চিরস্মরণীয় ভাষণ, অবিস্মরণীয় কবিতা

বঙ্গবন্ধুর জীবনের একটাই ছিল লক্ষ্য, একটাই ছিল স্বপ্ন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বাংলার মানুষের মুক্তি। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু কারাগারে নীত হয়েছেন, মুসলিম লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন, বারবার জেলে গেছেন, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন, কিন্তু তিনি তাঁর লক্ষ্য থেকে চ্যুত হননি কখনো। গত শতকের পঞ্চাশের দশকেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। ষাটের দশকে পূর্ব বাংলার স্বাধিকারের জন্য ছয় দফা উত্থাপন করেছেন, সারা বাংলাদেশ চষে বেড়িয়েছেন, সমস্ত বাংলাদেশকে একটামাত্র স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করেছেন, একদেহ একপ্রাণ হয়ে উঠেছিল দেশ, আর ‘একটি মজিবরের থেকে লক্ষ মজিবরের’ কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল একটামাত্র ধ্বনি—বাংলাদেশ।

১৯৭১ সালের মার্চে বাংলাদেশ কার্যত স্বাধীন। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়েছে, জাতীয় সংগীত নির্বাচিত হয়েছে, আর দেশ চলছে আওয়ামী লীগের নির্দেশে।

এই অবস্থায় মার্চের শুরুতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন এক তরফাভাবে স্থগিত করলেন। বাংলাদেশ জ্বলে উঠল, বিস্ফোরিত হলো যেন-বা।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। কেমন ছিল সেদিন ঢাকার হৃদয়মাঠখানি?

কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’তে তা সবচেয়ে সুন্দরভাবে বিবৃত করা আছে।

সেই ভাষণ শোনার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, ‘মনে হয়, অব্যাখ্যাত অলৌকিক শক্তির ওপর বঙ্গবন্ধু কিছুটা আস্থাশীল ছিলেন। তাঁর ৭ মার্চের ভাষণটি শুনেও আমার সে কথাই মনে হয়েছিল। মনে হচ্ছিল ভেতর থেকে যেন কেউ শব্দের পর শব্দ, বাক্যের পর বাক্য, বেস্ট ওয়ার্ড ইন বেস্ট অর্ডারে তাঁর কণ্ঠে যুগিয়ে দিচ্ছিল। আর জলপ্রপাতের মতো তাঁর কণ্ঠ থেকে নেমে আসছিল অনর্গল শব্দঝরনা। ১০৩ পঙ্‌ক্তির কাব্যগুণান্বিত ওই ভাষণের রচয়িতাকে যদি আমরা কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করি, তাহলে তা খুবই অন্যায় হবে। তাঁর ওই ভাষণ নিয়ে লেখা আমার বহুশ্রুত “স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো” নামক কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে আমি কবি হিসেবেই বর্ণনা করেছি। জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে অধীর আগ্রহে ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা সেদিন ভোর থেকে যাঁর অপেক্ষায় বসেছিল, তিনি কবি। কখন আসবে কবি?’ (আত্মকথা ১৯৭১, বাংলাপ্রকাশ)

নির্মলেন্দু গুণ তাঁর ওই বইয়ে নিউজউইক-এর ৫ এপ্রিল ১৯৭১ প্রচ্ছদকাহিনিটিও উদ্ধৃত করে রেখেছেন, যাতে বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিকস’ বা রাজনীতির কবি হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে।

তো, সেই কবি কবিতা শোনাতে আসবেন। লাখ লাখ ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা অপেক্ষা করছে। কবিতার প্রথম লাইনটা অবশ্য মিলে যায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘একটি কবিতার জন্যে’ কবিতার প্রথম লাইনের সঙ্গে।

‘একটি কবিতা লেখা হবে। তার জন্যে

আগুনের নীল শিখার মতন আকাশ

রাগে রী-রী করে...’

 (সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা, দে’জ পাবলিশিং, পৃষ্ঠা ৩৯)।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ওই কবিতার কথা আমাদের আর মনে থাকে না, যদি আসে তা নির্মলেন্দু গুণের এই কবিতাটির জন্য। বস্তুত, আমি সচেতনভাবে লিখছি, নির্মলেন্দু গুণের এই কবিতাটি বাংলা ভাষার একটা শ্রেষ্ঠ কবিতা।

কবিতাটা প্রধানত নির্ভুল অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা। শ্রোতারা বসে আছে, কখন আসবে কবি?

‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে

রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে

অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।’

মাত্র একটা পঙ্‌ক্তিতে নির্মলেন্দু গুণ আমাদের হাজার বছরের ইতিহাসকে ধারণ করলেন। আমাদের ভাষা হাজার বছরের। আমাদের চর্যাপদের কবি কাহ্নপা লিখেছিলেন বন্ধন ছিন্ন করার কথা—

‘এবংকার দৃঢ় বাখোড় মোড়িঅ।

বিবিহ বিআপক বান্ধন তোড়িঅ।’

‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে’র কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় মারাই গেছেন ১৮৮৭ সালে। বাংলা চিরকালই ছিল স্বাধীনচেতা। বারবার তা বিদেশি শক্তির পদাবনত হয়েছে, আবার বারবার বিদ্রোহ করেছে। নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর নির্বাচিত প্রবন্ধ বইয়ে পাই, ‘১২০৬ খৃস্টাব্দে ভারতবর্ষে স্বাধীন মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহার মধ্যে বাঙালি স্বাধীন বা কার্যত স্বতন্ত্র ছিল ৪২৬ বছর।’

অর্থাৎ বাঙালি শত শত বছর ধরে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছে। তার সংগ্রাম শত বছরের শত সংগ্রাম।

শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে কবি যখন এসে গেলেন, তখন অক্ষরবৃত্ত হয়ে গেল মাত্রাবৃত্ত—

‘তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল

হৃদয়ে লাগিল দোলা।’

আর শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি—

‘“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’

আর এই কবিতাটি লিখিত হওয়ার পর থেকে কবিহীন বিমুখ প্রান্তরে উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান, বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল কিংবা মার্চের বিরুদ্ধে মার্চকে মার্চ করানোর সব ষড়যন্ত্র, অপপ্রয়াস ব্যর্থ হতে লাগল।

যতই দিন যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু ততই উজ্জ্বল হচ্ছেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে তাঁকে ভালোবাসা জানাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ এবং তাঁর এই ভাষণটি এখন ইউনেসকোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ডের তালিকাভুক্ত।

বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ চিরস্মরণীয়।

নির্মলেন্দু গুণের এই কবিতাটিও অবিস্মরণীয়তার তালিকায় উঠে এসেছে, কোনো সন্দেহ নেই।

‘মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না’ বঙ্গবন্ধুর সেই বরাভয় যেমন আমাদের সাহসী করে তোলে, তেমনি এই কবিতাটি মাথা নত না করার স্পৃহায় উজ্জীবিত করে নতুন করে।

স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো

নির্মলেন্দু গুণ

একটি কবিতা লেখা হবে, তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে

লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে

ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: ‘কখন আসবে কবি?’

এই শিশুপার্ক সেদিন ছিল না,

এই বৃক্ষে ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না,

এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না।

তা হলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি?

তা হলে কেমন ছিল শিশুপার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে,

ফুলের বাগানে ঢেকে দেয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি?

জানি, সেদিনের সব স্মৃতি মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত

কালো হাত। তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ

কবির বিরুদ্ধে কবি,

মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ,

বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল,

উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান,

মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ...।

হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি,

শিশুপার্কের রঙিন দোলনায় দোল খেতে খেতে তুমি

একদিন সব জানতে পারবে; আমি তোমাদের কথা ভেবে

লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প।

সেদিন এই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর।

না পার্ক না ফুলের বাগান,—এসবের কিছুই ছিল না,

শুধু একখণ্ড অখণ্ড আকাশ যেরকম, সেরকম দিগন্তপ্লাবিত

ধু-ধু মাঠ ছিল দূর্বাদলে ঢাকা, সবুজের সবুজময়।

আমাদের স্বাধীনতাপ্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশেছিল

এই ধু-ধু মাঠের সবুজে।

কপালে, কব্জিতে লালসালু বেঁধে

এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক,

লাঙল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক;

পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক।

হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত,

নিম্ন মধ্যবিত্ত, করুণ কেরানি, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা, ভবঘুরে

আর তোমাদের মতো শিশু পাতা-কুড়ানিরা দল বেঁধে।

একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্য কী ব্যাকুল

প্রতীক্ষা মানুষের: ‘কখন আসবে কবি?’

                        ‘কখন আসবে কবি?’

শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,

রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে

অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।

তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিলো জল,

হৃদয়ে লাগিল দোলা,

জনসমুদ্রে জাগিলো জোয়ার সকল দুয়ার খোলা।

কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?

গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর

অমর কবিতাখানি:

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,

            এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।

প্রকাশ: চাষাভূষার কাব্য