পৃথিবীর প্রথম কবি

িশল্পীর কল্পনায় এনহেদুয়ান্না। ছবি: সংগৃহীত
িশল্পীর কল্পনায় এনহেদুয়ান্না। ছবি: সংগৃহীত

চন্দ্রদেবী সুয়েনের মন্দিরে ধ্যানমগ্ন এক যুবতী, পদ্মাসনে উপবিষ্ট। দুই হাতের করতল সংযুক্ত, ঈষৎ উত্তোলিত। বুকের দুপাশে নগ্ন স্তনের ওপর দুগাছি কালো চুল। সুডৌল বাহুযুগল, উন্মুক্ত পিঠ এবং ঊরুসন্ধির সঙ্গমস্থলে স্ফীত নিতম্ব, যা শ্বেতপাথরের ওপর ছড়ানো একতাল মসৃণ মাংসপিণ্ডের মতো পড়ে আছে। ধু ধু প্রান্তরে মৌন সন্ন্যাসীর মতো দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি ন্যাড়া বৃক্ষ। গোধূলিলগ্ন। সূর্যাস্তের এক চিলতে লাল আভা এসে পড়েছে দেবী সুয়েনের কপালে শোভিত মুকুটের ওপর। প্রার্থনামগ্ন আক্কাদিয়ান যুবতীর নগ্ন অবয়ব থেকে এক অলৌকিক আলোর উজ্জ্বল আভা বিকীর্ণ হচ্ছে। পেছনে সম্রাট সারগনের নেতৃত্বে আক্কাদ সাম্রাজ্যের গণ্যমান্য লোকজন। চন্দ্র দেবীর কাছে আজ ওদের একটিই প্রার্থনা—তিনি যেন এই সাম্রাজ্যকে অসুর লুগাল এনের হাত থেকে রক্ষা করেন।

ওপরে বর্ণিত দৃশ্যটি আজ থেকে ৪ হাজার ২৭৪ বছর আগের, অর্থাৎ যিশুর জন্মের ২২৫৮ বছর আগের। এই প্রার্থনাসভার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যে নারী, তাঁর নাম এনহেদুয়ান্না। তখন তিনি ২৭ বছরের পূর্ণ যুবতী। এনহেদুয়ান্না শব্দের অর্থ অন্তরীক্ষ দেবী। তিনি আক্কাদের সম্রাট সারগন ও তাঁর স্ত্রী রানি তাশলুলতুমের মেয়ে। অন্য এক মতে, এনহেদুয়ান্না সম্রাট সারগনের (যাঁকে পৃথিবীর সম্রাট বলে অভিবাদন জানানো হতো) মেয়ে নন, তবে রক্তের সম্পর্কিত আত্মীয়া।

এনহেদুয়ান্না ছিলেন অসম্ভব মেধাবী মানুষ; এক নারী, যিনি প্রার্থনাসংগীত ও কবিতা লিখতে পারতেন বলে তৎকালীন সমাজ তাঁকে দেবী হিসেবে পূজা করত। তাঁর পিতা সম্রাট সারগন কন্যা এনহেদুয়ান্নাকে রাজ্যের প্রধান পুরোহিতের সম্মানে ভূষিত করেন। এই পদটি মর্যাদা পেত রাজ্যের সবচেয়ে সম্মানিত পদ হিসেবে।

সারগনের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র রামিস সম্রাট হলেও এনহেদুয়ান্না তাঁর স্বপদে বহাল থাকেন। ২২৮৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জন্মগ্রহণকারী এই নারীই এযাবৎকালের আবিষ্কৃত প্রথম লেখক বা কবি। তিনি ৪২টি স্তবগান রচনা করেন, যা পরবর্তীকালে ৩৭টি প্রস্তরখণ্ড থেকে উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া তিনি দেবী ইনানার স্তুতি করে আরও বেশ কিছু শ্লোক রচনা করেন।

সুমেরু ভাষার ইনানাই আক্কাদিয়ান ভাষার ইস্তার, পরবর্তীকালে গ্রিকরা যাঁকে আফ্রোদিতি বলে শনাক্ত করে এবং রোমানরা তাঁকে ডাকে ভেনাস বলে, তিনি ছিলেন প্রেমের দেবী। দেবী ইনানার স্তুতি স্তাবকে সমৃদ্ধ এনহেদুয়ান্নার কবিতাগুলোই প্রার্থনাসভা-সংগীতের ভিত্তি নির্মাণ করে। সেই দিক থেকে তিনি ধর্মাবতারের কাজ করেছেন। তাঁর ওপর রাজা সারগনের ছিল পূর্ণ আস্থা। এনহেদুয়ান্নার মাধ্যমেই তিনি সুমেরু দেব-দেবীদের স্থলে আক্কাদিয়ান দেব-দেবীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কাজটি করেছিলেন, রাজ্য নিষ্কণ্টক রাখার জন্য এর প্রয়োজন হয়েছিল। এনহেদুয়ান্নার কাব্যপ্রতিভা তৎকালীন মেসিপটেমিয়ার নারীদের শিক্ষা গ্রহণে এগিয়ে আসতে অনুপ্রাণিত করে এবং রাজবংশের নারীদের কবিতা লিখতে উৎসাহিত করে। একসময় এটা প্রায় অবধারিতই হয়ে ওঠে যে রাজকন্যা ও রাজবধূরা অবশ্যই কবিতা লিখতে জানবেন। যদিও তাঁর সমসাময়িককালে আর তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো নারী কবির সন্ধান পাওয়া যায়নি। এতে এটাও প্রতীয়মান হয় যে পার্শি বি শেলির কথাই ঠিক, কবিতা একটি ঐশ্বরিক বা স্বর্গীয় ব্যাপার। তিনি অবশ্য স্বর্গীয় বলতে বুঝিয়েছেন মানুষের স্বর্গীয় অনুভূতির কথা।

