পদার্থবিদের হাতে থ্রি নট থ্রি

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

‘আমি এসআই দেবব্রত হাওলাদার, সঙ্গী কং/ ২৭৪২৭ মো. জহুরুল ইসলাম, উভয় থানা শাহবাগ, ডিএমপি, ঢাকা। অদ্য ২৭ / ০২ / ১৫ তারিখে সকাল ১১.৪৫ ঘটিকায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ ফরেনসিক মর্গে উপস্থিত হইয়া মৃতের বাবা ড. সুজেয় কুমার চৌধুরী-এর সনাক্তমতে ও পার্শ্বলিখিত সাক্ষীদের মোকাবিলায় মৃতদেহটি মর্গের ট্রলিতে উত্তর শিহরি অবস্থায় পাইয়া মর্গের কর্মরত কর্মচারী হাবিবের সহায়তায় মৃতদেহটি ওলট-পালট করে দেখিয়া উক্ত মৃতদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করিতে আরম্ভ করিলাম:

মৃতদেহটি লম্বা অনু: ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি, গায়ের রং: ফরসা, মুখমণ্ডল লম্বাটে। মাথার চুল কালো, লম্বা অনু: ১.৫ ইঞ্চি। চোখ বন্ধ। নাক-কান স্বাভাবিক। মুখ বন্ধ। দাঁড়ি-গোঁফ নাই। কপালের বাম পাশে ভ্রুতে ছিলা জখম। ঘাড়ের ডান পাশে অনু: ৩ ইঞ্চি কাটা জখম। মাথার ডান পাশে অনু: ৬ ইঞ্চি লম্বা কাটা রক্তাক্ত জখম, যার গভীরতা অনু: ২ ইঞ্চি। উক্ত জখমের পাশাপাশি ২টি গভীর কাটা রক্তাক্ত জখম। ঘাড়ের পেছনে ১টি কাটা রক্তাক্ত জখম। পিঠের বাম পাশে ১টি কাটা জখম। মলদ্বার ও গোপনাঙ্গ স্বাভাবিক। ডান হাতের কবজিতে কালো ফোলা জখম। ডান পায়ের পাতায় কালো ফোলা জখম। পা দুটি সোজা অবস্থায় আছে।’

ছেলে হত্যা মামলার নানা কাগজপত্র নাড়াচাড়া করেই আজকাল তাঁর দিনের একটি বড় সময় কেটে যায়। থানায় দাখিল করা এজ.াহার, এফআইআর, পত্রপত্রিকার কাটিংসহ কত কী খুঁটিনাটি। শুধু এই ফরেনসিক প্রতিবেদন তাঁর সহ্য হয় না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় ফাইল থেকে প্রতিবেদনটি বের করে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করবেন। তাঁর রাজপুত্রের মতো সুন্দর ছেলের নিষ্পাপ মুখটি তাঁর দুই চোখে অমনভাবেই নিষ্পাপ আর অমলিন থাকুক আজীবন। কিন্তু অমলিন ছিল না, ছিল না! ডিএমসিএইচ হাসপাতালের মর্গের ট্রলিতে শোয়া শুভ্রজিতের কপাল-ঘাড়-মাথা আর পিঠে কত কত অস্ত্রের দাগ! তাজা রক্তের, রুধিরের হু হু প্লাবন। মৃত্যুর সময় শুভ্রজিতের মুখটি সেই শৈশবের লাড্ডুর মতো হয়ে গিয়েছিল। তাঁর শাশুড়ি আদর করে দুই নাতির ডাক নাম রেখেছিলেন লাড্ডু আর সন্দেশ। আট মাসের লাড্ডু দুই হাত আর দুই পায়ে হামাগুঁড়ি দিয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় তাঁর পাশে এসে দাঁড়াত। খলখল হাসিতে সোফাসেটের টেবিলে ছড়ানো তাঁর কাগজপত্রে থাবা দিত। সেটা বাহাত্তর সালের মে মাসের কথা। লাড্ডু জন্মেছিল একাত্তরের সেপ্টেম্বরে। আসামের শিবসাগর মাতৃসদনে স্ত্রী যখন প্রথম পুত্রের জন্ম দিচ্ছিলেন, তিনি ছিলেন বাংলাদেশ-আসামের সোনামুরা সীমান্তে। যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনে।

