বইচোর

বুক থিফ নামে একটা উপন্যাস বছর কয়েক আগে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। এই রচনা সেই বই নিয়ে নয়; যদিও বইটির ব্যাপারে কিছু আলোকপাত করা যেতেই পারে। তবে এখানে মূলত যা নিয়ে গালগল্প ফাঁদার পাঁয়তারা করছি তা আক্ষরিক অর্থে চুরি—বই চুরি।

 আমরা যখন নিতান্তই ছোট, স্কুলের নিচু ক্লাসে পড়ি, তখন থেকেই বই চুরির ব্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলাম বললে ভুল হবে না। স্পষ্ট মনে আছে, নতুন পাঠ্যবই হাতে আসার পর মালিকানাস্বত্ব জাহির করতে যত দূর সম্ভব গোটা গোটা অক্ষরে নিজের নাম বইয়ের পাতায় একাধিকবার উৎকীর্ণ করেই ক্ষান্ত হতাম না, বইয়ের শেষে, সম্ভবত শেষ পৃষ্ঠায় চোরের হাত থেকে বইটাকে নিরাপদ (?) রাখার অদম্য প্রেরণায় সম্ভাব্য চোরের জন্য আগেভাগেই ভয়ংকর সব অভিশাপ বরাদ্দ করে রাখতাম। যেমন, এই বই যে করিবে চুরি/খাইবে গদার বাড়ি/অকালে মরিবে রক্ত মুখে তুলি ইত্যাদি ইত্যাদি। অভিশাপগুলো অবধারিতভাবে কাব্যে রচিত হতো, কখনো কখনো পৃষ্ঠাজুড়ে, আর তাই কঠিন কঠিন বাক্যবাণের সঙ্গে অশ্লীল উপমা-উৎপ্রেক্ষায় কাব্য-প্রতিভা রঞ্জিত করার সে এক সুসময়ও ছিল।

তার মানে টাকা-কড়ি, আসবাবপত্রের মতো কাগজের বইও যে চুরি হওয়ার যোগ্যতা রাখে তা শিশু বয়স থেকেই জেনে আসছি। আর বড় বয়সে পৌঁছে জানলাম, কে না বই চোর! চেনা-জানা লোকজনের কাছ থেকে বই ধার করে ভুলে যাওয়া, মানে মেরে দেওয়া যেমন এক অর্থে চুরি, লাইব্রেরি থেকে বই এনে ফেরত না দেওয়াও তাই, আর সোজাসুজি চুরির মতলবে গ্রন্থাগার বা বইয়ের দোকানের তাক থেকে বই সরানোর কথা না-ইবা বললাম। তবে এসবে নানা রকমফের আছে।

 চুরির বই এনে বিক্রি করে দেওয়া অবশ্যই নিকৃষ্ট ধাপের চুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়ি, তখন দু-তিনজন কুখ্যাত বই চোরকে জানতাম, যারা তখনকার বইয়ের ভান্ডার ফুলার রোডের ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিকে প্রায় ফতুর করে ছেড়েছিল। শুধু যে মূল্যবান পাঠ্যবই বা গল্প-উপন্যাসে তাদের হাত পড়েছিল তা না, সে সময়ের ব্রিটিশ কাউন্সিলের অত্যন্ত সমৃদ্ধ রেফারেন্স সেকশনের বিরল ও গুরুত্বপূর্ণ বইও এদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। বলা প্রয়োজন, এরা প্রত্যেকেই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো না কোনো বিভাগের ছাত্র। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, নতুন সদস্যদের জন্য একজন গণ্যমান্য গ্যারান্টারের নিয়ম চালু করতে বাধ্য হয়েছিল কর্তৃপক্ষ। আরও কৌতূহলকর ব্যাপার, ব্রিটিশ কাউন্সিলের পেছনে যেখানে অডিটরিয়াম, তার কাছাকাছি খানিকটা আড়ালে একটা চারকোনা বড়সড়ো কাঠের বাক্স রাখা হয়েছিল, যার গায়ে লেখা ছিল, অ্যামনেস্টি বক্স। অর্থাৎ চুরির মাল ফেরত দিয়ে দাও, মাফ পেয়ে যাবে। হাস্যকর ব্যাপার, ফেরত দিতে এসে বমাল ধরা পড়বে, চোরেরা এত বেকুব নয়। সেই চোরেরা ছিল নিকৃষ্ট শ্রেণির, তারা বই বেচে দিত নীলক্ষেতে। তবে বিক্রির আগে কিছু পরিশ্রম তাদের করতে হতো। কেমিক্যাল ঘষে বইয়ের নানা জায়গা থেকে ডিম্বাকৃতি মোহরের গাঢ় ছাপগুলো তুলে ফেলতে বা বিকৃত করতে তাদের নিশ্চয় খানিকটা বেগ পেতে হতো।

