সোভিয়েত ইউনিয়নে, সমাজতন্ত্রের দিনে

>

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী স্ভেৎলানা আলেক্সিয়েভিচের সর্বশেষ গ্রন্থ ভ্রেমিয়া সেকন্দখেন্দ (সেকেন্ডহ্যান্ড সময়) সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলয়ের পর লেখা কথ্য ইতিহাসের সংকলন। বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা, বয়স ও লিঙ্গের মানুষ নিজ নিজ বয়ানে সোভিয়েত সময়ের স্মৃতিচারণা করেছেন এখানে। সেই বই থেকে ছাপা হলো কয়েকজনের প্রত্যক্ষ বয়ানের অনুবাদ

সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ দিনগুলোতে খাবারের আশায় মানুষের সারি। ছবি: সংগৃহীত
সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ দিনগুলোতে খাবারের আশায় মানুষের সারি। ছবি: সংগৃহীত

বোকা ইভান আর সোনার মাছ
‘কী বুঝলাম আমি? বুঝলাম যে একসময়ের নায়কেরা অন্য সময়ে নায়ক থাকে না। শুধু ইভানুশকা দুরাচক (বোকা ইভান) আর এমেলিয়া ছাড়া। রুশ রূপকথার প্রিয় দুই নায়ক-নায়িকা। আমাদের সব রূপকথার গল্পই সৌভাগ্য নিয়ে, ভাগ্যের জোরে হঠাৎ কিছু পেয়ে যাওয়া নিয়ে। অলীক হাতের সাহায্যের আশায় বসে থাকা নিয়ে আমাদের গল্প। আমরা বসে থাকি আর ভাবি যে সবকিছু আপনা–আপনি আমাদের কোলের ওপরে এসে পড়বে, চুলোর পিঠ থেকে আমাদের উঠতেই হবে না। আর চুলোটা নিজেই আমাদের জন্য ব্লিনি পিঠা ভেজে দেবে, আমাদের মনের সব সাধ পূরণ করবে সোনার মাছ। আমার ওটা চাই, আমার এটা চাই...। অপরূপা জারকন্যাকে চাই। আমি বাস করতে চাই অন্য এক রাজ্যে, যেখানে নদীতে দুধের নহর বয়, আর নদীর পাড়ে পাড়ে জ্যামের পাহাড়...আমরা স্বপ্নচারী, একদম। আমাদের আত্মা কসরত করে আর কষ্ট পায়, কিন্তু বেশি কিছু করা হয়ে ওঠে না, এত কিছুর পর আর কোনো বলশক্তি অবশিষ্ট নেই। কখনোই কিছু করে ওঠা হয় না। রহস্যময় রুশ আত্মা...প্রত্যেকেই তাকে বুঝতে চায়। তারা দস্তয়েভস্কি পড়ে: তাদের আত্মার গভীরে কী আছে? আমাদের আত্মার গভীরে আছে আরও আত্মা।
‘আমরা রান্নাঘরে বসে গল্পগুজব করতে ভালোবাসি, বই পড়তে ভালোবাসি। “পাঠক” আমাদের প্রধান পরিচয়। “দর্শক”। আমরা সব সময় ভাবি যে আমরা এক বিশেষ ব্যতিক্রমী জাতি, যদিও আমাদের এই ভাবনার কোনো ভিত্তি নেই, শুধু আমাদের তেল আর প্রাকৃতিক গ্যাস ছাড়া। একদিকে এই ভাবনা আমাদের প্রগতির পথে একটা বাধা; অন্যদিকে এটাই একটা তাৎপর্য বহন করে। রাশিয়া সব সময়ই যেন গুরুত্বপূর্ণ কিছুর উত্থান ঘটানোর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকে, বিশ্বকে এমন কিছু দেখায়, যা