এর মাত্র বছর দুয়েক আগে ব্রিটেন থেকে পদার্থবিদ্যায় পিএইচডি আর বছর দুই পোস্ট ডক শেষ করে দেশে ফিরেছিলেন। পিএইচডি আর পোস্ট ডকে লেগেছিল বছর ছয়েক। ১৯৬৩ সালে দেশে বিয়ে করে রেখে যাওয়া স্ত্রী তাই প্রথম মা হন ১৯৭১-এ এসে। বিয়ের পরই বিদেশে চলে গিয়েছিলেন বৃত্তি নিয়ে।

‘না-না বাবা লাড্ডু, কাগজে হাত দেয় না!’

খলখল হাসতে থাকা লাড্ডু তবু টেবিলে ছড়ানো যুবক বাবার একরাশ এলোমেলো কাগজপত্রের দিকে একনিষ্ঠ সংকল্পে অগ্রসর হয়। তাঁর পিএইচডি সুপারভাইজারের চিঠি এসেছে। তখন আজকের মতো ই-মেইল ছিল না, ‘তুমি কি আজীবন ওই ছোট্ট, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে পড়ে থাকবে সুজেয়? বিজ্ঞানীদের কোনো দেশ থাকতে নেই। তাহলে তারা জীবনে বড় কাজ করতে পারে না। চলে এসো। তোমার মতো মেধাবী ছাত্র আমার টিমে আজীবন কাজ করবে এমনটাই চেয়েছিলাম। তোমার নাগরিকত্ব পাওয়ার প্রক্রিয়া আমি নিজে তদারক করব। মনে রেখো, খোদ আইনস্টাইনকেও দেশ ছাড়তে হয়েছিল।’

উত্তরে তিনি লিখেছিলেন, ‘এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে আমাদের মতো দেশগুলোয় বিজ্ঞানের নানা শাখায় গবেষণার জন্য একটি ভালো ল্যাবরেটরিও নেই। তবু এ দেশকে আমি ভালোবাসি। আমি এ দেশের জন্য অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে এখন নানা সমস্যা। চোরাকারবারি আর মজুতদারদের শক্ত হাতে দমন করা দরকার। যুদ্ধের পরাজিত শক্তিও বসে নেই। নানা অন্তর্ঘাতী কাজ করছে তারা। একজন পদার্থবিদ হিসেবে ব্যক্তিগত সাফল্যের চেয়েও আমার এখন বড় স্বপ্ন এ দেশের অসংখ্য নিম্নবিত্ত তবে মেধাবী ছাত্রদের পদার্থবিদ্যার প্রাথমিক জ্ঞানে অন্তত শিক্ষিত করে তোলা। এ ছাড়া আমার স্ত্রী, শিশুপুত্র, মাকেও সময় দিতে হয়। সব মিলিয়ে বেশ ব্যস্ত ও সুখী মানুষ আমি।...’

‘খালুজান! একটু আহেন, খালাম্মা কেমন জানি করতেছে!’

