দুই মেয়ে

অলংকরণ: মাহফুজ রহমান
অলংকরণ: মাহফুজ রহমান

ওরা দুই বোন চাষার মেয়ে। দাঁড়িয়েছিল বারান্দায়। সবুজ লনের ওপর দিয়ে হেঁটে এল এক ডাইনি। দুই বোন ডাইনির হাতে চুমু দিল, তাকে মা বলে ডাকল।
‘আহা, মা। তোমার অনেক বুদ্ধি। আমাদের বাবার মাথায় একটু বুদ্ধি দাও। দুই রাজপুত্র আমাদের দুজনকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, কিন্তু বাবা রাজি হয়নি। বাবার মাথাটা ঠিক করে দাও। আমরা গরিব চাষার মেয়ে, কিন্তু আমাদেরও তো ইচ্ছে হয় রাজরানি হতে, ইচ্ছে হয় সোনার থালায় খেতে, ইচ্ছে হয় রাজার হাত যেন আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।’
রাগী কিম্ভূতকিমাকার ডাইনিটার কয়লামাখা মুখ, কোঁচকানো চামড়া, দেখে মনে হয় এটা বুঝি একটা দোমড়ানো আবর্জনামাখা কাপড়ের টুকরো। ডাইনিটা বলল, ‘কেউ কখনো আমাকে মা বলে ডাকেনি। কেউ আমাকে কখনো চুমু দেয়নি। আমি তোদের সাহায্য করব। তবে শোন, বাবা যা বলে মেনে চলবি। কথা দে।’
ডাইনির কথা শুনে দুই বোনের চোখে বয়ে গেল বন্যা। ‘তাহলে আমাদের মাথায় আর রানির মুকুট পরা হবে না। রাজপ্রাসাদের সাদা সিঁড়ি বেয়ে হাঁটা যাবে না।’
কিন্তু ওদের দিকে না তাকিয়ে ডাইনি চলে গেল সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে।
চাষা ফিরে এল বাড়ি। চাষার দুই মেয়ে খুব যত্ন করে বাবাকে বসাল। বাবার সব কথা শুনল। তাঁর ঘাড় থেকে কেটে আনা কাঠ নামাল। টেবিলে রাখল খাবার। বাবাকে যত্ন করল ঠিকই, কিন্তু দুই বোনের চোখে তখন শুধু পানি আর পানি।
চাষা বলল, ‘আমি তোমাদের এমন কোথাও বিয়ে দিতে পারি না, যেখানে তোমাদের বরেরা তোমাদের বাবার দারিদ্র্য নিয়ে হাসাহাসি করবে!’
দুই বোন গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগল। চাষা দুম করে একটা ঘুষি মারল টেবিলে।
‘তোমাদের জন্য এমন বর আমি খুঁজে বের করব, যে বর আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে না।’
চাষা বের হয়ে এল বারান্দায়। পূর্ব-পশ্চিমে তাকাল, টুপি তুলে ধরল মাথার ওপর, এবার তাকাল উত্তর-দক্ষিণে। তারপর বনের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘আমার বড় মেয়েকে কে বিয়ে করতে চাও?’
বনের মধ্য থেকে শোনা গেল একটা কণ্ঠ, ‘আমি ওকে বিয়ে করতে চাই!’
‘তাহলে এসো, নিয়ে যাও ওকে!’ চিৎকার করে বলল চাষা।
বন থেকে বেরিয়ে এল একটা ভেড়া। চাষা মেয়েটাকে বসিয়ে দিল ভেড়ার পিঠে। ভেড়া ওকে নিয়ে চলল বনের গহিনে ওর বাড়িতে। সেখানেই থাকতে শুরু করল বড় মেয়ে।
চাষা আবার এসে দাঁড়াল বারান্দায়। উত্তর-দক্ষিণে তাকাল। তারপর তাকাল পূর্ব-পশ্চিমে। বলল, ‘কেউ কি আছ, আমার ছোট মেয়েটাকে বিয়ে করতে চাও?’
‘আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।’ শোনা গেল কণ্ঠ।
