পাঠ বদলে যায়

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম
কোলাজ: মনিরুল ইসলাম

পাঠকের যে মৃত্যু হয় তা এই বাংলা ভাষারই এক খ্যাতিমান সাহিত্যিক একটি অনুগল্পে বহু দিন আগে জানিয়ে গিয়েছেন। তিনি যা বলেননি বা উহ্য রেখেছিলেন তা হলো একই পাঠক এক বা একাধিকবার মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে বা মৃত্যুবরণ করেও পুনর্জন্ম লাভ করতে পারেন।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের রুচি পাল্টায়, সেই সঙ্গে পাল্টায় পাঠের ধরন। ভেঙে বললে, যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি (পাঠক) একসময় একটা লেখা পড়েছিলেন, তা পরবর্তী পাঠে বদলে যেতেই পারে। এর পেছনে নানা কারণের মধ্যে একটি তাঁর নিজস্ব মনোজগতের পরিবর্তন বা অন্যভাবে বললে নতুন করে বিচার-বিশ্লেষণের প্রবণতা।

 এই পাঠ বদলে যাওয়া মোটেও কোনো আবিষ্কারের বিষয় নয়, যদিও এতে চমক রয়েছে। এ অভিজ্ঞতা সব পাঠকের বেলায় না ঘটলেও অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটা স্বাভাবিক। আবার এ-ও বলে রাখা অসংগত নয় হবে না যে পাঠ-প্রতিক্রিয়া অনড়, স্থায়ী আসন গেড়ে বসবে, এমনটা আশা করাও কাঙ্ক্ষিত নয়।

 ব্যক্তিগত বেশ কিছু অভিজ্ঞতা থেকে দুটোর উল্লেখ করছি। অস্কার ওয়াইল্ডের দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে ও সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের অলীক মানুষ উপন্যাস দুটো কবে প্রথম পড়েছিলাম মনে নেই। ডোরিয়ান গ্রে খুব সম্ভবত ছাত্রাবস্থায়। বিশেষ কোনো কার্যকারণ ছাড়াই বই দুটি মাস কয়েক আগে অল্প বিরতিতে আবার পড়লাম। সত্যি বলতে, পড়তে বাধ্য হলাম। কারণ, নাড়াচাড়া করে খানিকটা এগোতে গিয়ে মনে হলো আগের পাঠের ছাপ মুছে যাচ্ছে।

অলীক মানুষ-এর কথা বলি। পূর্বপাঠের যে স্মৃতি মাথায় ছিল তাতে উপন্যাসটির ব্যাপক খ্যাতি সত্ত্বেও মনে হয়েছিল কোথাও কোথাও বেশ লাগামছুট ও খাপছাড়া। এ-ও মনে হয়েছিল, একটা গল্প বলতে গিয়ে সিরাজ অন্য গল্পে ঢুকে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন।

 দ্বিতীয় পাঠে প্রথম বাক্যেই ধাক্কা খেলাম। উপন্যাসের প্রথম বাক্যটি যে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচ্যুউড-এর শুরুর বাক্যের প্রায় হুবহু প্রতিধ্বনিময়! দুই উপন্যাসেই মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত প্রধান দুই চরিত্রের মনে তাদের অতীতের দুটো ঘটনার স্মৃতি জেগে ওঠে। মার্কেসের উপন্যাসে কর্নেল বুয়েন্দিয়ার স্মৃতিতে ভাসে জীবনে প্রথম বরফ দেখার অভিজ্ঞতা আর সিরাজের উপন্যাসের নায়ক শফিউজ্জামানের মনে পড়ে একজন কালো ও একজন সাদা মানুষের কথা।

 ব্যাপারটা যে কাকতালীয় বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেক খ্যাতনামা লেখকের রচনায় খ্যাত-অখ্যাত অন্য লেখকের অনুভূতির বুদ্‌বুদ ফোটে, এমনকি কোথাও কোথাও প্রকাশভঙ্গির সাযুজ্যও। তবে দ্বিতীয় দফায় অলীক মানুষ পড়তে গিয়ে যে বিষয়টি লক্ষ করলাম, সিরাজ মোটেও এক গল্পের ভেতর খাপছাড়াভাবে অন্য গল্প পুরে দেননি। তিনি বড় পরিসরে একটা গল্পই বলে গেছেন, যার ভেতরে এসেছে অন্য গল্প। মূল গল্প শফিউজ্জামানের, যাকে নিয়ে উপন্যাসের শুরুর বাক্যটি রচিত।