একেবারেই অসাধারণ। ঈশ্বরের মনোনীত জাতি। বিশেষ রুশি পন্থা। দেশটা আমাদের আবলোমভে ভরা। আবলোমভেরা তাদের কাউচে গড়াগড়ি খায়, অলৌকিক কিছু ঘটার প্রতীক্ষায় থাকে। আমাদের দেশে একজনও স্টোলৎস নেই। পরিশ্রমী ও করিতকর্মা স্টোলৎসদের আমরা ভীষণ অপছন্দ করি, কারণ ওরা আমাদের প্রিয় বার্চবনগুলো কেটে ফেলে, চেরিবাগান উজাড় করে। ওরা কলকারখানা বানায়, টাকা করে...ওরা আমাদের কেউ না।
‘রুশি রান্নাঘর...করুণ খ্রুশ্চফ্স্কায়া কুখনিয়া (নিকিতা খ্রুশ্চভের আমলে তৈরি রান্নাঘর)। আয়তন ৯ বর্গমিটার থেকে ১২ বর্গমিটার (যদি আপনার ভাগ্যে থাকে, তবে কী সুখ!)। অন্য পাশে নোংরা দেয়াল, টয়লেট। এই আমাদের সাধারণ সোভিয়েত বাসগৃহের নকশা। জানালার কার্নিসে মায়োনেসের পুরোনো বয়ামে গজিয়ে ওঠে পেঁয়াজের চারা, টবে ঘৃতকুমারী, ঠান্ডার মহৌষধ। আমাদের কাছে রান্নাঘর নেহাত রান্না করার জায়গা নয়। আমাদের রান্নাঘর একই সঙ্গে খাবার ঘর, বৈঠকখানা, অফিস ও আড্ডার জায়গা। দলবদ্ধ মস্তিষ্কস্খালনের জায়গা। উনিশ শতকে রুশিদের সব সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্র ছিল অভিজাতদের মহলা; বিশ শতকে সে জায়গা নিল আমাদের রান্নাঘর। আসলে রান্নাঘরেই পিরিস্ত্রোইকা হয়েছে। ১৯৬০ দশকের প্রথাভাঙা জীবনটা ছিল আমাদের রান্নাঘরের জীবন। খ্রুশ্চেভকে ধন্যবাদ! তিনিই আমাদের বারোয়ারি ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে বের করে এনেছিলেন; তাঁর আমলেই আমরা পেয়েছিলাম আমাদের একান্ত রান্নাঘর, যেখানে আমরা সরকারের সমালোচনা করতে পারতাম এবং সবচেয়ে বড় কথা, সেখানে বসে সরকারের সমালোচনা করতে ভয় পেতাম না, কারণ রান্নাঘরে আমরা সবাই ছিলাম পরস্পরের আপন। রান্নাঘরেই জন্ম হতো নানা ভাবনার, অকল্পনীয় সব প্রকল্পের। ওখানেই আমরা চুটকি বানাতাম—ওটা ছিল চুটকির স্বর্ণযুগ! “কমিউনিস্ট হলো সেই মানুষ, যে মার্ক্স পড়েছে; আর অ্যান্টিকমিউনিস্ট হলো সেই লোক, যে মার্ক্সকে বুঝেছে।” আমাদের বেড়ে ওঠা রান্নাঘরে, আমাদের সন্তানেরাও বেড়ে উঠেছে রান্নাঘরেই। তারা আমাদের সঙ্গে গালিচ আর আখুদজাভার গান শুনত। আমরা ভিসোৎস্কির রেকর্ড বাজাতাম, বিবিসি রেডিও শুনতাম, যা শোনা নিষিদ্ধ ছিল। আমরা কথা বলতাম সবকিছু নিয়ে: সবকিছু কী জঘন্য ছিল। কথা বলতাম জীবনের অর্থ নিয়ে, সবার জন্য সুখ নিয়ে, মানে সবাই সুখী হতে পারে কি না, তা নিয়ে। একটা মজার গল্প মনে পড়ছে...আড্ডা দিতে দিতে মাঝরাত পেরিয়ে গেছে, আমাদের মেয়ে, ওর বয়স ১২ বছর, রান্নাঘরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমরা আমাদের উত্তপ্ত বাগ্বিতণ্ডায় ওর অস্তিত্বই ভুলে গেছি, এমন সময় হঠাৎ ও ঘুমের মধ্যেই চিৎকার করে উঠল: “আর রাজনীতির দরকার নাই! আবার সাখারভ...আবার সোলঝেনিৎসিন...আবার স্তালিন...!” (হাসি)
