন্বয় কতটা হয়েছে সেটি দর্শক ভালো অনুভব করতে পারেন। পোরসেলিন আর পোড়ামাটির টুকরা জোড়া দিয়ে তৈরি প্রসেসন, ফ্রিডম অব স্পিচ তৈরি করেছেন দুটি রঙের কথা খেয়াল রেখে। কালো রঙের পোড়ামাটির চাঁড়া, মেটে হলুদ রঙের টুকরা জোড়া দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন বিষয়ের অভিব্যক্তি। সিরামিক পেইন্টিং মাধ্যমে তুলে এনেছেন প্রকৃতিকে।

এবড়োথেবড়ো রঙের প্রলেপে ঠিক চিত্রকলার বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যায় না। ক্যানভাসের মূল কেন্দ্রে দর্শকের দৃষ্টি স্থির করতে কিছু বিষয় তো চাই। সিরামিকস পেইন্টিংগুলোতে সেটি হাজির নেই। ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিক আকৃতিতে করা ‘রেভল্যুশন’, ‘ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ড’ কাজগুলোতে আড়াআড়ি উলম্ব আকৃতির ভেতরে হলো সৃষ্টি করা শিল্পীর আগ্রহের একটি দিক মনে হয়েছে। ইউরোপীয় শিল্পী হেনরি মুর ও বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পের পথিকৃৎ নভেরা আহমেদের কাজে এ ধরনের হলো বা সুড়ঙ্গের উপস্থিতি দেখা যায়।

প্রদর্শনীর কাজগুলোর মাঝে বেশ কিছু মৃৎপাত্র দেখা যায়। পাত্রগুলোর বৈচিত্র্য হলো কোনোটি পোড়ামাটির রং হুবহু রেখে দিয়ে পাত্রের গায়ে নকশা খোদাই করা, আবার কোনোটির গায়ে টাইলস টুকরো করে সেগুলো নকশা আকারে পাত্রের গায়ে সাজিয়ে রাখা। পোড়ামাটির রঙে কিছু বোল, প্লেট প্রদর্শনীতে দেখা যায়। এগুলোতে একধরনের জ্যামিতিক নিরীক্ষার ছাপ পাওয়া যায়। দৈনন্দিন ব্যবহারের বোল এবং পাত্র ঠিক যেমন আমরা দেখতে চাই তার চেয়ে খানিকটা ব্যতিক্রম। ১৯৮২ সালের দিকে করা কিছু মৃৎপাত্রের আকৃতি নিয়ে নিরীক্ষায় দেখা যায়, পাত্রের নিচের অংশ গোলাকৃতি হলেও ওপরের অংশটি সরু হয়ে উঠেছে। পাত্রের গায়ে খোদাই করা ফুলের নকশা মৃৎপাত্রটিকে বিশেষ করে তুলেছে। আকতারুন নাহার আইভীর মৃৎপাত্র, ভাস্কর্য, সিরামিকস শিল্পকর্মগুলো আমাদের প্রাচীন সিন্ধু, হরপ্পা, মহেঞ্জোদারোর কথা মনে করিয়ে দেয়। আদি শিল্পকলার যেসব নিদর্শন পাওয়া যায় তার প্রতিরূপ দেখা যায় এ প্রদর্শনীর শিল্পকর্মগুলোতে।

 জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী মিলনায়তনে ২ অক্টোবর শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি শেষ হবে ১০ অক্টোবর।