আদিলা বুয়া স্ত্রীর ঘর থেকে ডাকে। বস্তির এই নারী তার দ্বিতীয় স্বামীর হাতে লোহার খুন্তির ছ্যাঁকা খেয়ে চিরতরে ঘর ছেড়েছে। সে-ই এখন পঙ্গু রমার চব্বিশ ঘণ্টার তদারককারী। রমার ঘরে যেতে ইচ্ছে করে না। মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় প্রথম শ্রেণিতে সম্মান ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক হয়ে বিদেশে পিএইচডির জন্য পাড়ি জমানোর আগে কিছুদিন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পদার্থবিদ্যা পড়িয়েছেন তিনি। সেখানেই বাংলা সাহিত্যের সম্মান প্রথম বর্ষের ছাত্রী যে মেয়েটি নবীনবরণে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে, তাঁর উজ্জ্বল ত্বক আর ভরাট যৌবন যেন অধ্যাপক সুজেয় দু-হাত মেলে এখনো ছুঁতে পারবেন! এ কি সেই রমা? বছর আটেক আগে একবার বাথরুমে গিয়ে মেঝেতে অন্যমনস্ক অবস্থায় পিছলে পড়েন, কোমর ভেঙে তিন মাস শয্যাবন্দী। সেই অবস্থায়ই ধরল পারকিনসনস রোগ। বোঝার ওপর শাকের আঁটি হলো ব্রেইন স্ট্রোক। আজ যে নারীকে বিছানায় উঠে বসতে হলেও আদিলা বুয়ার সাহায্য লাগে, বিছানাতেই যাঁকে শৌচকাজ করতে হয়, যাঁর দুটি পা-ই শীর্ণ হয়ে বেঁকে গেছে পায়ের পাতাসহ, দুই হাতও অমন রুগ্‌ণ আর বেঁকে যাওয়া আর দু-চোখের একটি ছোট হয়ে আধ বোজা—তিনি যেন কুশ্রী ও কদর্যতার এক প্রতিরূপ! বিয়ের পরে ফুলশয্যার আসরের মেয়েটির সঙ্গে তাঁকে কিছুতেই মেলানো যায় না। লাল বেনারসি আর চন্দন তিলকে সাজানো সেই যুবতীই কি আজকের এই বৃদ্ধা, যাঁর প্রবল কুশ্রিতা আর জরা দেখলে খোদ গৌতম বুদ্ধ যেন তাঁর চিতাভষ্মের ভেতর থেকে আর্তনাদ করে বলবেন: এ জীবন অনিত্য, এই সংসার অনিত্য! হয়তো অনিন্দ্য রূপসী যুবতী একদিন এমন কদাকার বৃদ্ধা হয়ে যায় বলেই বুদ্ধ সব ছেড়ে ধ্যানে বসেছিলেন।

‘কী হয়েছে রমা?’

রমা কি আজ কোনো কারণে অশান্ত? তাঁর শীর্ণ হয়ে যাওয়া, পাকানো দড়ির মতো দুই হাত ধরেন সুজেয়। ঘোলাটে দুই চোখের মণি দিয়ে সুজেয়র মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন রমা। অনেকটা সময় এভাবে তাকিয়ে থেকে বুক থেকে শ্বাস বের করার মতো শব্দে বলেন, ‘লা-ড্ডু!’

‘লাড্ডুর কথা ভাবছ?’

স্ত্রী মাথা নাড়েন।

সামান্য কথাবার্তা আজও বলতে পারেন রমা। তবে বড় ছেলে মারা গেছে সেটা জানেন না। জানানো হলেও বুঝবেন কি? ছেলে তো মারা গেল—বলা ভালো, খুন হলো মাত্র দুই বছর। স্ত্রী যে প্যারালাইজড আজ নয় বছর। ২০১৫-এর ২৫ ফেব্রুয়ারির রাত সাড়ে আটটায় টিভির খবরেই এ দেশের আরও কোটি কোটি সাধারণ মানুষের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সুজেয় চৌধুরীও জেনেছিলেন, বইমেলা থেকে বের হওয়ার পথে টিএসসির সড়কদ্বীপ থেকে চারুকলা হয়ে শাহবাগের দিকে যাওয়ার হাঁটা রাস্তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনের রাস্তায় জনা কয়েক আততায়ীর হাতে গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন তরুণ কল্পবিজ্ঞান লেখক শুভ্রজিৎ চৌধুরী। ছোট ছেলে বিপ্রজিৎকে নিয়ে তখনই রওনা করেছিলেন হাসপাতালের দিকে। বাকিটা আজকের ডিজিটাল পৃথিবীতে সামাজিক যোগাযোগের কল্যাণে গোটা পৃথিবীই জানে। যখন রাস্তার ওপর খুন হয়ে যাওয়া মানুষের তাজা রক্ত ছলকে আসে আপনার পিসিতে, ল্যাপটপ বা মুঠোফোনের স্ক্রিনে; আপনি অনলাইনে সেই রক্তের বৈভব দেখতে দেখতে মৃদু উদ্বেগে কফি পান করে চলেন।

২.