‘বিরামহীন চা। কফি। ভোদকা। সত্তরের দশকে ছিল কিউবান রাম। প্রত্যেকেই ফিদেলের প্রেমে পড়েছিলাম! প্রেমে পড়েছিলাম কিউবান বিপ্লবের! সেই বেরেটপরা চে। হলিউডের তারকা! বিরামহীন গল্পগুজব। ভয়, কেউ আড়ি পেতে শুনছে! নিশ্চয়ই শুনছে। কথাবার্তার মাঝখানে হঠাৎ কেউ না কেউ সবাইকে থামিয়ে দিয়ে ছাদের বাতি কিংবা ইলেকট্রিক সকেটের দিকে ইঙ্গিত করে একটু হেসে বলত: “শুনতে পাচ্ছেন, কমরেড মেজর?” একটু বিপজ্জনক মনে হতো, মনে হতো যেন একটা খেলা চলছে। এই মেকি জীবনযাপন থেকে আমরা একধরনের তৃপ্তিই পেতাম। অল্প কজন মানুষ প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করত, কিন্তু অধিকাংশই ছিল আমাদের মতো “রান্নাঘরের ভিন্নমতাবলম্বী”। আমাদের হাত দুটো থাকত পকেটে...’

***
‘আজকাল গরিব থাকা আর খেলাধুলা করতে না পারা লজ্জার বিষয়। সংক্ষেপে এর মানে, আমি কিছু করে উঠতে পারছি না। আমি দারোয়ান আর পাহারাদারদের প্রজন্মের একজন। এই সব কাজ করার মানে ছিল ভেতরে ভেতরে একধরনের অভিবাসী হওয়া। আমি আমার জীবন যাপন করছি, কিন্তু চারপাশে কী ঘটছে, তা লক্ষ করছি না; যেন-বা স্রেফ চেয়ে আছি জানালার বাইরের দৃশ্যাবলির দিকে। আমি আর আমার বউ পিতেরবুর্গ (সে সময় ছিল লেনিনগ্রাদ) বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন অনুষদ থেকে পাস করেছিলাম। তারপর বউ দারোয়ানের চাকরি পেল, আর আমি এক বয়লার ফ্যাক্টরিতে কয়লা ঠেলার কাজ পেলাম। টানা ২৪ ঘণ্টা কাজ করতাম, তারপর টানা দুই দিন ছুটি। সেই আমলে একজন ইঞ্জিনিয়ার পেত মাসে ১৩০ রুবল, আর বয়লার রুমে কাজ করে আমি পেতাম ৯০ রুবল। এর মানে ছিল, তুমি যদি মাসে ৪০টা রুবলের লোভ ছাড়তে পারো, তাহলে তুমি সম্পূর্ণ স্বাধীন। আমরা পড়তাম। শত শত বই পড়েছি। আমরা গল্পগুজব করতাম। ভাবতাম যে আমরা নতুন নতুন ভাবনার জন্ম দিচ্ছি। আমরা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতাম, কিন্তু আমাদের ভয় ছিল যে বিপ্লব পর্যন্ত বাঁচব না। আসলে, আমরা ছিলাম সম্পূর্ণভাবে ঘেরাটোপে আবদ্ধ মানুষ, চারপাশের দুনিয়ায় কত কী ঘটছে, আমরা তার কিছুই জানতাম না। আমরা ছিলাম “ঘরের লতাগুল্ম”। পরে বুঝতে পারলাম, আমাদের সবকিছু ছিল কল্পনা। পশ্চিমা দুনিয়া, পুঁজিতন্ত্র, রুশ জাতি—সবকিছু সম্পর্কে আমরা যা জানতাম বলে মনে করতাম, তার সবই ছিল আমাদের কল্পনা। আমরা বাস করতাম এক মায়া-মরীচিকার ভুবনে। আমাদের বইপত্রে আর আমাদের রান্নাঘরগুলোতে যে রাশিয়া ছিল, বাস্তবে সেই রাশিয়ার কোনো অস্তিত্বই ছিল না। সমস্ত কিছু ছিল আমাদের করোটির মধ্যে।
