সময়ের গ্রন্থিতে স্মৃতি রোমন্থন

‘আত্মরক্ষার্থে রোহিঙ্গা’, িশল্পী: সৈয়দ জাহাঙ্গীর
‘আত্মরক্ষার্থে রোহিঙ্গা’, িশল্পী: সৈয়দ জাহাঙ্গীর

নিচে নদী, ওপরে আকাশ। দুইয়ের বিস্তৃতি ও বিশালত্বের মাঝে সবুজ বাংলার মাটি ও মানুষের জীবনযাপন। যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, জীবনকথা শিল্পীর তুলিতে ধরা হয়েছে শিশুমনের সরল ভাবনায় ও কল্পনার রঙে। বিষয়কে বোধে ধারণ করে রূপের গড়নে অরূপের সন্ধান করেছেন তিনি স্মৃতি রোমন্থিত সুরেলা রঙে। কথাগুলো বলা বাংলাদেশের বয়োজ্যেষ্ঠ শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীরের ৪২তম একক চিত্র প্রদর্শনী প্রসঙ্গে। অবিন্তা গ্যালারি অব ফাইন আর্টসে ১১ নভেম্বর শুরু হয়েছে এ প্রদর্শনী।

প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে শিল্পীর সাম্প্রতিক কালের ৬০টি চিত্রকর্ম। এগুলোর প্রায় সব ছবিতেই বলা হয়েছে বাংলার নদী, মাটি ও মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ গল্প। সৈয়দ জাহাঙ্গীর বিমূর্ত শিল্পী হিসেবেই বেশি পরিচিত। বিগত দুই দশকে রং, ফর্ম, বর্ণের প্রকৃতি ও পরমানন্দের অভ্যন্তরীণ অজানা সৌন্দর্য নির্মাণ ছেড়ে চর্চা করছেন মূর্ত গড়নের। তবে তাঁর চিত্রগুলো ইলাস্ট্রেটিভ বা সচিত্র নয়, শিশু চিত্রাঙ্কনের মতো সহজ ও সরল। এখানে আছে বাংলার নদীবেষ্টিত প্রান্তিক মানুষের জীবনগাথার আভাস। ‘মেমরিজ বিয়ন্ড টাইম’ বা সময়ের অতীত স্মৃতি শিরোনামের এই প্রদর্শনীর প্রতিটি ছবির ঘটনা ভিন্ন হলেও প্রতি চিত্রের ক্ষেত্র হলো নীলাকাশ ও স্বচ্ছ নীলাভ নদী। যেন নদী অনুষঙ্গে সার্থক মানুষের জীবন।

‘ঘরে ফেরা’ ছবিতে দেখা যায় রাখালের নির্দেশনায় সাঁতার কেটে নদী পার হচ্ছে সারিবদ্ধ একপাল মহিষ। এ নদী কপোতাক্ষ, যা শিল্পীর ফেলে আসা শৈশব স্মৃতির স্বপ্নচয়িত বাস্তবতার পুনরুদ্ধার। নদীর মতো চাঁদ অথবা সূর্য রয়েছে সব ছবিতে। প্রাধান্য পেয়েছে নীল ও হলুদ রং। নদী, মাঠ, আকাশ রূপায়ণে রঙে প্রলেপ আছে দ্বিমাত্রিকভাবে। নীলের মধ্যে গতিময় সাদা দ্বিমাত্রিকতাকে ত্রিমাত্রিক ছন্দে প্রাণবন্ত করেছে কিছুটা। তুলির আঁচড়ে রঙের চলন ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে সেখানে।

মাছ ধরা, নদীর পাড়ে হাঁটা, নদীভাঙন রোধে প্রচেষ্টা, নদীতে খাবার পানি সংগ্রহ, নদীতে বেদে নৌকার সারি, ফেরিঘাটে অপেক্ষা, নদীর জলে বন্যাপ্লাবিত মানুষ প্রভৃতি ছবি নদীমাতৃক বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্থান, কাল ও পরিবেশের দলিল।

‘নবান্ন-১’ ও ‘নবান্ন-২’ ছবিতে এসেছে নদীপারের কৃষকের ফসল তোলার দৃশ্য। পাশাপাশি, নদী দখল ও নদী তীরবর্তী ইটভাটায় মানুষসৃষ্ট পরিবেশদূষণের মতো ঘটনাচিত্রও দৃশ্যায়িত হয়েছে।

‘আত্মরক্ষার্থে রোহিঙ্গা’ চিত্রে রয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে মানবতাবিবর্জিত ঘটনার বর্ণনা। রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পোড়ানো এবং নদীপথে বাংলাদেশে আসার দুর্দশাময় এই ছবিটি ঐতিহাসিক দলিল হয়ে থাকবে।

ক্যানভাসে অ্যাক্রেলিক ও কাগজের ওপর অ্যাক্রেলিক মাধ্যম ছাড়াও প্রদর্শনীর বিশেষ চমক কাগজের ওপর স্প্যাচুলা ড্রয়িং। এই ড্রয়িং করা হয়েছে কালো অ্যাক্রেলিক রঙে। ঘূর্ণিঝড়ের পরে কর্মরত নারী, জলে ভেলায় ভাসা প্রভৃতি বিষয় বর্ণিত দৃশ্যচিত্রে রেখা ও স্পেসের বিন্যাসে প্রকাশ পেয়েছে শিল্পীর স্বকীয়তা। ‘উড়ন্ত পাখি’ ও ‘বিশ্রাম’ শিরোনামের কম্পোজিশনে স্পেসের ব্যবহারে আছে চমৎকারিত্ব।

জাহাঙ্গীরের দর্শন মাটি ও মানুষ ঘিরে। চিত্র অঙ্কনে দ্রুততা, সরলীকরণ, কল্পনা, স্মৃতিধৃত নমুনা ও বাংলার ইতিহাস উপস্থাপন এই প্রদর্শনীর বৈশিষ্ট্য। ফিগার চিত্রণে বাস্তবানুগতার চেষ্টা নেই। বিমূর্ত চর্চা থেকে মূর্ততায় ফিরে আসার পদক্ষেপ যেন এটি।

‘চাঁদনী রাতে জোয়ার’ ছবিতে জলের রং কালচে তামাটে স্বর্ণালি। এখানে শিল্পী হয়তো জোয়ারের সঙ্গে সম্ভাবনাময় কিন্তু এখন বিগত তাঁর যৌবনকে প্রতীকায়িত করেছেন মরমি ভাবনালোকে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাঁর এই উপস্থাপন, ইলাস্ট্রেটিভ-ভাবনা অতিরিক্ত শিল্পদর্শন কিংবা শিল্প রসের পাঠোদ্ধার করতে পারবে কি না সে প্রশ্ন থাকছেই। তবে শিল্পীর দীর্ঘ জীবনযাত্রার সঙ্গে অন্তর্গত ভাবনা ও কল্পনার রং মিলিয়ে দেখলে অনেক ভাবনার খোরাক শিল্পরসিকেরা নিশ্চয়ই পাবেন। প্রদর্শনীটি চলবে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।