নিপীড়ন ও প্রতিরোধের গল্প

এই ছিপছিপে মিতব্যয়ী ছড়া বা ছড়া-কবিতা বা কবিতাটিতে একটা গল্প আছে। গল্পটি নানা দিক থেকে বিশ্বজনীন। এটি নিপীড়ন আর প্রতিরোধের অনিঃশেষ প্রবাহ। পৃথিবীর দেশে দেশে, বিশেষত আমাদের মতো তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলোতে, এ কাঠামো আমরা হরহামেশাই মঞ্চস্থ হতে দেখি। নিপীড়কের রুদ্রমূর্তি মানুষের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। আত্মরক্ষার জৈবিক তাড়না তাকে নিস্পৃহ করে তোলে। কিন্তু প্রতিরোধের নানা কলাও এগোতে থাকে পাশাপাশি। সে-ও হয়তো আত্মরক্ষার তাগিদেই। অন্ধ হলেই তো আর প্রলয় বন্ধ থাকে না! তখন এগোতে হয় সামনের দিকে। মনে পড়ে যায় পুরোনো কোনো প্রতিরোধের গল্প। উজ্জীবিত মানুষ সকল নিশ্চেষ্ট মৃত্যুর চেয়ে প্রতিরোধসংগ্রামেই জীবনের গল্প বোনে।

উনসত্তরের বাংলাদেশে এ ছক অচেনা ছিল না। বিশ্বজনীন গল্পটি তখন বিশেষভাবে মূর্ত হয়েছিল এ দেশে। কবিতাটির উচ্চারণ সাক্ষ্য দেয়, প্রতিরোধযুদ্ধ তখন বেশ কতকটা এগিয়ে গেছে। আসাদ বেরিয়েছে মিছিল নিয়ে। আশা করা যায়, কোনো সুসংবাদ নিয়েই ওই মিছিল ফিরবে। আরও আছে জীবন বাজি রাখা সৈনিক মতিউর। মতিউর আছে এবং নাই। জীবন দিয়ে নিজের এক জীবনকে লাখো জীবন বানিয়ে মতিউর লড়াইয়ের নিশানা আর কর্মপদ্ধতি বাতলে গেছে। এই দুই চরিত্র একটি সর্বজনীন গল্পকে বিশেষভাবে বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসের বিশেষ মুহূর্তের সঙ্গে। অবশ্য কবিতার নামের মধ্যে যদি ওই সালটি দাগানো না থাকত, যদি দুটি ঐতিহাসিক চরিত্র এই প্রতিরোধ-লড়াইয়ের নিশানা বিশেষভাবে চিহ্নিত না-ও করে দিত, তবু হয়তো আমরা তাকে চিনতে ভুল করতাম না। কবিতার প্রতিটি শব্দ ওই বিশেষ আবহে সম্পূর্ণত লিপ্ত থেকে আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে, এ আমাদের নিজেদের গল্পই বটে। কয়েকটি শব্দ প্রতীকী সূক্ষ্মতায় ওই আবহকে অনিবার্য করে তুলেছে।

প্রথমেই বলতে হয় ট্রাকের কথা। না বলে উপায়ও নেই। চুয়াল্লিশ শব্দের কবিতায় শব্দটি আছে আটবার। এমনিতেই ট্রাক খুব নিরীহ ব্যাপার নয়। কখনো কখনো তার ভূমিকা জরুরি হলেও জনমানসে এ যানটি ভীতিরই অন্য নাম। কবি অবশ্য কোনো ধোঁয়াশা রাখতে চাননি। বিশেষণ হিসেবে ‘শুয়োরমুখো’ শব্দটি ব্যবহার করে নিমেষেই অর্থের একটা প্রসারিত অথচ নির্দিষ্ট সীমানা টেনে দিয়েছেন। বাংলাদেশের ভাষাকাঠামোয় গালিবাচক ‘শুয়োর’ শব্দের যে অবারিত ব্যবহার, তার পুঁজি খাটিয়েই কাজটি করা হয়েছে। ‘মুখ’ শব্দের আমদানিও হয়েছে মোক্ষম। তাতে করে আগুন দেওয়ার জন্য জুতসই জায়গা পেতে সমস্যা হয়নি। এভাবে ‘ট্রাক’ শব্দটির অর্থ-বিস্তৃতি ঘটে; নিপীড়ক শক্তিমান পক্ষটি একটি শব্দের কারসাজিতেই চমৎকার চিহ্নিত হয়ে যায়।