‘পিরিস্ত্রোইকায় সব শেষ হয়ে গেল। নেমে এল পুঁজিবাদ...৯০ রুবল হয়ে গেল ১০ ডলার। ও দিয়ে আর বেঁচে থাকা যায় না। আমরা আমাদের রান্নাঘরগুলো থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে এলাম, সেখানে অচিরেই আবিষ্কার করলাম, আমাদের কোনো চিন্তাই আসলে নেই, এই পুরোটা সময় আমরা স্রেফ বসে বসে গল্পগুজব করে কাটিয়ে দিয়েছি। কোত্থেকে একদম নতুন মানুষের আবির্ভাব ঘটল—ম্যাজেন্টা রঙের ব্লেজার গায়ে সোনার আংটি পরা ছেলের দল। চালু হয়ে গেল নতুন নতুন নিয়ম: তোমার টাকা আছে, তুমি মানুষ; টাকা নাই, তুমি কেউ না। তুমি সমস্ত হেগেল পড়েছ তো কী হয়েছে? “মানবিক” কথাটা হয়ে গেল একটা রোগের মতো। মান্দেলশ্তামের কবিতাসমগ্র হাতে নিয়ে ঘোরা ছাড়া ওরা আর কিছু পারে না। অজস্র অজানা দিগন্ত খুলে গেল। বুদ্ধিজীবী সমাজ হয়ে গেল হতদরিদ্র, কদর্য রকমের নিঃস্ব। ছুটির দিনগুলোতে আমাদের বাড়ির পাশের পার্কে হরে কৃষ্ণওয়ালারা কাঙালি খাওয়াতে আসতে লাগল: স্যুপ আর সামান্য কিছু খাবার। সেখানে গণ্যমান্য বয়স্ক লোকদের লম্বা লাইন পড়ে যেত, লাইন এত লম্বা হতো যে তাঁদের গলায় শেষ পর্যন্ত কিছু যেত কি না সন্দেহ। তাঁদের কেউ কেউ মুখ লুকিয়ে থাকতেন। তখন আমাদের ছোট ছোট দুইটা বাচ্চা ছিল। আমাদের দিন কাটত অনাহারে। আমি আর আমার বউ জিনিসপত্র ফেরি করা আরম্ভ করলাম। আমরা আইসক্রিম ফ্যাক্টরিতে গিয়ে চার-পাঁচটা আইসক্রিমের কেস নিতাম, তারপর ঘুরে ঘুরে সেগুলো বেচতাম সবচেয়ে ভিড়ের জায়গাগুলোতে গিয়ে। আমাদের ফ্রিজ ছিল না, ফলে কয়েক ঘণ্টা পরই সব কটি আইসক্রিম গলে যেত। তখন আমরা সেগুলো বিনে পয়সায় দিয়ে দিতাম ক্ষুধার্ত শিশুদের। ওরা কী যে খুশি হতো! আইসক্রিম কেনাবেচার কাজটা করত আমার বউ, আমি শুধু ওগুলো বয়ে নিয়ে বেড়াতাম। আমি সবকিছু করতে রাজি ছিলাম, শুধু বিক্রি করা ছাড়া। বিক্রি করতে আমার ভীষণ অস্বস্তি লাগত, দীর্ঘ দিন ধরে এটা ছিল।
আগে প্রায়ই আমার সেই রান্নাঘরের দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ত...কত ভালোবাসাই না ছিল তখন! কী চমৎকার ছিল মেয়েরা! তারা ধনীদের ঘৃণা করত। টাকা দিয়ে তাদের কেনা সম্ভব ছিল না। আর আজ, আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের সময় কারোর নেই। সবাই টাকা বানাতে ব্যস্ত। টাকা আবিষ্কার যেন অ্যাটম বোমার বিস্ফোরণ...’

