রক্ত আর আগুনের হরফ

কবিতাই বাঙালির প্রাণ। বাঙালি কবিতা লিখেছে তার সাহিত্যের পরিসরে। বাঙালি কবিতা লিখেছে ইতিহাসের খোলা ময়দানে। কবিতায় সাহিত্য আর ইতিহাসকে একাকার করে দিয়েছে বাঙালি। তাই কবিতা নেই তো বাঙালি নেই। এ কথা বিশেষ করে সত্য বাংলার পূর্ব ভূখণ্ডে। ইতিহাস সাক্ষী, বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনে এই সত্যের প্রভাব কী গভীর। ইতিহাসের ধাপে ধাপে—বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে, উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে, নব্বইয়ের সামরিক স্বৈরাচার নিপাতের লড়াইয়ে—এ সত্য খচিত রয়েছে রক্ত আর আগুনের হরফে।

কিন্তু কথাটা নিছক আবেগেরই নয়। উনিশ শতকের কলকাতায় উপনিবেশের ধাক্কায় জেগে উঠেছে ব্যক্তি। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম—বিরাট সব ব্যক্তির চিন্তাচর্চার হাত ধরে আড়মোড়া ভাঙতে শুরু করেছে সমাজ। পূর্ব বাংলার বিপুল জনগোষ্ঠী তখনো আদিগন্ত কাদামাটিতে উবু হয়ে রুয়ে দিচ্ছে শস্যের চারা। এরা ব্যক্তি নয়, যেন এক কৌমের সদস্য। আনন্দে, বেদনায়, লড়াইয়ে জোট হয়ে থাকে সবাই। এদের জগতে বুদ্ধির চেয়ে অন্তরের আহ্বান বড়। বুদ্ধি ভাষা পাওয়ার আগেই তাই এরা সক্রিয় হয়ে ওঠে অন্তরের ডাকে। তাই কবিতা আর কবিতাভরা গান এদের ভাষা।

গায়ে কাদামাটি ল্যাপটানো উবু হয়ে থাকা এই মানুষেরাই উঠে দাঁড়াতে চাইল। এরা একত্রে চলে, তাই এদের পায়ের তলায় জেগে উঠল ইতিহাসের রাজপথ। তারা দাবি জানাল নিজের ভাষার। ইতিহাসের সেই রাজপথে রক্ত ঝরে গেল ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারিতে। এরপর আর থেমে থাকার উপায় কোথায়? ভাষার সঙ্গে এল নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠার দাবি। এরপর রাষ্ট্র, গণতন্ত্র, মানুষের অফুরন্ত মুক্তির লড়াই। ১৯৫২ সালের পরে একে একে এল ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০। ব্যক্তি নয়, জনবিস্ফোরণ। বাংলাদেশ তাই কথা বলেছে ইতিহাসে।

অন্তরের যে ডাকে কোনো জাতি ইতিহাস গড়ে তোলে, তা নিয়ে সে কবিতায় কথা না বলে কি পারে? বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন জন্ম দিল একঝাঁক নতুন কবি। তাঁদের কবিতায় ভাষা পেল জাতির হৃদয়ের আকুতি। এসব কবিতায় একদিকে প্রকাশ পেল জনগোষ্ঠীর আবেগ, অন্যদিকে তাদের আত্মপরিচয়ও গড়ে উঠতে লাগল এসব কবিতা-অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে।

পাকিস্তানের শাসক দল যখন ভয় পেয়ে ভেঙে দিল ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ মিনার, ১৯৫০-এর দশকের কবি দলের একজন আলাউদ্দিন আল আজাদ লিখলেন, ‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো চারকোটি পরিবার/খাঁড়া রয়েছি তো।’ লিখলেন আরও অনেকে। এরপর ১৯৬০-এর দশকে বাংলার মাটিতে ঢেউয়ের পরে ঢেউয়ের মতো বইতে লাগল আন্দোলনের ঝাপটা।

ঝরণাধারার মতো কলম উপচে উঠল বাংলার কবিদের। শামসুর রাহমানের, সৈয়দ শামসুল হকের, আল মাহমুদের, শহীদ কাদরীর। তাঁদের পিছু পিছু এলেন আরও একদল নবীন কবি—নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, রফিক আজাদ। ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনে পাকিস্তানি শাসকদের হাতে আসাদ শহীদ হলে শামসুর রাহমান কবিতায় বললেন, আসাদের রক্তমাখা শার্টই বাঙালির ‘প্রাণের পতাকা’। ঘাতকদের রুখতে আল মাহমুদ হাঁক দিয়ে বললেন, ‘ট্রাকের মুখে আগুন দিতে মতিউরকে ডাক।’ লড়াই আরও তীব্র হয়ে উঠলে হেলাল হাফিজ লিখলেন, ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’

মুক্তিরযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর কবিতাসম বক্তৃতায় বজ্রঘোষণা দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আবেগকম্পিত কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখলেন ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’।

স্বাধীনতা এল। মানুষের মুক্তির লড়াই অব্যাহত রইল। কয়েক বছরের মধ্যেই দেশ কবজায় চলে গেল সামরিক স্বৈরতন্ত্রের। ১৯৯০–এর দশকের শেষ দিকে মানুষকে আবার নামতে হলো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে। রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিলেন নূর হোসেন। সেই রক্তে শামসুর রাহমান লিখলেন ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’।

এসব অমর কবিতা ইতিহাসের সঙ্গে বাঙালির লড়াইয়ের চিহ্ন, বাঙালি জাতির বংশলক্ষণ। এই কবিতাগুলো লেখা হয়েছে অতীত ইতিহাসের একেকটি ক্ষণে, কিন্তু তাকিয়ে আছে আগামী মুক্তির ইতিহাসের দিকে। মানুষের মুক্তির লড়াই যত দিন চলবে, এই কবিতা তত দিন আমাদের স্বপ্ন দেখাবে। বলবে, তোমরা থেমো না, তোমাদের লড়াই এখনো শেষ হয়নি।