একুশের সহজপাঠ

একুশের মুহূর্তগুলো

আহমদ রফিক

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: আগস্ট ২০১৭, ৮০ পৃষ্ঠা, দাম: ১৬০ টাকা।

যে ভাষা আন্দোলনের গর্ভে রোপিত হয়েছিল ভবিষ্যৎ ‘বাংলাদেশ’ নামের জাতিরাষ্ট্রের অস্তিত্বের বীজ, সেই ঐতিহাসিক আন্দোলনের ইতিহাস যতই রচিত হবে, ততই তা খুশির কারণ হয়ে উঠবে। বিশেষত সেটি যদি রচনা করেন ভাষা আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণকারী ও তার সংগঠকদের কেউ। তাই ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিকের লেখা একুশের মুহূর্তগুলো বইটি যখন হাতে এল, মনে পড়ল ভাষা আন্দোলন নিয়ে আগেও গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখার ব্যাপারে এখনো তাঁর বিরাম নেই। এর প্রমাণ আমরা পাই আলোচ্য বইয়ের ভূমিকা থেকে, যেখানে তিনি লেখেন, ‘...বাংলাদেশের শিশু-কিশোর থেকে সব বয়সের মানুষেরই ভাষা আন্দোলন সম্বন্ধে জানা দরকার। বিশেষ করে কিছু কিছু ঘটনা, যা ভাষা আন্দোলন সফল হতে সাহায্য করেছিল। এগুলোকে আমরা বলেছি একুশের বাঁক ফেরা বিশেষ ঘটনা। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা নিয়ে যেমন, তেমনি এ দেশের বাঙালি মুসলমানের জাতীয় ভাষা কী হবে, তা নিয়েও একসময় বিতর্ক হয়েছে। সে ইতিহাসও গুরুত্বপূর্ণ। তা-ও খুব সংক্ষেপে ও সহজভাবে এ বইতে তুলে ধরা হয়েছে।’

বইটি কলেবরে ছোট, মাত্র ৮০ পৃষ্ঠার, তারপরও বিন্দুতে সিন্ধুর বিস্তার আছে বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ে।

শুরু হয়েছে মধ্যযুগ থেকে। সে সময়ও ভাষার লড়াই ছিল। লেখক জানাচ্ছেন, ‘এ অবস্থাটা ছিল মধ্যযুগের মাঝামাঝি সময় থেকে। যখন সৈয়দ সুলতান, দৌলত কাজী, আবদুল হাকিম প্রমুখ কবি বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা এবং কাব্যচর্চা উপযোগী ভাষা হিসেবে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করেন।’ তুলে ধরছেন তিনি কবি আবদুল হাকিমের কবিতার সেই দুটি পঙ্‌ক্তি, যার মাধ্যমে তিনি ধিক্কার দিচ্ছেন তাদের, দেশি ভাষায় যাদের মন জুড়ায় না, এমনকি দেশ ছেড়ে তাদের বিদেশে চলে যেতেও বলছেন তিনি।

‘বিশ শতকেও এ বিতর্ক শেষ হয়নি’ শিরোনামের অধ্যায়ে আহমদ রফিক ইতিহাসের এমন সব তথ্যের আশ্রয় নিয়েছেন, যার ভেতর দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বাংলা ভাষা নিয়ে বিতর্কের উৎসগত পটভূমিটি। কীভাবে এই বিতর্কের শুরু, কারা বাংলা ভাষার পক্ষে ও বিপক্ষে এবং মাঝামাঝি অবস্থানে কারা, এ অধ্যায়ের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন তিনি তাঁদের চেহারা ও চরিত্র।

বাংলা ভাষা, না উর্দু—কোনটি বাঙালি মুসলমানের রাষ্ট্রভাষা হবে, বিশেষত ১৯৪৭ সালে ভারত ভেঙে সৃষ্ট কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তান, তথা তার পূর্ব অংশ পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষীদের, এ নিয়ে তর্ক আর থামে না। শুরু হয় পক্ষে-বিপক্ষে লেখালেখি।

‘আন্দোলন নিয়ে লেখালেখি যেভাবে শুরু’ পাঠ থেকে আমরা জানতে ও অনুমানও করতে পারব, কেন রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার এক বছরের মাথাতেই ভাষা আন্দোলন শুরু হয়ে যাচ্ছে; যে আন্দোলন পরিণতি পায় ১৯৫২ সালে কিছু তরুণ তাজা প্রাণের বীরত্বসূচক আত্মদানের ভেতর দিয়ে।

‘অগ্নিকণার মতো ছোট ছোট ঘটনা’, ‘পলাশী ব্যারাকে হামলা ও সম্মিলিত প্রতিবাদ’, ‘আন্দোলনে পিছুটান বিশেষ দলের’, ‘গণপরিষদ থেকে ঢাকার রাজপথ’, ‘জিন্নাহর ঢাকা সফর, কার্জন হলে ভাষণ ও ছাত্রদের প্রতিবাদ’, ‘আন্দোলনের চাপে বাতিল মূলনীতি কমিটির সুপারিশ’, ‘মূলনীতিবিরোধী আন্দোলনের প্রভাব ছিল ব্যাপক’, ‘একটি ইশতেহার ও একটি ধর্মঘট’, ‘তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ’, ‘বিস্ফোরণ ঘটায় একটি বক্তৃতা’, ‘একুশের দুপুরে পুলিশের গুলি জ্বলে ওঠে আগুন’, ‘অভাবিত ঘটনা: ছাত্র আন্দোলন এক দিনেই গণ-আন্দোলনে পরিণত’, ‘শহীদ দিবসকে কালজয়ী করে শহীদ মিনার’, ‘প্রথম শহীদ দিবস: আবারও শহীদ মিনার’, ‘“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো” হয়ে উঠল প্রভাতফেরির গান’ ও ‘একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবস পালন ১৯৫৩ থেকে’ শিরোনামের অধ্যায়গুলো পাঠ করলে কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সী পাঠকদের চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে আমাদের ভাষা আন্দোলন। বোঝা যাবে এ আন্দোলন কোনো সহজ-সরল পথ ধরে এগোয়নি, ফুলে ছাওয়া ছিল না তার পথ। বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রক্তিম করেই শহীদেরা ভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। সহজ-সুখপাঠ্য ভাষায় সেই আন্দোলনেরই ইতিহাস লেখক লিখেছেন এই বইয়ের পাতায় পাতায়।