এনহেদুয়ান্না সম্পর্কে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ পল ক্রিওয়াসজেক বলেন, ‘তাঁর কম্পোজিশন, যদিও এই আধুনিককালেই কেবল পুনরুদ্ধার করা হলো, সর্বকালের অনুনয়মূলক প্রার্থনার মডেল। ব্যাবিলনীয়দের মাধ্যমে এর প্রভাব হিব্রু বাইবেলে এবং প্রাচীন গ্রিক প্রার্থনাসংগীতেও এসে পড়েছে। ইতিহাসের প্রথম কবি এনহেদুয়ান্নার ভীরু শ্লোকগুলোর প্রভাব প্রথম দিকের খ্রিষ্টান চার্চেও শোনা যেত।’

তখনকার প্রেক্ষাপটে নিয়মতান্ত্রিক প্রার্থনা মানুষের মধ্যে মানবতাবোধ তৈরিতে সহায়ক ছিল। রাজ্যে ও সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। যদিও দেব-দেবীরা যাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকতেন, অর্থাৎ রাজা বা গোত্রপ্রধানগণ ধর্মের নামে জনগণকে প্রতারিতও করতেন। তা সত্ত্বেও ধর্মই মানুষের অস্থির চিত্তকে নিয়ন্ত্রণে রাখার একমাত্র উপায় ছিল। সেই দিক থেকে পৃথিবীর প্রথম কবি এনহেদুয়ান্না প্রার্থনা শ্লোক বা দেব-দেবীর স্তুতিবাক্য রচনা করে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন মানব সভ্যতার জন্য।

২২৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন পৃথিবীর প্রথম কবি এই মহীয়সী নারী। তিনি কোনো পুরুষ সঙ্গী গ্রহণ করেছিলেন কি না বা কোনো সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন কি না—এ সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা না গেলেও এটা অনুমিত যে রাজ্যের প্রধান পুরোহিত হওয়ার কারণে হয়তো সংসারের মতো জাগতিক মায়ার বাঁধনে তিনি জড়াননি।

এই লেখায় পৃথিবীর প্রথম কবি এনহেদুয়ান্নার কিছু শ্লোকের বাংলা অনুবাদ উপস্থাপনের চেষ্টা করছি। অনুবাদগুলো আমি করেছি ইংরেজি থেকে। এনহেদুয়ান্না যে পদ্ধতিতে লিখেছিলেন, সেই পদ্ধতিকে বলা হতো কিউনিফর্ম পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে ৩৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে লিখতে শুরু করে মেসিপটেমিয়ার অধিবাসীরা।

এনহেদুয়ান্নার শ্লোক

১.

আমি তোমার এবং সব সময় তোমারই থাকব

তোমার হৃদয় আমার জন্যে শীতল হোক,

তোমার চেতনা, সমবেদনা আমার প্রতি

                        করুণার্দ্র হোক

তোমার কঠিন শাস্তির স্বাদ আমি উপলব্ধি করেছি।

(তৃতীয় লাইনের কিছু অংশ উদ্ধার করা যায়নি। ‘করুণার্দ্র’ শব্দটি যোগ করা হয়েছে চরণকে অর্থবহ করার জন্য। এনহেদুয়ান্নার শ্লোক: ১২)

২.

আমার দেবী, আমি ভূমণ্ডলে তোমার মহানুভবতা ও মহিমা ঘোষণা করছি

আমি চিরকাল তোমার মহানুভবতার

                        গুণগান করে যাব।

(শ্লোক: ১৩)

৩.

রানি যে বড় কাজগুলো করেন তা নিজের জন্য

তিনি জড়ো করেন নিজের স্বর্গ-মর্ত্য

তিনি মহান দেবীর প্রতিদ্বন্দ্বী।

(শ্লোক: ১৬)

৪.

দেবরাজ, শ্বাস-প্রশ্বাস এবং বাতাসের দেবী এই মহাবিশ্বকে করেছে তোমার দিকে ধাবমান

হে দেবীদের দেবী ইনানা, তোমার পদতলে

                        অর্পিত মহাবিশ্ব

তুমিই নির্ধারণ করো রাজকন্যাদের ভাগ্য।

(শ্লোক: ১৮)

৫.

মহীয়সী, তুমি সুমহান, তুমি গুরুত্বপূর্ণ

ইনানা তুমি মহান, তুমি গুরুত্বপূর্ণ

আমার দেবী, তোমার মহানুভবতা উদ্ভিন্ন

আমার দোহাই তোমার হৃদয় ফিরে যাক যথাস্থানে।

(শ্লোক: ১৯)