‘দুয়োর’ শব্দটিও ব্যবহারগুণে গভীর দ্যোতনা পেয়েছে এ কবিতায়। একদিকে ‘শুয়োর’ শব্দের সঙ্গে জুটি বেঁধে এটি তৈরি করেছে দারুণ ধ্বনিব্যঞ্জনা, অন্যদিকে দুয়োর বাঁধা আর দুয়োরে খিল আঁটতে অস্বীকৃতি জানানো—এ দুই বিপরীত ক্রিয়া শব্দটিকে তার বস্তুপরিধি অতিক্রম করে পৌঁছে দিয়েছে সামষ্টিক মনোজগৎ পর্যন্ত। যে পরিস্থিতি গণমানসে অস্থিরতা তৈরি করে, নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ার মন্ত্রণা দেয়, আবার বহির্মুখী প্রণোদনায় বাইরে টেনে আনে, সে পরিস্থিতিরই দ্বিধান্বিত আশ্রয় হয়ে উঠেছে শব্দটি। বাইরে শুধু ঘাতক ট্রাক নয়, আছে মিছিলও। তাই বন্ধ দুয়ার খুলবেই। মতিউরকে নিশানা মেনে জনতা আগুন জ্বালবেই। ‘আগুন’ এ কবিতার অপর গুরুত্বপূর্ণ চিহ্নায়ক। নিপীড়নের বিপরীতে নিপীড়িতের অস্ত্র। যে আগুন জ্বালাবে ট্রাকের মুখ, সে আগুন জাগাবে মানুষের মনও। তবেই না মতিউরের উত্তরসূরি জন্মাবে ঘরে ঘরে। আগুনে বিধ্বস্ত হবে নিপীড়কের অস্তিত্ব।

কবিতাটির ছোট্ট শরীর এভাবে হয়ে উঠেছে গণ-আন্দোলনের বিশদ খসড়া। সরল কিন্তু সবল উচ্চারণের যে অনায়াস পারঙ্গমতা আল মাহমুদের কবিখ্যাতির মূল, এ কবিতার তনুদেহে তার কমতি নেই। স্তবকসজ্জার সম্ভাব্য নিপুণতম ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। চৌদ্দ পঙ্‌ক্তির কবিতাটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রতিটি ভাগে দুটো করে স্তবক। প্রতি ভাগের তিন পঙ্‌ক্তির প্রথম স্তবকটি প্রস্তাবনার মতো। আর চার পঙ্‌ক্তির দ্বিতীয় স্তবক দুটি হাজির করেছে সিদ্ধান্ত। প্রস্তাবনা-স্তবক দুটির প্রথম পঙ্‌ক্তিতে ‘ট্রাক’ শব্দটি তিনবার আলাদাভাবে উচ্চারিত হওয়ায় দুটি ঘটনা ঘটেছে। একদিকে এ উচ্চারণ খানিকটা বাড়তি সময় নিয়ে দুই পঙ্‌ক্তির দৈর্ঘ্য পেয়েছে, অন্যদিকে স্তবকটিকে প্রতিপক্ষ ট্রাকের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ কারণেই প্রস্তাবনা-স্তবক দুটি আন্দোলন-সংগ্রামের দিক থেকে নেতিধর্মী। অন্যদিকে সিদ্ধান্ত-স্তবক দুটি আগের স্তবকের উপকরণ ব্যবহার করেই ঘোষণা করেছে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। এই যে বিবরণীর অন্তর্নিহিত ডায়ালেক্টিকস, তা কেবল আন্দোলনের বাস্তবকেই উপস্থাপন করেনি, সাংগীতিক দ্যোতনারও জোগান দিয়েছে।

এ কবিতার কথকটিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দশের এক হয়েও সে আলাদা। ঘটনা বিবৃত করাই তার কাজ। কিন্তু সে মূল্যায়নও করে। জনমানসের দ্বিধাদ্বন্দ্বে তার অমত নেই। কিন্তু সে সম্ভাবনার কথাও বলে, উৎসাহ জোগায়। এ কাজ সম্ভবত কবিরই কাজ।

উনসত্তুরের ছড়া-১

আল মাহমুদ

ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!

শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে

দুয়োর বেঁধে রাখ।

কেন বাঁধব দোর জানালা

তুলব কেন খিল?

আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে

ফিরবে সে মিছিল।

 

ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!

ট্রাকের মুখে আগুন দিতে

মতিউরকে ডাক।

কোথায় পাবো মতিউরকে

ঘুমিয়ে আছে সে!

তোরাই তবে সোনামানিক

আগুন জ্বেলে দে।

 প্রকাশ: সোনালি কাবিন