গর্বাচভকে ভালোবাসা ও না–বাসা
‘গর্বাচভের সময়...হাসিখুশি চেহারার বিপুল জনতা। মু-ক্তি! সবাই প্রাণভরে মুক্তির নিশ্বাস ফেলছিলাম। গোগ্রাসে গিলছিলাম খবরের কাগজ। বিরাট আশার দিন—এই তো স্বর্গ হাতে পেয়ে যাচ্ছি! গণতন্ত্র ছিল আমাদের কাছে অচেনা এক জন্তু। পাগলের মতো ছুটে যাচ্ছিলাম জনসভা থেকে জনসভায়: এখন আমরা স্তালিন সম্পর্কে সব সত্য জানতে পাব, জানতে পাব গুলাগের সব গোপন কথা, পড়তে পারব রিবাকভের নিষিদ্ধ উপন্যাস আরবাতের ছেলেমেয়েরা আরও আরও ভালো ভালো সব বই—তারপর আমরা গণতন্ত্রী হয়ে উঠব।
কী ভুলটাই না করেছিলাম!
প্রতিটা লাউডস্পিকারে ধ্বনিত হচ্ছিল: আরও তাড়াতাড়ি! আরও জলদি! পড়ো! শোনো!
‘দেখা গেল, এসবের জন্য সবাই তৈরি ছিল না। বেশির ভাগ মানুষই সোভিয়েতবিরোধী ছিল না; সবাই শুধু একটা জিনিসই চাইত—ভালো থাকা। যেন জিন্স কেনা যায়, ভিসিআর কেনা যায়। আর স্বপ্নের শেষ সীমা ছিল নিজের একটা গাড়ি—প্রাইভেট কার। সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় আর ভালো খাবারদাবার।
‘একদিন আমি যখন সোলঝিনিৎসিনের উপন্যাস গুলাগ দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে বাসায় ফিরলাম, মায়ের চক্ষু ছানাবড়া: “তুই যদি এক্ষুনি এই বই নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে না যাস, তাহলে আমিই তোকে বের করে দেব।” যুদ্ধের আগে আগে আমার দাদির স্বামীকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মেরে ফেলা হয়, কিন্তু দাদি বলত, ‘ভাস্কার জন্য আমি মোটেই দুঃখ করি না। ওকে গ্রেপ্তার করে ওরা ঠিকই করেছিল। ওর জিব বড্ড বেড়ে গিয়েছিল।’
‘আমি জিজ্ঞেস করতাম, “দাদিমা, আমাকে এসবের কিছুই কেন আগে বলোনি তুমি?’ ‘আমি যেন আমার জীবন নিয়েই মরে যাই, যেন তোদের ভুগতে না হয়।”
‘আমাদের মা-বাবারা এভাবেই বেঁচে ছিল। তাদের আগে এভাবেই বেঁচে ছিল তাদের মা-বাবারা। সবকিছুর ওপর বুলডোজার চালিয়ে দেওয়া হলো। পিরিস্ত্রোইকা মানুষে করেনি, পিরিস্ত্রোইকা এনেছিল শুধু একটা লোক—গর্বাচভ। গর্ভাচভ আর গুটিকয় বুদ্ধিজীবী...’
‘গর্বাচভ আমেরিকার সিক্রেট এজেন্ট...কোনো এক গুপ্তসংঘের সদস্য...সে কমিউনিজমের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। “সব কমিউনিস্টকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দাও, সব কমসোমল সদস্যকে আবর্জনার স্তূপে!”
