একুশের স্মৃতি ও সত্তা

একুশের ভাষা আন্দোলন আজ বাঙালির জন্য এক কৃত্য। কিন্তু বিশ্বায়ন, পণ্যায়ন, বাজারি অর্থনীতি, করপোরেট বাণিজ্য আর অন্য দেশীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন একুশকে করে তুলছে উৎসবের দিন। তবু প্রভাতফেরি, শহীদ মিনার আর বাঙালি ও বাংলা ভাষা একুশকে ঘিরে আজও ভাবগাম্ভীর্য, গৌরব ও মহিমা নিয়ে অটুট। শহীদ মিনার আমাদের সত্তার ও জাতির এক মহান ‘আইকন’।
শুরুতে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি যে রক্ত ঝরেছে, যে ভাষা প্রতিষ্ঠা—প্রকারান্তরে বাঙালির অস্তিত্বকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতির আন্দোলনে যে রূপ নিল, তা-ই আমাদের একাত্তরের বীজতলা। সেই শহীদ মিনার প্রথমে প্রতীকীভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে তৎকালীন শাসক তা ভেঙে দিয়েছিল। সেই ঘটনাকে উপজীব্য করে কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ লিখেছিলেন কবিতা ‘স্মৃতির মিনার’, ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনে সেটি গ্রন্থিত। তখন কবি তরুণ, মার্ক্সীয় মতাদর্শের অনুসারী।
বাঙালির এই অস্তিত্ব-প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম—বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের লড়াই দেশ বিভাগ-পরবর্তী প্রথম জাগরণ। হাজার বছরের বাঙালি তার বিকাশ ও রাষ্ট্রীয় পরিচিতির জন্য এই লড়াই করেছিল বাংলা ভাষাকে নিয়ে—কেননা, ভাষাই বাস্তবতা ও অস্তিত্বের অভিজ্ঞান।
‘স্মৃতির মিনার’ কবিতাটি নাতিদীর্ঘ, একত্রিশ পঙ্ক্তিবিশিষ্ট। এর পঙ্ক্তিবিন্যাস চলিষ্ণু ও স্থিরতার দ্যোতনায় সহজ গতিছন্দে বাঁধা। প্রথমেই কবির প্রত্যয়ী প্রশ্ন—‘স্মৃতি মিনার ভেঙেছে তোমার?’ একই পঙ্ক্তিতে অভয়দান ও সাহসী উচ্চারণ। কারণ, বস্তুগত মিনার ভাঙলেও চার কোটি বাঙালি পরিবার অটুট, দণ্ডায়মান হয়ে রয়েছে। বাঙালির এই অস্তিত্বকে হাজারো বছরে কোনো ব্রাহ্মণ্য শাসন, সামন্ত শাসক, ঔপনিবেশিক সরকার নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। কবি এখানে ইঙ্গিত দেন, আমাদের যুগে যুগে লড়াই ও প্রতিবাদের যে সমুজ্জ্বল স্মৃতি, তার প্রতি। বন্যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে যেমন বাঙালি মরে না, তেমনি অপশাসন ও শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট হলেও সে নিশ্চিহ্ন হয় না। প্রতিটি লড়াই-প্রতিবাদ স্মৃতি হয়ে তার সত্তাকে বহুগুণিত করে। কেননা, এই বাঙালিরা কৃষি-সংস্কৃতির জীবন গড়ে তুলেছে, মৃত্তিকা যেমন ফসলায়ন থেকে বিরত থাকে না, বিপর্যস্ত হয় না এর উর্বরতা শক্তি, তেমনি বাঙালিও ফসলের মতো ফলে ওঠে বারবার। শিকড়ায়িত এই যে সত্তা তা প্রকৃতিলগ্ন; এটাই তার ‘এলিমেন্টাল ফোর্স অব লাইট’, সে জন্যই বোধ করি কোনো প্রতিশক্তিই একে দমিত করতে পারে না। এই যে ‘যারা বুনি ধান/ গুণ টানি, আর তুলি হাতিয়ার হাঁপর চালাই।/ সরল নায়ক আমরা জনতা সেই অনন্য’—এই বহুবিচিত্র শ্রমশীল বাঙালি তাই প্রাকৃতিকভাবেই দুর্জয় এবং তারা সর্বদাই জাগ্রত, যেমন জেগে থাকে ধানের জমি, নদীর স্রোত, বাতাসের প্রবাহ। প্রথম স্তবকে কবি এমন তাৎপর্যেই সংকেতিত করেন।
পরের স্তবকেই তাঁর কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে গম্ভীর, মন্দ্রিত। বিবাদী কণ্ঠস্বরে উচ্চারিত হতে থাকে মৃত্যুর কথা—ভিন্ন রকম এই মৃত্যু। আন্দোলনে শহীদ যুবকদের লাশের শিয়রে কোনো কান্নার রোল ওঠে না, বরং আসমুদ্র হিমাচলব্যাপী যে বেদনা ছড়ানো, তা হয়ে ওঠে একটি পতাকার রং; যা মৃত্যুর গভীর তাৎপর্য তৈরি করে। এই একুশের আত্মদান হয়ে ওঠে উৎস—জলপ্রপাতের মতো কবিদের লেখনী থেকে ঝরে পড়ে, বয়ে যায় সংকল্প আর প্রত্যয়ের স্রোতোধারা। তখন শুরু হয় কবির কবিতা রচনার ফলে—এ যেন নতুন ঋতুর আবির্ভাব, প্রাণ আর প্রকৃতির উৎসমুখ এক হয়ে যায়।
তৃতীয় স্তবকে কবিতাটি প্রথম স্তবকের মতোই অসমান পঙ্ক্তির আদল নেয়। কবি আল আজাদের একুশ-আবিষ্ট লেখনী-সত্তা সহমর্মী হয়ে ওঠে নিবিড়তায়—‘ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক। একটি মিনার গড়েছি আমরা/ চারকোটি পরিবার।’
এই ধ্রুব উচ্চারণে মন্দ্রিত হয়ে এবার শিল্পসৃষ্টির অমৃত ক্ষণের কথা। ‘বেহালার সুর আর রাঙা হৃদয়ের বর্ণলেখায়’ রচিত হতে থাকে একুশের কবিতা-গল্প।
কবি ‘রামধনুকের চোখের তারা’ এই রূপকটি ব্যবহার করে শিল্পে-সাহিত্যে একুশের বহুবর্ণিল বিচ্ছুরণের কথাই বলছেন, ‘চোখের তারায় তারায়’, অর্থাৎ দৃষ্টি-ইন্দ্রিয়ের প্রগাঢ়তায়, সাত রঙের বিভায়। ‘দ্বীপ হয়ে আসে যাদের জীবন’—এই পঙ্ক্তিতে আল আজাদের ডিকশন অনন্য হয়ে ওঠে। শহীদেরা এই জীবনসমুদ্রে একেকটা দ্বীপের মতো, যাঁরা মৃত্যুতেও অমর ও জাগ্রত। শুধু জাগ্রতই নয়, ফলে-ফুলে-মৃত্তিকার দৃঢ়তায় অনড় আমাদের জীবনে, তাদের সঙ্গেই ঘটে জীবনের প্রেম—‘ফেনিল শিলায়’। প্রস্তরীভূত শিলা আর ‘ফেনিল’—কথায় একই সঙ্গে স্থিরতা ও বহুমাত্রার সাজেশন তৈরি হয়। তারপরই প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে চেতনার সূর্য। তখন প্রতিটি বাঙালি হয়ে ওঠে ‘শপথের ভাস্কর’। দুই অর্থেই ভাস্কর-সূর্যের আলো আর জীবনের ভাস্কর্য রচনার শিল্পী।
কবিতাটি পাঠে আমাদের নানা ব্যঞ্জনার মুখোমুখি হতে হয়, যা একটি কবিতার সার্থকতা। একুশই এই সার্থকতা ও বহুব্যঞ্জনার প্রসূতি-মাতা, শহীদেরা তার সূর্যপ্রতিম সন্তান। কবিতার শব্দ-গ্রন্থনায় কবি অন্তর্যোজনা তৈরি করেন সূর্য আর রামধনু-সপ্ত বর্ণমালার; এবং শহীদেরাই হয়ে ওঠেন একেকটি সূর্যদীপ্ত নক্ষত্র। স্মৃতিলোকে যা নাক্ষত্রিক মহিমায় জ্বলজ্বলে। সবটাই চেতনার আকাশসংলগ্ন। স্মৃতির মিনার নির্ভার হয়ে দীপ্ত শপথ আর সাহসে হয়ে ওঠে এক আবহমান চেতনা।

