উজান-বাওয়া যুদ্ধের ইতিহাস

স্মৃতি অম্লান ১৯৭১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

প্রচ্ছদ: অশোক কর্মকার, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: জুলাই ২০১৭, ২৮৮ পৃষ্ঠা, দাম: ৫৫০ টাকা।

নতুন কলেবরে, নতুন আঙ্গিকে এবং আরও নতুন তথ্য সংযোজিত, পরিমার্জিত হয়ে প্রকাশিত আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্মৃতি অম্লান ১৯৭১ বইটি পাঠককে এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করবে। মোট ১৩টি অধ্যায়ে বিভক্ত এ বইয়ে এমন সব তথ্য লেখক তাঁর অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে তুলে ধরেছেন, আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যা সন্দেহাতীতভাবে সংযোজিত হওয়ার দাবি রাখে। বইয়ের ভূমিকা মারফত লেখক আমাদের জানাচ্ছেন, ‘আমার স্মৃতিকথার এই তৃতীয় খণ্ডে আমি শুধু একাত্তরের কাহিনিই লিখতে বসেছি। তবে তাতে ১৯৭২ সালের স্মৃতিও স্থান পাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধকালে আমি ছিলাম সুদূর আমেরিকায় পাকিস্তান দূতাবাসে ওয়াশিংটনে পদায়িত অর্থনৈতিক কাউন্সেলর। ৩০ জুন সেখানে পাকিস্তান দূতাবাস পরিত্যাগ করে আমি চূড়ান্তভাবে সরাসরি বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করতে ব্রতী হই। সে যুদ্ধ কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ ছিল না। সে ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সফল করার জন্য বিশ্ব জনমত সৃষ্টির প্রয়াস এবং পাকিস্তানকে জব্দ করার জন্য সে দেশের প্রতি আন্তর্জাতিক ঘৃণা ও অসহযোগিতা উদ্রেক করা। সেই উদ্যোগে সহযোগী হন প্রবাসে অবস্থানকারী বাঙালি জনগণ, বন্ধুদেশ ভারতের ডায়াসাপোরা এবং সংবেদনশীল মার্কিন জনগণ। সংবাদমাধ্যম, বুদ্ধিজীবীবৃন্দ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যুবক, কিশোর ও শিক্ষকবৃন্দ এবং অসংখ্য বিবেকতাড়িত মানবতাবাদী সাধারণ মানুষ এতে মূল্যবান অবদান রাখেন।’

এই বই রচনার পটভূমি এবং তার বিস্তৃতি কতটা গভীর, সে সম্পর্কে পাঠককে প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার জন্যই লেখকের ভূমিকা থেকে এই দীর্ঘ উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো। আমরা এ বইয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে জানব যে লেখক উড়ে এসে জুড়ে বসা গোছের কেউ নন। তাঁর ব্যক্তিক পটভূমি আছে—রাজনৈতিক ও সামাজিক—দুই ক্ষেত্রেই। জানাচ্ছেন, ‘১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান হলো, আমি তখন নবম শ্রেণির ছাত্র—একটি রাজনৈতিক পরিবারের ছেলে এবং নিজেও বেশ সক্রিয়।’ আরও জানাচ্ছেন, ‘পাকিস্তান নিয়ে আমাদের কত স্বপ্ন।...কিন্তু সেই স্বপ্ন ছিল খুব স্বল্পস্থায়ী।’

লেখক তাঁর ছাত্রজীবনে যে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা, সে কথা বলার পাশাপাশি তুলে ধরেছেন পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ভাষার প্রশ্নে টানাপোড়েন ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কথা অকপটে। আমরা দেখি নিজের জন্মশহরে থাকতে তিনি যেমন রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়, তেমনি ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন-পর্যায়ের জীবনেও একইভাবে সক্রিয়। এ বইয়ে লেখকের স্বদেশের মাটিতে রাজনৈতিক তৎপরতা যেমন উজ্জ্বল রেখায় অঙ্কিত, তেমনি যখন পদস্থ সরকারি পেশাগত জীবনে ঢুকছেন, তাঁর তখনকার জীবনও প্রখর রাজনীতি-মনস্ক। ফলে আবুল মাল আবদুল মুহিত—আগেই বলেছি—শূন্য থেকে ছিটকে পড়া কেউ নন।

পদস্থ চাকরির সুবাদেই মুহিত মহান মুক্তিযুদ্ধের কালপর্বে অবস্থান করছেন সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, যে মহাশক্তিধর দেশটির সরকার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘোর বিরোধী ছিল। আর সেই দেশের মাটিতে বসেই তিনি, তাঁর বয়ানে, ‘...চূড়ান্তভাবে সরাসরি বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করতে ব্রতী হই।’ এবং আমরা দেখি, আবুল মাল আবদুল মুহিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ মাথা থেকে সে মাথা চষে বেড়াচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে। এ ছিল তাঁর মিশনারিসুলভ তৎপরতা। তাঁর সেই মিশন ব্যর্থ হয়নি। বিভিন্ন স্তরের সাধারণ মার্কিন নাগরিকসহ ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান-নির্বিশেষে সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করছেন। সক্রিয় পদক্ষেপ বা উদ্যোগ নিচ্ছেন তাঁরা। এসবেরই মূলে ছিল মুহিত ও তাঁর মুক্তিযুদ্ধ-সমর্থক সহকর্মী-সহযোগীদের নিরলস ও জানবাজি রাখা উদ্যোগ।

আলোচ্য বইয়ের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে দেশপ্রেমিক বাঙালি সমাজের মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে সক্রিয় তৎপরতার প্রায় বিস্তারিত বিবরণ, পাশাপাশি তাদের প্রভাবে মার্কিন জনগণও যে উদ্দীপ্ত ভূমিকা রেখেছিল মুক্তিসংগ্রামে, আছে সেই সবও। তবে বইটিতে শেষতক আমরা দেখি বিভক্ত মার্কিন সমাজ—যার একদিকে প্রায় একঘরে নিক্সন-কিসিঞ্জার সরকার ও তার অনুগত অনুসারীরা, অন্যদিকে মুক্তমনা, দৃঢ়চেতা সিনেটর, কংগ্রেসম্যান ও বিভিন্নস্তরের মার্কিন জনগণ। ছক কেটে কেটে এসবের সবিস্তার বিবরণ তুলে ধরেছেন লেখক। তাঁকে ধন্যবাদ এমন একটি বই রচনার জন্য, যার বদৌলতে আমরা জানতে পারছি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে মার্কিন সমাজের সামগ্রিক চেহারা ও চরিত্র।