‘লা-ড্ডু!’

রমার গলায় অস্পষ্ট বিলাপ ও গোঙানি। এই মুহূর্তে স্ত্রীর ধূসর চোখে যে অনুনয় ফুটে উঠছে, অদ্ভুতভাবে আজ থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের এক কাজলটানা তরুণীর চোখের অনুনয়ের সঙ্গে তার মিল পাওয়া গেল। আর সেই চাহনি এই শয্যাবন্দী, অচল বৃদ্ধার যাবতীয় কুশ্রিতা ভেদ করে প্রবীণ অধ্যাপকের স্নায়ুতে অনুরণন তুলল। অধ্যাপক সুজেয়র মনে হলো, তিনি যেন ফিরে গেছেন সেই চুয়াল্লিশ বছর আগে। ধর্মসাগর দিঘির পাড়ে লুকিয়ে হবু স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। তাঁকে দ্রুতই ছুটতে হবে দিনাজপুরে। বাবা-মায়ের সঙ্গে আলাপের পর রমার বাসায় আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠাবেন।

দিনাজপুরে যাওয়ার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থামতে হবে। সেখানে পদার্থবিদ্যা বিভাগে প্রভাষক পদে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা। যুবক সুজেয়র চাকরিপ্রাপ্তি একরকম নিশ্চিত। প্রথম শ্রেণিতে প্রথম বলে কথা। সিনিয়র অধ্যাপকদের প্রিয়পাত্র। সেদিন তাই রমার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলেই তিনি উঠে পড়েছিলেন। রমার চোখে ছিল অনুনয়—আর কিছুক্ষণ থেকে যেতে বলার অনুনয়।

‘লাড্ডু কই?’

স্ত্রী ধীরে ধীরে বলেন। চেতন-অবচেতনের পৃথিবীর সীমান্তে বাস করা রমা হয়তো এটুকুই জানেন যে লাড্ডু বিদেশে থাকে। মাঝে মাঝে সে দেশে আসে বাবা-মাকে দেখতে। লাড্ডুর মৃত্যুর সংবাদ তাঁকে কেউ জানায়নি। রমা অত কিছু আজ আর বুঝতে পারবেন বলে কেউ ভাবেওনি। এ ছাড়া যুক্তিবাদী লাড্ডু বা শুভ্রজিৎ চৌধুরী যেহেতু তার মরদেহ মর্গে দান করে গিয়েছিল শল্য চিকিৎসার কাজে, সেই দেহ বাড়িতে আনার বা শ্মশানে পাঠানোর আনুষ্ঠানিকতা তো করতে হয়নি।

‘আদিলা, তুমি একটু এসো তো!’

‘জি খালুজান!’

আদিলা বের হয়ে গেলে সুজেয় স্ত্রীর কাঁধ আঁকড়ে ধরেন। তাঁকে ধরে না রাখলে মুহূর্তেই টাল হারিয়ে পড়ে যাবেন বিছানায়। গোটা শরীরটাই দড়ির মতো শুকনো। অথচ এই নারীই তাঁর দুই সন্তানের গর্ভধারিণী হয়েছিলেন, হয়েছিলেন স্তন্যদায়িনী।

একাত্তরের পঁচিশে মার্চের সেই ভয়াল রাত আজও ভুলতে পারেন না তিনি। স্ত্রী তখন তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ভাগ্য ভালো যে জগন্নাথ হলের হাউস টিউটর ছিলেন না সুজেয়। তিনি ছিলেন ফুলার রোডের শিক্ষক কোয়ার্টারে। সেখানে মুসলিম শিক্ষকই সংখ্যায় বেশি। কাজেই গণহত্যা সংঘটিত হয়নি এখানে। মুক্তিযুদ্ধে জড়িত থাকার অভিযোগে আলাদা আলাদাভাবে কোনো কোনো শিক্ষককে হয়তো তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল যুদ্ধের নয় মাসে।