‘তাহলে এসো, নিয়ে যাও ওকে।’ শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলল চাষা।
তখন হ্রদের দিক থেকে উড়ে এল বিশাল বড় এক পাখি। চাষা নিজের ছোট মেয়েকে বসিয়ে দিল পাখির পিঠে। পাখি উড়ে চলল নিজের বাড়ির দিকে। পাখিটা বাস করত এক গুহার মধ্যে। সেখানেই থাকতে লাগল ছোট মেয়ে।
একদিন ভেড়া এসে বড় মেয়েকে বলল, ‘তোমার বাবা আসছে অতিথি হয়ে। তার জন্য মজার মজার খাবার রান্না করো।’
বড় মেয়ে বলল, ‘বাবার জন্য আর কী রাঁধব। কী আছে আমাদের। তার জন্য চায়ের পানিও তো ফুটবে না।’
এ কথা শুনে ভেড়া ওর কপাল দিয়ে জোরে গুঁতো মারল দেয়ালে। তাতে ভেড়ার কপাল ফেটে রক্ত বের হলো। সেই রক্ত দিয়ে খাবার বানাল বড় মেয়ে। বাবা খুব খুশি হয়ে খেয়েদেয়ে ফিরল বাড়ি। বউকে বলল, ‘তোমার বড় মেয়ে খুব সুখে আছে। আমাকে বসিয়েছে উঁচু আসনে, খাইয়েছে, দাইয়েছে। ওদের বাড়িতে গিয়ে বুঝেছি, ঘরে বসেই কীভাবে রান্নার জোগাড়যন্তর করা যায়। ওর বর সব জোগাড় করেছে।’
‘নির্বুদ্ধিতার জন্যই তোমার মৃত্যু হবে।’
চাষা চলল ছোট মেয়ের কাছে। ছোট মেয়ে খুব যত্নআত্তি করল বাবার। তখন ডানা মেলে উড়ে এল পাখি। বাবাকে দেখে ও আবার উড়ে গেল হ্রদের ওপরে। শোঁ শোঁ করে উড়ে গেল, তারপর হ্রদে ডুব দিয়ে মুখভর্তি স্যামন মাছ নিয়ে ফিরে এল বাড়িতে। সেই মাছ রান্না করে ছোট মেয়ে খাওয়াল বাবাকে।
বাড়ি ফিরে চাষা বলল তার বউকে, ‘মেয়েদের জন্য কেঁদো না। ছোট মেয়ের বাড়ি গিয়েছিলাম। আমি ওদের বাড়ি থেকে শিখে এসেছি, কীভাবে খাবার জোগাড়যন্তর করতে হয়।’
চাষা করল কি ডোবার তীরে এল, লাফ দিল উঁচু থেকে। ‘বউ দেখ, এবার আমি স্যামন মাছ নিয়ে ফিরব বাড়ি। চিৎকার তো করল চাষা, কিন্তু ঠাস করে পড়ল ডোবার মধ্যে। মাছ তো ধরতেই পারল না; বরং সেখানে পড়ে মরে গেল সে।
তখন ভেড়া আর পাখিটা তাদের বউদের বলল, ‘তোমাদের বাবা মারা গেছে। এবার তোমরা বাড়ি ফিরে যাও, সেখানে রাজপুত্রদের জন্য অপেক্ষা করো।’
দুই বোন বলল, ‘বাবা তোমাদের বেছে দিয়েছে, আমরা তোমাদের সঙ্গে সুখী।’
তখন বড় বোনের ওপর ধসে পড়ল কুঁড়ে, ছোট বোনের ওপর ধসে পড়ল গুহা। আর দুই বোন দেখল ওরা দাঁড়িয়ে আছে একটা রাজপ্রাসাদের সাদা সিঁড়ির ওপর। সেই রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এল দুই রাজপুত্র। তারা বলল, ‘আমাদের প্রাসাদে স্বাগত। ডাইনি আমাদের ভেড়া আর পাখি বানিয়ে রেখেছিল। আমরা আবার রাজপুত্র হয়ে গেছি।’
দুই বোনের মুখে হাসি ফুটল।

সেলমা লেগারলফ
সেলমা লেগারলফের জন্ম সুইডেনে। তিনিই প্রথম নারী, যিনি সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। ছোটদের জন্য দারুণ সব ছোটগল্প লিখেছেন। নোবেল পেয়েছেন ১৯০৯ সালে।