পৃথিবীর বিখ্যাত-কুখ্যাত বই চোরদের কাণ্ডকীর্তির কাহিনি ভূরি ভূরি। স্টেফান ব্লুমবার্গ নামে একজন মার্কিনির কথা জানা যায়, যে তিরিশ বছরে সাড়ে তেইশ হাজারের ওপর বই চুরি করেছিল, কিন্তু বিক্রিতে তার মন ছিল না। বইগুলোর মূল্য ধরা হয়েছিল পাঁচ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। সে বই পড়ত ও জমাত। বিভিন্ন গ্রন্থাগার থেকে বছরের পর বছর এত বিপুলসংখ্যক বই নিজের সংগ্রহে আনার পেছনে তার যুক্তি ছিল, বইগুলোকে সে ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করেছে। তাঁর মূল্যবান চুরির তালিকায় অনেক বিখ্যাত বই, যেমন আংকেল টমস কেবিন-এর প্রথম সংস্করণ পাওয়া গিয়েছিল। তাকে কুখ্যাত বলা সম্ভবত সমীচীন হবে না।

প্রকৃত কুখ্যাতদের মধ্যে এমন বই চোরদের সন্ধান পাওয়া যায় যারা মাফিয়া কায়দায় সিন্ডিকেট গড়ে তুলতেও পারঙ্গম। তাদের চুরির বই দুষ্প্রাপ্য তো বটেই, এন্টিকতূল্যও। পৃথিবীর বিখ্যাত নিলামকারী সংস্থা—যেমন বিলেতের ক্রিস্টিজ তাদের বই নিলামে তুলেছে এবং অকল্পনীয় দামে সংগ্রাহকেরা সেসব কিনেও নিয়ে গেছেন। তেমনি একজন উইলিয়াম জেকস। ব্রিটিশ এই বই চোরের আবার একটা ছদ্মনামও (ট্রেডনেম) রয়েছে—টম রেইডার। ব্রিটেনের সব নামী গ্রন্থাগার থেকেই সে বই হাতিয়েছে। ২০০৭ ও ২০১২-তে দুবার জেলখাটা জেকসের চুরি করা বইয়ের মূল্য ধরা হয়েছিল ১৫০ মিলিয়ন পাউন্ড।

এ তো গেল খাঁটি চোরদের কথা। ধার করে বই ফেরত না দেওয়া সম্ভবত গোটা পৃথিবীতেই কমবেশি চালু। এই ভদ্রবেশীদের শ্রেণিতে কারা পড়েন না তা গবেষণার বিষয় হতে পারে। ধার দিয়ে বই ফেরত না পাওয়ার অভিজ্ঞতা যেমন গড়পড়তা বইপ্রেমী প্রায় সবারই রয়েছে, তেমনি ধার করে ফেরত না দিয়ে নিজেদের সংগ্রহ সমৃদ্ধ করার আত্মপ্রসাদ (?) থেকে সম্ভবত খুব কম মানুষই বঞ্চিত। তার মানে কাজটা দুই তরফা। যিনি বা যাঁরা অন্যকে বই ধার দিয়ে ফেরত পাওয়ার আশায় জলাঞ্জলি দেন, তাঁরা নিজেরাও অন্যের বই ফেরত দেওয়াকে কাজের কাজ মনে করেন না।