একাত্তরের মার্চের সেই ২৫ তারিখে সারা রাত মা আর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে বাথরুমের ভেতরে চিৎ হয়ে শুয়ে কাটিয়েছেন। পাশেই জগন্নাথ হলে তখন ঘটে চলেছে বীভৎস গণহত্যা। থেকে থেকে গুলির শব্দ, জোয়ান কণ্ঠের হাঁক। ২৬ তারিখ সকালবেলাটা এত স্তব্ধ, যেন একটা কাকও ডাকছে না। ক্যাম্পাসের কুকুরগুলো পর্যন্ত চুপ। সেই নিঃশব্দ ভোরে মিনিট দশেকের ক্ষিপ্রতায় ড্রয়িংরুমের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দুপাশের দুটি দরজা খুলে দিয়েছিলেন সুজেয়। মা ও স্ত্রীকে নিয়ে যথারীতি বাথরুমের ভেতরে দরজা আটকে ছিলেন ২৭ তারিখ অবধি। সৈন্যরা বোধ করি দু-তিনবার এসেছিল। তালা দেওয়া দরজায় কয়েকটি রাইফেলের বাঁটের গুঁতোর সঙ্গে ‘কোই হ্যায়?’ ডাক। তারপর বাতাসে বুটের খটখট শব্দ মিলিয়ে যাওয়া। বাথরুমে বসে থেকে তাঁরা তিনজন মানুষ—যাঁদের একজন গর্ভবতী—একটি শব্দও করেননি। রাত হলে পা টিপে টিপে বের হয়ে রান্নাঘরে ঢুকে চাল-আলু সেদ্ধ করে জাউয়ের মতো কিছু একটা খেয়ে আবার বাথরুমে ঢোকা। ভয়ে আলো জ্বালাতেন না। মোমবাতিতেই কাজ সারতে হতো।