 তার মানে প্রথম পাঠে, অভিনিবেশের ঘাটতিতে বা অন্য কোনো কারণে এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল। অভিনিবেশের ঘাটতির কথা লিখছি বটে, কিন্তু পুরোপুরি সায় পাচ্ছি না। বরং অন্য কারণও যে এখানে ভূমিকা রাখতে পারে তা উড়িয়ে দেওয়াও যুক্তিসংগত মনে হচ্ছে না। কারণটা এই—শফিউজ্জামানকে দিয়ে শুরু করলেও লেখক খুবই দ্রুত যে আখ্যানে পাঠককে আমন্ত্রণ জানান এবং পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠাজুড়ে (শতাধিক) অসামান্য দক্ষতায় পাঠককে আটকেও রাখেন তা শফিউজ্জামানের পিতা বদিউজ্জামানের প্রহেলিকাময় ধর্মাচারের বৃত্তান্ত। পাঠক সেই আখ্যানে এমনই বুঁদ হয়ে থাকেন যে পরে যখন লেখক শফিউজ্জামানের গল্পে ফেরেন আর সেখানেই শেষাবধি থিতু হন, একটা ধাক্কা আসে বৈকি। পিতা বদিউজ্জামানের রহস্যময় লৌকিক-অলৌকিক জীবনাচার ঘিরে যে আখ্যান তুমুল কৌতূহল নিয়ে পাঠককে আন্দোলিত করে তা শেষ হয়ে যেতে মনে কি হয় না লেখকের রসদও ফুরিয়ে গেল? অন্যভাবে বললে, বদিউজ্জামানের আখ্যানের ফাঁকে ফাঁকে তিনি শফিউজ্জামানের বিষয়ে পাঠকমনে যথেষ্ট আগ্রহ-কৌতূহল জাগাতে না পারাই কি এর কারণ? রুকুর জন্য শফিউজ্জামানের নীরব ভালোবাসা পাঠককে তার প্রতি আগ্রহী করে তুললেও সে ভালোবাসার জঘন্যতম পরিণতিতে কি সে তার ন্যায্য আসনটি উপন্যাসে হারিয়ে ফেলে? দ্বিতীয় পাঠে মুস্তাফা সিরাজের অলীক মানুষকে এ রকমই মনে হয়েছে, যা পূর্বেকার পাঠের খামতির খানিকটা যুক্তিও বটে।

দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রের সুনাম-দুর্নাম দুইয়ের পেছনেই এ উপন্যাসে সমলিঙ্গের সম্পর্ক ও প্রেয়বাদী (হিডোনিস্টিক) জীবনযাপনের বিবরণ। তৎকালীন ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ডের নৈতিকতার বিকৃত, বিধ্বংসী রূপকার হিসেবে লেখক অস্কার ওয়াইল্ড এ বইয়ের কারণে যথেচ্ছ বিরূপ সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। ক্ষেত্রবিশেষে এ ধরনের সমালোচনা কোনো বইয়ের পাঠকচাহিদা বৃদ্ধিতে এতটাই কার্যকর, পয়সা খরচ করে বিজ্ঞাপন ছাপানোর চেয়েও তা বহুগুণ পারঙ্গম। বাস্তবে ডোরিয়ান গ্রের ক্ষেত্রে হয়েওছিল তা-ই। যার মানে পাঠককুলের একটা বড় অংশ এ উপন্যাসকে সেভাবেই বিবেচনা করতে প্রস্তুত ছিলেন; এবং আজও বিস্তর পাঠক তাই-ই করছেন।