কথা উঠতে পারে, আমরা অন্যের কাছ থেকে টাকা ধার করে বা প্রয়োজনের কোনো জিনিস নিয়ে ঠিকই ফেরত দিই (যদি না বদমতলব থাকে), কিন্তু বই ফেরত দিতে সমস্যাটা কোথায়? মনোবিশ্লেষকেরা হয়তো এ নিয়ে ভেবেছেন এবং একটি তাত্ত্বিক সূত্রও সম্ভবত বের করে বসে আছেন। সেদিকে যাচ্ছি না। কুয়ারা ডাইজেস্ট নামে একটি প্রশ্ন-উত্তরবিষয়ক ওয়েবসাইট পাঠকদের কাছে এ প্রশ্নটা রেখেছিল। অধিকাংশ পাঠক—যাঁদের মধ্যে ধারদাতা ও ধারকারী—দুই গোত্রেরই মানুষজন ছিলেন—জবাবে যা বলেছেন তা বেশ সাদামাটা। কারও মতে এর কারণ আলসেমি—দেব, দিচ্ছি করে বইটার কথা ভুলে যাওয়া বা হারিয়ে ফেলা। কারও মতে, বইটা পড়ে না ওঠা,Ñযা হয়তো কোনো দিনই হয়ে উঠবে না। একজন বলেছেন, বইটা যদি দুর্দান্ত রকমের কিছু হয়, আমার ঘুম কেড়ে নেওয়ার শক্তি রাখে, এমনকি আমার আত্মার সঙ্গে একাকার হয়ে আত্মাকেও কেড়ে নেয়, তাহলে বইটা ফেরত দিতে যাওয়া মানে খোদ আমার আত্মাকেই বিলিয়ে দেওয়া।

যুক্তি যার যেমনই হোক, এ কথা সম্ভবত ঠিক, বই মেরে দেওয়ার গূঢ় বাসনা নিয়ে সাধারণত কেউ বই ধার করেন না। অন্তত নিজের অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। তারপরও অন্যের কিছু বই তো দেখতে পাই দিব্যি শেলফে জায়গাজুড়ে আছে। আর ধারদাতা হিসেবে আমি যাদেরই বই দিয়েছি—অনেক সময় নিজের পাঠ-উত্তেজনা ভাগাভাগি করতে—সেসব কদাচিৎ ফেরত এসেছে, তা-ও তাগাদার পর তাগাদায়। নিজেকে সমঝদার পাঠক বলে জাহির করতে অল্প বয়সে বয়োজ্যেষ্ঠ ও জ্ঞানী-গুণীজনদের যেচে প্রিয় বই পড়তে দেওয়ায় একধরনের আত্মগরিমা নিশ্চয় কাজ করত। পরে যা হওয়ার তা-ই হতো। ফেরত চাইতে না পারার যন্ত্রণা-কষ্ট নীরবে হজম করাই সার হতো। একটা প্রাচীন সংস্কৃত প্রবচন এ রকম: বই, বউ, অর্থ কাউকে দিয়ে ফেরত পাওয়া দুরাশা; কদাচিৎ যদি পাওয়া যায়, আদি অবস্থায় কখনোই নয়।

বুক থিফ নামের বইটির কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। সে প্রসঙ্গে আসি। অসামান্য এই উপন্যাসটির লেখক মারকুস্ জুসাক। জার্মান বাবা-মায়ের সন্তান জুসাক বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। ২০০৫ সালে প্রকাশের পরপরই তাঁর এ বইটি বিশ্বব্যাপী বিপুলসংখ্যক পাঠকের পছন্দের তালিকায় চলে আসে। বলা উচিত, আজও তা-ই আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন জার্মানিতে নাৎসি নিপীড়নের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে লিসেল নামের এক কিশোরীর উদ্বেগতাড়িত জীবন ও তার ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে সে যখন চরম বিপর্যস্ত তখন তার সামনে একটা সুযোগ আসে লেখাপড়া করার, তবে গোপনে। ধীরে ধীরে মেয়েটি যতই বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে, সে একজন ‘বই চোর’-এ পরিণত হয়। তবে তার বই চুরির উদ্দেশ্য নাৎসি সৈন্যরা হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে এমন বই চুরি করে লুকিয়ে রাখা, যাতে সেগুলো তারা ধ্বংস করতে না পারে। লিসেলের মতো বই চোরেরাই পারে সভ্যতাকে দীর্ঘজীবী করতে।