২৭ তারিখ কারফিউ ওঠার পর বিধবা মা আর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে স্ত্রীর শাখা-সিঁদুর খুলিয়ে-মুছিয়ে সুজেয় বের হয়েছিলেন জিঞ্জিরার দিকে যাবেন বলে। জিঞ্জিরার পথ ধরে সবাই তখন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ ঢাকা ছাড়ছে। মা আর রমাকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে তিনতলা সিঁড়ি দিয়ে নামতেই সহকর্মী কলিমুল্লাহ এসে হাজির। তাঁর সঙ্গে একটি সাদা গাড়ি। শিক্ষকমহলে সবাই জানতেন তিনি জয়বাংলার সমর্থক। কলিমুল্লাহই বললেন, ‘দাদা, আপনাদেরই নিতে এসেছিলাম। বৌদির শরীরের এই অবস্থা! আপনি একা মানুষ ওনাদের নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?’ কলিমুল্লাহই তাঁদের নিয়ে তুলেছিলেন নিউ ইস্কাটনের নেভাল স্টক এক্সচেঞ্জের পেছনের কোয়ার্টারগুলোর একটায়। একাত্তরের সেই দিনগুলো যেন প্রথমে দেশের ভেতরে আর পরে দেশের বাইরে ভেসে ভেসে পালিয়ে বেড়ানোর দিন। দিন সাতেক কলিমুল্লাহর বাসায় থাকার পর অস্বস্তি লাগছিল সুজেয়র, যদিও কলিমুল্লাহ আর তাঁর স্ত্রী খুবই আন্তরিক। এ ছাড়া ফুলার রোডের তালা দিয়ে আসা কোয়ার্টার থেকে আরও টাকা-পয়সা আনা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকেও যাওয়া দরকার। সামনের দিনগুলো খুবই অনিশ্চিত। সবটা মিলিয়ে কেমন যেন এক ঘোর অন্ধকার টানেলের ভেতর দিয়ে হাঁটা। তবু পকেটে ফুলার রোডের কোয়ার্টারের চাবি নিয়ে ছুটলেন ক্যাম্পাসে। ঢাকা তখনো অনেক সবুজ আর ফাঁকা। রিকশায় দশ মিনিটে পৌঁছে গেলেন ফুলার রোডে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে, তালা খুলে বাসার কিছু জরুরি জিনিসপত্র নিয়ে নামার সময় দেখলেন এক চেনা ভদ্রলোক। অতুল দত্ত নামে এই ভদ্রলোকের পাটের ব্যবসা আছে। সুজেয়কে তিনি চিনতেন। ধানমন্ডি-৫-এর কাছে তাঁর পাট ক্রয়-বিক্রয়ের অফিসের পেছনে ফাঁকা একটি দুই কামরার বাড়িতে দিন সাতেক মা আর বউকে নিয়ে আত্মগোপন চলল। কিন্তু এই এলাকাও জনবহুল। যেকোনো দিন যে কেউ ধরা পড়তে পারেন। অতুল দত্ত অবশ্য দিন কয়েক বাদে নারায়ণগঞ্জের পথে একটি গাড়িতে তাঁদের তুলে দিলেন। মা আর রমা বোরকা পরে নিয়েছিলেন। গাড়ির ভেতরে দুই বোরকা পরা নারী দেখে পাকিস্তানি সৈন্যরা আর কিছু বলেনি। শীতলক্ষ্যা পার হয়ে কুমিল্লার দাউদকান্দির পাশে এক গ্রামে উঠলেন তাঁরা। সেখানে রমার মামা থাকতেন। লেদু মিঞা নামে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগের নেতা দাউদকান্দি থেকে সুজেয়কে মা, স্ত্রীসহ ভারতের সীমান্তে পালাতে সাহায্য করলেন। আজও মধ্য এপ্রিলের সেই বুক থমথম করা মাঝরাতটা মনে পড়ে। কখনো নৌকা পাল্টে, কখনো পায়ে হেঁটে আর শেষ দফা রিকশা নিয়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট সড়কে তাঁরা পৌঁছেছিলেন রাত তিনটা নাগাদ। ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দিয়ে হু হু প্রসারিত সিএনডি সড়কের দুপাশে ঝোপে লুকিয়ে থেকেছেন। স্থানীয় রিকশাওয়ালা জানত কত সময় পর পর টহল দিতে আসে আর্মি। তারা টহল দিয়ে চলে যাওয়ার পরই রিকশাওয়ালা তাঁদের নিয়ে প্রবল বেগে ছুট। আর সেই রাতের ডিম ভেঙে যখন সকাল ফুটছে, তখন প্রত্যাশিত সোনামুরা সীমান্ত চোখের সামনে। সেখানেই ভাগ্যক্রমে মিলে গেল রমার এক দূর সম্পর্কের বোনের বাড়ি। এবার এখান থেকে যেতে হবে আসামের ডিগবয়ে, যেখানে বড় ভাই ইন্ডিয়ান ন্যাচারাল ওয়েল অ্যান্ড গ্যাস করপোরেশনের বড় কর্মকর্তা।

সুজেয়র বড় ও ছোট দুই ভাইই ভারতে চলে গিয়েছিলেন দেশভাগের পরপর। সেই কবে আড়াই শ বছর আগে রাজপুতানার এক ক্ষত্রিয় পরিবার উত্তর বাংলায় এসে আত্রাই নদীর তীরে আস্তানা গেঁড়েছিল। কালক্রমে স্থানীয় কোচ বা রাজবংশী নারীদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে রাজপুত পরিবারের শিশুদের চোখেমুখেও দেখা দেয় মঙ্গোলিয় ছাঁদ, অধিকাংশের গায়ের রং ফরসা হলেও কোনো কোনো শিশু রাজপুতদের তুলনায় খর্বাকৃতির হয়ে জন্ম নেয়। দেশভাগের পর সুজেয়র দুই ভাইই পুনরায় পাড়ি জমান ভারতে—ছড়িয়ে পড়েন গুজরাট ও আসামে। বড় দাদা আবার রাশিয়ায় পড়তে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন এক রুশ নারীকে। একা সুজেয় এ দেশের মায়া ত্যাগ করতে পারেননি। আসামের পাকদণ্ডির রাস্তা বেয়ে চললেন তাঁরা ডিগবয় অবধি।

৩.