‘আমি গর্বাচভকে ঘৃণা করি, কারণ সে আমার মাতৃভূমিকে চুরি করেছে। আমি আমার সোভিয়েত পাসপোর্ট যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছি। হ্যাঁ, আমরা ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুরগি আর পচা আলু কেনার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। কিন্তু ওটাই তো ছিল আমার জন্মভূমি। আমি আমার সেই জন্মভূমিকে ভালোবাসতাম। আপনারা বাস করতেন গরিব দেশে যার মেলাগুলা মিসাইল ছিল, আর আমার জন্য সেই দেশ ছিল মহান এক দেশ। পাশ্চাত্যের কাছে রাশিয়া সব সময়ই শত্রু, ওরা রাশিয়াকে ভয় পায়। রাশিয়া ওদের গলার কাঁটা। শক্তিশালী রাশিয়া কেউ চায় না, সেখানে কমিউনিস্টরা থাক বা না থাক। ওরা আমাদের দেখে একটা ভান্ডার হিসেবে, যেখানে হানা দিলে তেল, গ্যাস, কাঠ আর নানা রকমের মূল্যবান ধাতু পাওয়া যাবে। এখন আমরা তেল বেচে বিদেশ থেকে জাইঙ্গা-প্যান্টি কিনে আনি। কিন্তু আমাদের দেশ ছিল একটা সভ্যতা, যেখানে তেনা-আবর্জনা ছিল না। সোভিয়েত সভ্যতা! কোনো একজনের দরকার পড়েছিল সেই সভ্যতাকে শেষ করে দেওয়ার। অপারেশন সিআইএ। এখন আমাদের চালায় আমেরিকানরা। সে জন্য ওরা গর্বাচভকে পকেট ভরে দিয়েছে...আজ হোক, কাল হোক, ওর বিচার হবে। দোয়া করি, জনরোষের কবলে পড়ার জন্য শয়তানটা যেন তত দিন বেঁচে থাকে। আমি হলে হাসতে হাসতে ওকে বুতোফস্কি ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে যেতাম, মাথার পেছনে গুলি করে খুলি উড়িয়ে দিতাম (টেবিলে ঘুষি মারলেন)। সুখের বন্যা বয়ে যাচ্ছে, না? সালামি পাওয়া যাচ্ছে, কলাও পাওয়া যাচ্ছে! আরে, আমরা তো গুয়ের মধ্যে গড়াগড়ি খাচ্ছি, বিদেশি অখাদ্য খাচ্ছি। মাতৃভূমির বদলে বিশাল এক সুপারমার্কেট। এর নাম যদি হয় মুক্তি, তাহলে এই মুক্তির আমার দরকার নাই। থুহ্!
‘মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেছে, হাঁটু ভেঙে পড়ে গেছে! আমরা এখন দাস। দাস! কমিউনিস্টদের আমলে, লেলিন যেমন বলতেন, কমিউনিস্টদের আমলে রাষ্ট্র চালাত রাঁধুনি: শ্রমিক, মজুর, গোয়ালিনী, তাঁতিরা। আর এখন পার্লামেন্টে বসে আছে দুর্বৃত্তরা। ডলার লাখপতিরা। ওদের ঢোকানো উচিত গারদে, পার্লামেন্টে নয়। পিরিস্ত্রোইকার নামে ওরা আমাদের ধোঁকা দিয়েছে!
‘আমি সোভিয়েত ইউনিয়নে জন্মেছিলাম, সোভিয়েত ইউনিয়নে আমার ভালো লাগত। আমার বাবা ছিল কমিউনিস্ট। প্রাভদা পত্রিকা দিয়ে সে আমাকে পড়তে শিখিয়েছিল। প্রতিটা উৎসবের দিন আমি বাবার সঙ্গে প্যারেডে যেতাম। আমাদের চোখে পানি এসে যেত...আমি ছিলাম পিচ্চি পাইওনিয়ার, গলায় লাল স্কার্ফ পরতাম। তারপর গর্বাচভ এল, আমার আর কমসোমল হওয়া হলো না। এই দুঃখ আমার আজও গেল না। আমি একটা সাভোক, না? (সাভোক মানে সোভিয়েতমনস্ক ব্যক্তি)। আমার মা-বাবা, দাদা-দাদি—ওরাও সাভোক, তাই না? আমার সাভোক দাদা নাৎসি বাহিনীর হাত থেকে মস্কোকে রক্ষা করতে গিয়ে ১৯৪১ সালে মারা গেছে...আমার সাভোক দাদি লাল বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে...আজ মিস্টার লিবারেলরা তাদের সত্য নিয়ে হাজির হচ্ছে! তারা চায়, আমরা যেন আমাদের এই ইতিহাসকে একটা কালো অধ্যায় মনে করি। আমি ওদের সবাইকে ঘৃণা করি: গর্বাচভ, শেভার্দনাদ্জে, ইয়াকবলেভ—প্রত্যেককে ঘৃণা করি। আপনি এদের নাম বড় হরফে লিখবেন না যেন, ছোট হরফে লেখেন! হ্যাঁ, আমি এদের এতই ঘৃণা করি। আমি আমেরিকা চাই না, আমি সোভিয়েত ইউনিয়ন চাই।”

***
‘দিনগুলো ছিল চমৎকার, ভোলাভালা দিন...আমরা গর্বাচভকে বিশ্বাস করেছিলাম, আজ আর অত সহজে কাউকে বিশ্বাস করব না। যেসব রুশ দেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে বসত গড়েছিল, তারা ফিরে আসতে শুরু করল, তারা তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে আসছিল...কী যে আনন্দ চারদিকে! মনে হয়েছিল, এই অচলায়তন আমরা ভেঙে ফেলতে যাচ্ছি, সে জায়গায় গড়ে তুলতে যাচ্ছি নতুন কিছু। আমি মস্কো স্টেটস ইউনিভার্সিটির ফিলোলজি ফ্যাকাল্টি থেকে পাস করে পরবর্তী গবেষণা শুরু করেছিলাম। ভাষাবিজ্ঞানে কাজ করার স্বপ্ন দেখতাম, আমার আইডল ছিলেন আভেরিনৎসেভ, তাঁর লেকচার শুনতে সারা মস্কোর বিদ্বজ্জনেরা ভিড় করতেন। আমরা আড্ডায় মিলিত হতাম আর একে অন্যের অলীক স্বপ্নে ইন্ধন জোগাতাম: অচিরেই আমাদের দেশ সম্পূর্ণ বদলে যাবে, সেই জন্যই আমরা লড়াই করে চলেছি। একদিন যখন শুনলাম আমার এক ক্লাসমেট ইসরায়েল চলে যাচ্ছে, ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। ‘এ রকম একটা সময়ে তুই দেশ ছেড়ে চলে যাবি? পরিবর্তন তো মাত্রই শুরু হয়েছে। এখন চলে যেতে খারাপ লাগবে না তোর?’
“মুক্তি! মুক্তি!” বলে কথা আর লেখা যতই বাড়ছিল, তত দ্রুতই দোকানের তাকগুলো ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল। শুধু যে পনির আর মাংসই উধাও হয়ে যাচ্ছিল তা নয়, নুন-চিনিও হাওয়া হয়ে যাচ্ছিল। ঠনঠনে খালি দোকানপাট। ভয়াবহ অবস্থা। রেশন কার্ড চালু হয়ে গেল, যেন যুদ্ধ পরিস্থিতি। রক্ষা যে দাদিমা আমাদের সঙ্গে ছিল, বেচারি সারাটা দিন ধরে সারা মস্কো ঘুরে ঘুরে আমাদের রেশন কার্ডের প্রাপ্য জিনিসপত্র সংগ্রহ করে বেড়াত। আমাদের ব্যালকনি পুরোটাই ভরে উঠল ডিটারজেন্ট পাউডারের প্যাকেটে, শোবার ঘর ভর্তি হলো চিনি আর শস্যদানার বস্তায়। যখন মোজা কেনার জন্য ভাউচার বিতরণ শুরু হলো, বাবা কাঁদতে লাগল: “এর মানে সোভিয়েত ইউনিয়ন শেষ।” বাবা বুঝতে পেরেছিল ভাঙন আসছে...বাবা কাজ করত এক সামরিক কারখানার কনস্ট্রাকশন ব্যুরোতে, মিসাইল নিয়ে ছিল তার কাজকারবার। কাজটা তার খুব পছন্দ ছিল। বাবার ছিল দুইটা মাস্টার্স ডিগ্রি। তারপর একদিন হঠাৎ তাদের কারখানায় মিসাইলের বদলে বানানো শুরু হলো ওয়াশিং মেশিন আর ভ্যাকুয়াম ক্লিনার। বাবা ছাঁটাই হয়ে গেল। আমার বাবা-মা দুজনেই ছিল পিরিস্ত্রোইকার প্রবল সমর্থক; পোস্টার লিখত, লিফলেট বিলি করে বেড়াত, শেষে তাদের পরিণতি হলো এই...সবকিছু হারিয়ে পথে বসল। তারা বিশ্বাসই করতে পারেনি যে ‘মুক্তি’র চেহারা এই রকম। তারা মেনে নিতে পারেনি।
‘এর মধ্যে রাস্তায় রাস্তায় হয়েছে চিৎকার, “গর্বাচভের কানাকড়ি দাম নাই, ইয়েলৎসিন জিন্দাবাদ!” লোকজন ব্রেঝনেভ আর গর্বাচভের ছবি পাশাপাশি নিয়ে ঘোরে: ব্রেঝনেভের ছবি মেডেলে ভরা, আর গর্বাচভের ছবি রেশন কার্ডে ঢাকা। সেই ছিল ইয়েলৎসিনের রাজত্বের শুরু: গাইদারের অর্থনৈতিক সংস্কার। আর এই সমস্ত ‘কেনা আর বেচা’ আমার অসহ্য...কিন্তু টিকে থাকার জন্য আমাকে পোল্যান্ড যাওয়া-আসা শুরু করতে হলো, সঙ্গে বড় বড় ব্যাগে ইলেকট্রিক বাল্ব আর বাচ্চাদের খেলনা। ট্রেনের বগি ভরে যেত শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তারে...প্রত্যেকের সঙ্গে ব্যাগ আর বস্তা। সারা রাত ধরে আমরা গল্প করতাম পাস্তেরনাকের ডক্টর জিভাগো নিয়ে, শাতরোভের নাটকগুলো নিয়ে...যেন আমরা এখনো মস্কোর কোনো রান্নাঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের কথা যখন ভাবি...আমরা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু হয়েছি: কেউ বিজ্ঞাপনী সংস্থার সিনিয়র ম্যানেজার, কেউ ব্যাংক টেলার, কেউ ভ্রাম্যমাণ সুটকেস ব্যবসায়ী..., কিন্তু ভাষাবিজ্ঞানী হওয়া কারোরই হয়নি। আমি কাজ করি একটা রিয়েল এস্টেট এজেন্সিতে, মালিক গ্রাম থেকে আসা এক মহিলা, কমসোমলের নেতা ছিলেন। আজ রাশিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের মালিক কারা? সাইপ্রাস, মায়ামিতে প্রাসাদোপম বাড়ি আছে কাদের? কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক হর্তাকর্তাদের। পার্টির এত টাকাপয়সা গেল কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে তাদেরই ধরতে হবে। আর আমাদের নেতা যারা ছিল, ষাটের দশকের সেই ভিন্নমতাবলম্বীরা, যুদ্ধের সময় তারা জেনেছিল রক্ত কী, কিন্তু তারা ছিল শিশুর মতো নির্বোধ...আমাদের উচিত ছিল রাতদিন রাজপথে থেকে যাওয়া; আমরা যা চেয়েছিলাম, সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের জন্য একটা নুরেমবার্গ ট্রায়াল, সেটার জন্য সংগ্রাম করে যাওয়া আমাদের উচিত ছিল। কিন্তু আমরা সবাই বড্ড আগেভাগে ঘরে ফিরে গেলাম। চোরাকারবারি আর ফাটকাবাজেরা ক্ষমতা নিয়ে নিল। মার্ক্স বলেছিলেন, সমাজতন্ত্রের পর আসবে সাম্যবাদ, কিন্তু আমরা করছি উল্টোটা: সমাজতন্ত্রের পর চালু করছি পুঁজিবাদ। (নীরবতা) কিন্তু আমি সুখী যে ওই সময়টার ভেতর দিয়ে এসেছি। আজ সমাজতন্ত্র নেই! শেষ, আর ফিরে আসবে না। এখন আমরা বাস করছি অন্য এক পৃথিবীতে, সবকিছু দেখছি ভিন্ন চোখে। আমি কখনো ভুলব না, সেই দিনগুলোতে কী মুক্তভাবেই না নিশ্বাস নিতাম...’

রুশ থেকে অনুবাদ: শুভময় হক