 অনেক বছর আগে উপন্যাসটি পড়ার পূর্বে এ ধারণাই কাজ করেছিল, আর পড়তে গিয়ে এমন এক আচ্ছন্নতা পেয়ে বসেছিল, যে করণে গল্প-কাঠামোর বাইরে উপন্যাসটি যে শিল্প ও নন্দনতত্ত্বের ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন তা অপরিণত পাঠকের যথেষ্ট মনোযোগ পায়নি। সেই সঙ্গে এ কথাও বলা জরুরি যে সাম্প্রতিক পাঠে উপন্যাসের শুরু থেকেই একটা রহস্যগল্পের আঁচ পেতে পেতে এগিয়েছি। উপন্যাসের প্লটকে মনে হয়েছে রহস্যগল্পের ছাঁচে তৈরি। ডোরিয়ানের সঙ্গে লর্ড হেনরির ঘনিষ্ঠতা, ডোরিয়ানের স্বল্পকালীন প্রেমিকা সিবিল ভ্যাইনের সঙ্গে তার সম্পর্কের উত্থান-পতন, প্রেমে প্রত্যাখ্যাত সিবিলের আত্মহত্যা, ডোরিয়ানের হাতে শিল্পী বাসিলের খুন হওয়া ও বাসিলের মৃতদেহকে চুপিচুপি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি নাটকীয় ও অতিনাটকীয় ঘটনাপ্রবাহ রহস্যগল্পের রসদ হিসেবেই যেন মানানসই। ওয়াইল্ড নিজে রহস্যকাহিনির সমঝদার পাঠক হলেও ডোরিয়ারেন মনোজগতের গতি-প্রকৃতির বয়ান দিতে গিয়ে তিনি যে রহস্যগল্পের আয়োজন করেছেন তাতে তাঁর লেখনীর খামতি চাপা পড়েনি। বিশেষ করে যে দৃশ্যে সিবিলের প্রতিশোধ উদ্যত ভাই জেমস ভ্যাইন শিকারি দলের একজনের বন্দুকের গুলিতে চরম নাটকীয় পরিস্থিতিতে নিহত হয়, তা একজন অপটু রহস্যকাহিনি লেখকের দুর্বলতাকেই বুঝি ধরিয়ে দেয়। কিন্তু বাস্তব তো এই ওয়াইল্ড রহস্যগল্প লিখতে বসেননি।

 উপন্যাসের আপাত-শান্ত, গুরুগম্ভীর এবং শিল্প ও নন্দনতত্ত্ব নিয়ে বিস্তর কৌতূহল উদ্দীপক ও উসকানিপ্রবণ কথাবার্তার মধ্যে (যা অবশ্যই এ বইয়ের অনন্য সম্পদ) ঘটনার পর ঘটনার নাটকীয়তা পূর্বপাঠের অভিজ্ঞতাকে বদলেই দেয়নি, রচয়িতার কিছু কিছু দুর্বলতাকেও মোটা দাগে ধরিয়ে দিয়েছে। তবে ডোরিয়ানের পরিবর্তনশীল মন-মানসিকতার সঙ্গে তার আত্মপ্রতিকৃতির বদলে যাওয়া এবং একপর্যায়ে ডোরিয়ান যে তার আত্মপ্রতিকৃতির ছায়া বা নিষ্প্রাণ প্রতিবিম্ব ছাড়া কিছু নয়—এই অসামান্য ভাবনাটি প্রথম পাঠে যেমন আলোড়িত করেছিল, দীর্ঘ বিরতিতে পরবর্তী পাঠেও তা অটুট ছিল। দ্বিতীয় পাঠে এমনও মনে হয়েছে, ওয়াইল্ড এ গল্পটা কি অন্যভাবে লিখতে পারতেন না—অতিনাটকীয়তা বাদ দিয়ে?

 যে দুটি উপন্যাসের পাঠান্তরের কথা বললাম, এমন অভিজ্ঞতা আরও রয়েছে। সচেতন পাঠকমাত্রই নিজের পাঠ বদলে যাওয়ার বিষয়ে ওয়াকিবহাল। তারপরও কথা থাকে—কোনো পাঠই চূড়ান্ত নয়। একটি গুরুত্বপূর্ণ বই পাঠকের কাছে যেমন পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানায়—যুগ যুগ ধরে জানায়, তেমনি সচেতন পাঠকের মনেও একই বই নানাভাবে পড়ার আগ্রহ-কৌতূহল জাগা স্বাভাবিক।

 পাঠ-প্রতিক্রিয়ার এই বাঁকবদল অভিজ্ঞতা হিসেবে অবশ্যই চমকপ্রদ। অপরিণত ও পরিণত বয়সে পাঠ-বদলকে অনেকটা স্বাভাবিক ধরে নিলেও এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে পরিপক্ব পাঠকও যখন পাঠান্তরের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন তখন এর মূলে থাকেন লেখক নিজে। সে ক্ষেত্রে তাঁর বইটিকে হতে হয় বহুস্বরিক, ইংগিতবহুল ও নানামুখী ব্যাখ্যাপ্রবণ। এমন বইয়ের পক্ষেই সম্ভব পূর্বপাঠের অভিজ্ঞতা ছাপিয়ে পাঠকের মনে নতুন নতুন ইশারার জন্ম দেওয়া।