‘স্কু-ল! স্কু-ল! লাড্ডু স্কুলে যাবে না?’

বেশ পরিষ্কারভাবেই বললেন রমা। অপলক দৃষ্টি মেলে সুজয়ের দিকে তাকিয়ে। শীর্ণ এই বৃদ্ধার দুই ঠোঁটই ধীরে ধীরে নড়ছে পুত্রের নামোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে। মমতাভরে স্ত্রীর কাঁধ এক হাতে ধরে তাঁর তলপেটে মাথাটি নুইয়ে দেন সুজয়। শীর্ণ, পাকানো দড়ির মতো তলপেট। ওপরে একটি ম্যাক্সি। আজ এই দেহ নারীর না পুরুষের—হঠাৎ দেখলে বোঝা দুঃসাধ্য। আসামের ডিগবয়ে বড় দাদার বাসায় মা আর স্ত্রীকে রেখে তিনি ছুটে এসেছিলেন সোনামুরা সীমান্তে। তিন সপ্তাহের ট্রেনিংয়ে শিখেছিলেন থ্রি নট থ্রি আর এলএমজি চালনা। গ্রেনেড আর ডিনামাইট ছুড়তে পারতেন। ডিগবয় থেকে সোনামুরা সীমান্তে আসার আগের দিন স্ত্রীর ভারী গর্ভে কান পেতে অনাগত, প্রথম সন্তানের হাত-পা ছোড়ার শব্দ শোনেননি কি তিনি? রমা কেঁদেছিলেন, যুদ্ধে যেতে মানা করেছিলেন। তবু তিনি একজন যুবক পদার্থবিদ, প্রথমবারের মতো স্ত্রী আর পদার্থবিদ্যা বইয়ের পাতা ফেলে ছুটে গিয়েছিলেন রণাঙ্গনে। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সামনাসামনি যুদ্ধে দলের অন্য সবার মতো তিনিও এপাশ থেকে বিপক্ষের দিকে গুলি ছুড়েছেন। লাশ পড়েছে প্রতিপক্ষের।

কিন্তু সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখে এক যুবক ডিগবয়ে বড় দাদার কোয়ার্টার থেকে তাঁকে খুঁজতে এল গেরিলা সৈনিকদের আস্তানায়। বড় দাদার অফিসেরই এক অধস্তন বাঙালি কর্মচারী। তার হাতে ছিল বড় দাদার লেখা একটা চিঠি, ‘আর কত দিন ক্যাম্পে থাকবি? বউমা গত রাতে একটি পুত্রসন্তান জন্ম দিয়েছে। কিন্তু শরীরটা ভালো না। খুব রক্তক্ষরণ হচ্ছে। নাজিরাবাদ মাতৃসদন থেকে ডিগবয় সেন্ট্রাল হাসপাতালে ট্রান্সফার করতে হবে ওকে। মা আর তাতিয়ানা রমার পাশে সারা রাতে জেগে ছিল। এই চিঠি পাওয়ামাত্র চলে আসবি।’

চিঠি পেয়ে হাতের থ্রি নট থ্রি ফেলে ফের ছুটেছিলেন ডিগবয়ে। সেই উদ্দাম যৌবনের যুদ্ধ ও ভালোবাসার দিনগুলোর প্রথম সন্তান আজ আর বেঁচে নেই। লাড্ডু বা শুভ্রজিৎ তার বৃদ্ধ বাবা-মাকে ফাঁকি দিয়ে কোথায় পালিয়েছে, কোথায় লুকোচুরি খেলছে কে জানে? ছোটবেলায় যেমন বাবা-মাকে ভয় দেখাতে টেবিল বা জানালার কোনায় লুকাত, ধরা পড়ার পর হাসত খলখল।

‘লা-ড্ডু!’

রমার বিলাপের সঙ্গে সঙ্গে অধ্যাপক সুজেয় চৌধুরী স্ত্রীর শীর্ণ উদরে কান পেতেই থাকেন, যতক্ষণ না গর্ভস্থ শিশুটির মাতৃজঠরের ভেতরে সশব্দ পদাঘাতের শব্দ তাঁর কানে আসে।