স্মৃতির মিনার

আলাউদ্দিন আল আজাদ

 

স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো

                                     চারকোটি পরিবার

খাড়া রয়েছি তো! যে ভিত কখনো কোনো রাজন্য

                        পারেনি ভাঙতে

হীরের মুকুট নীল পরোয়ানা         খোলা তলোয়ার

খুরের ঝটকা ধুলায় চূর্ণ              যে পদপ্রান্তে

                        যারা বুনি ধান

গুণ টানি, আর তুলি হাতিয়ার       হাঁপর চালাই

সরল নায়ক আমরা জনতা          সেই অনন্য।

                        ইটের মিনার

ভেঙেছে ভাঙুক! ভয় কি বন্ধু, দেখ একবার আমরা জাগরী

                                     চারকোটি পরিবার।

 

এ কোন্ মৃত্যু? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন,

শিয়রে যাহার ওঠে না কান্না, ঝরে না অশ্রু?

হিমালয় থেকে সাগর অবধি সহসা বরং

সকল বেদনা হয়ে ওঠে এক পতাকার রং

এ কোন্ মৃত্যু? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন,

বিরহে যেখানে নেই হাহাকার? কেবল সেতার

হয় প্রপাতের মোহনীয় ধারা, অনেক কথার

পদাতিক ঋতু কলমেরে দেয় কবিতার কাল?

 

ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক। একটি মিনার গড়েছি আমরা

                                     চারকোটি কারিগর

বেহালার সুরে, রাঙা হৃদয়ের বর্ণলেখায়।

                        পলাশের আর

রামধনুকের গভীর চোখের তারায় তারায়

দ্বীপ হয়ে ভাসে যাদের জীবন, যুগে যুগে সেই

                        শহীদের নাম

এঁকেছি প্রেমের ফেনিল শিলায়, তোমাদের নামে।

                        তাই আমাদের

হাজার মুঠির বজ্র শিখরে সূর্যের মতো জ্বলে শুধু এক

                                    শপথের ভাস্কর।

 

 

প্রকাশ: হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারী