আঁকার বন্ধু, লেখার বন্ধু

দুই বন্ধু কাইয়ুম চৌধুরী ও সৈয়দ শামসুল হক। ছবি: জাহিদুল করিম
দুই বন্ধু কাইয়ুম চৌধুরী ও সৈয়দ শামসুল হক। ছবি: জাহিদুল করিম

গতকাল ছিল কাইয়ুম চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকী। শিল্পী গত হওয়ার পর তাঁর প্রথম জন্মদিন উদ্‌যাপিত হয় ২০১৫ সালে। এ উপলক্ষে জাতীয় জাদুঘরে তাঁর প্রচ্ছদ ও অলংকরণের একটি প্রদর্শনী করেছিল প্রথম আলো। তার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক মেলে ধরেছিলেন শিল্পীর সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ বন্ধুত্বের খেরোখাতা

আমার বন্ধু শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর আজ জন্মদিন। তিনি বেঁচে থাকলে এই দিনটি অনেক আনন্দে কাটত। কিন্তু কিছুদিন আগে তিনি চলে গেছেন। তবে তাঁর কাজ পড়ে আছে। এখন কাইয়ুমের কাজ ঘিরেই আমাদের যা কিছু দিনযাপন, যা কিছু আনন্দ, যা কিছু উল্লাস। আজ সকাল থেকে কাইয়ুমের একটি কবিতা বারবার মনে পড়ছে। কবিতার কয়েকটি লাইন উচ্চারণ করলে আপনারা বুঝতে পারবেন, কেন তাঁর স্মৃতি সকাল থেকে মনে পড়ছিল।

হাত বাড়িয়ে দিলে

বললে বিদায়—

কোথায়?

শেষ বিকেল

বিকেল গড়িয়ে রাত

আকাশনীলে

কালো ছোঁয়া

হাতিরঝিলে

আঁধার অকস্মাৎ।

কাইয়ুমের কবিতা ও প্রচ্ছদগুলো পাশাপাশি রাখলে বোঝা যায়, এসবের মধ্য দিয়ে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছিলেন। তাঁর বই, তাঁর আঁকা প্রচ্ছদগুলো বারবার কাইয়ুমের কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি অসাধারণ প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন বললে আদতে কিছুই বলা হয় না।

এখন আমার ভেতরে চলছে অজস্র স্মৃতির লেনদেন। মনে পড়ছে, মুন্সিগঞ্জ থেকে শিশুদের একটি কাগজ বের হবে। সম্ভবত ১৯৫৩ সাল। কাইয়ুম একটি সুন্দর প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন কালিতে। সেটাতে রিভার্স করে ছাপা হয়েছিল। একটিমাত্র সংখ্যাই বেরিয়েছিল সে পত্রিকার। তাঁর সেই প্রথম কাজের কথা কাইয়ুম কখনো ভুলতে পারেননি। আজকে তাঁর আঁকা প্রচ্ছদগুলো দেখছি, আর সেদিনের কথা মনে পড়ছে।

আত্মপ্রতিকৃতিতে কাইয়ুম চৌধুরী (৯ মার্চ ১৯৩২—৩০ ডিসেম্বর ১৯১৪)
আত্মপ্রতিকৃতিতে কাইয়ুম চৌধুরী (৯ মার্চ ১৯৩২—৩০ ডিসেম্বর ১৯১৪)

কাইয়ুমের কথা মনে পড়লেই চোখে ভেসে ওঠে সেই টিনের ঘরটি—চাটাইয়ের বেড়া, দুটো কাঠের চৌকি, টেবিল। আবদুল কাদের চৌধুরী—কাইয়ুম চৌধুরীর বড় ভাই, আমাদের কাদের ভাই—বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। তাঁর সঙ্গে সেই টিনের ঘরে থাকতেন কাইয়ুম, তিনি শিল্পকলার ছাত্র। দুই ভাই থাকতেন একসঙ্গে। তাঁদের পায়ের কাছে একটা বড় টেবিল, সেখানে থাকত কাইয়ুমের আঁকার সরঞ্জাম, জিনিসপত্র। বহু বহুদিন, বছরের পর বছর বিকেলবেলায় কাইয়ুমের সঙ্গে যখন ওই বাড়িতে গিয়েছি। দেখতাম দৃশ্যের পর দৃশ্য। কাদের ভাই মড়ার মতো পড়ে আছেন। পড়ার অনেক চাপ ছিল তাঁর। কাইয়ুম ভেতর থেকে একপলক ঘুরে এসেই ব্যস্ত হয়ে পড়তেন আঁকার কাজে। কাইয়ুমের মা একধরনের পিঠা বানাতেন ছেলেমেয়ের জন্য। পিঠা ভাজার সুঘ্রাণ ভেসে আসত। কাইয়ুম দুটো-একটা খেতেন, কাদের ভাইও খেতেন একটা-দুটো। সেই কাদের ভাইয়ের ছেলে এখন বাংলাদেশ বিমানের জেট ক্যাপ্টেন শোয়েব চৌধুরী। কাইয়ুমের খুব প্রিয়, খুব স্নেহের পাত্র।

যা হোক, অনেক কথা বলব। কাইয়ুম আর আমার নানা স্মৃতি তরঙ্গ তুলছে করোটির ভেতর। কারণ, বন্ধু-বিয়োগের শোক আমি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি।

মনে পড়ে, হাঁটতে হাঁটতে সেই সদরঘাটে যাওয়ার কথা। ঘোরাঘুরির ব্যাপারে কাইয়ুমের নেশা ছিল। আমারও। বুড়িগঙ্গায় নৌকা ভাড়া করে ঘুরে বেড়াতাম দুজন। বুড়িগঙ্গার বাকল্যান্ড বাঁধ এখন আর নেই। ১৯৫০-এর দশকে এই বাঁধের পাশে ছিল একটি কাঠের দোতলা। নৌকা থেকে নামার পর ওই দোতলায় বসে আমাকে আঁকা শেখাতেন কাইয়ুম। আমি ওঁকে শেখাতাম কবিতার ছন্দ। সেখানে বসে আমি ছবি আঁকার চেষ্টা করতাম। আর কাইয়ুম চেষ্টা করতেন কবিতা লিখতে। এসব ’৫৫, ’৫৬, ’৫৭ সালের কথা।

পরবর্তী সময়ে ছড়া লিখতে শুরু করেন কাইয়ুম, তারপর কবিতাও। প্রথমা প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে তাঁর কবিতার বই হাতের রেখায় রোদের শিহরণ। পড়ে থাকলে আপনারা বুঝতে পারবেন, তাঁর ভেতরের শিল্প ও প্রেমচিন্তা। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা যেভাবে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে নিদর্শন বের করেন, একইভাবে কাইয়ুমের কবিতার ভেতর থেকে বের করা যাবে তাঁর জীবনযাপন।

আগেই বলেছি নৌকার কথা। নৌকা কাইয়ুমকে খুব টানত। আজ ভাবি, একটা নৌকা কী করে একটা রাজনৈতিক দলের প্রতীক হয়ে উঠল! নৌকা তখন নানাভাবে প্রতীক হয়ে উঠেছে। এরও কত আগে নৌকায় আকৃষ্ট হয়েছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী, কে জানে! গলুইয়ের গঠন তাঁকে আকর্ষণ করত। গলুইয়ে আঁকা চোখ, কখনো কাঠখোদাই করা, কখনো ভেতরের বোতাম, কাঠ ঠুকে ঠুকে আঁকা চোখ, আর নদীর পানি যখন ছলকে উঠে গলুইয়ের চোখ ভিজিয়ে দিত—এসব খুব আপ্লুত করত কাইয়ুমকে।

আমরা বন্ধু, কিন্তু শেষ জীবন পর্যন্ত ‘আপনি’ ‘আপনি’ করে বলতাম দুজন দুজনকে।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসটি বেরোল। বাংলাবাজার থেকে পয়সা ভাগাভাগি করে বইটা কিনলাম দুজন মিলে। ভাবলাম, নদী কাঁদে, নৌকাও কাঁদে। যাক, একজন কথাসাহিত্যিক পাওয়া গেল, যিনি নদী কাঁদে বলে একটি বই লিখেছেন—কাঁদো নদী কাঁদো

হঠাৎই একবার কাইয়ুমের শখ হলো, গ্রামোফোন কিনবেন। তোপখানা রোডে কী যেন নাম—এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না—সেই একটিই মাত্র দোকান ছিল তখন গ্রামোফোনের। ঢাকা মিউজিক্যাল মার্ট ১৯৫০ সালে বন্ধ হয়ে যায়। তারপর তোপখানা রোডে কলকাতা থেকে আসা এক ভদ্রলোক গ্রামোফোনের সেই দোকান খোলেন। ১৯৫৪ কি ’৫৫ সালের কথা। ওই দোকান থেকে ৪০০ টাকা দিয়ে গ্রামোফোন কিনলেন কাইয়ুম। কিনলেন রেকর্ডও। দৃশ্যটি এখনো চোখে ভাসে। উচ্চাঙ্গসংগীতের তিনটি রেকর্ড নিয়ে বাড়ি ফিরলেন তিনি।

কাইয়ুমের বিয়ের কথাটা এখনো মনে পড়ে। চারুকলার উল্টো দিকে—এখন যেটা ছবির হাট—সেখানে দেখা হয়েছিল তাহেরা খানমের সঙ্গে। তিনটি মেয়ে এসেছিল। তাদের মধ্যে একজন লাল পাড় সাদা শাড়ি পরা। দুজনকে আগে থেকেই চিনতাম। ওদের দেখেই নার্ভাস হয়ে পড়লেন কাইয়ুম। তখন তিনি খুব লাজুক ছিলেন। কথা বলতেন কম। হাসতেনও না বেশি। শেষ জীবনের কাইয়ুম চৌধুরীকে দেখে এখন কেউ কল্পনাও করতে পারবে না, একসময় তিনি কতটা লাজুক ছিলেন। এই তো বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের আসরে কী অসাধারণ বক্তৃতা দিলেন। এই কাইয়ুম চৌধুরী আর গত শতকের পঞ্চাশের দশকের কাইয়ুম চৌধুরীকে এক করা যায় না।

বিয়ের দিন সিদ্ধেশ্বরী থেকে সাজিয়ে-গুজিয়ে কাইয়ুমকে নিয়ে বেরিয়েছি। থরথর করে কাঁপছে ওঁর হাত-পা। সারা রাস্তা গাড়িতে আমি হাত ধরে আছি। হ্যাঁ, এটা তাঁর সেই হাত, যে বলিষ্ঠ হাতে তিনি এত সুন্দর সুন্দর ছবি এঁকেছেন। সেই হাত বিয়ের দিনে কাঁপছে। আমি ধরে আছি যদিও, তবু কাঁপুনি থামেনি।

কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা নৌকা, নৌকাকে তিনি করে তুলেছিলেন বাংলার প্রতীক
কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা নৌকা, নৌকাকে তিনি করে তুলেছিলেন বাংলার প্রতীক

নিয়ম অনুযায়ী কন্যাপক্ষ বিয়ের গেট আটকিয়েছে। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি কুলকুল করে কাঁপছেন। এতটা নার্ভাস ছিলেন। অথচ এই নার্ভাস মানুষটি, এই কম কথা বলা মানুষটি, তাঁর হাতে যে কাজ করেছেন সেই কাজগুলো আমাদের জাতীয় জীবনে একটা স্থায়ী রূপ নিয়েছে।

মাত্রই তো বললাম, কাইয়ুম কম কথা বলতেন। বোধ করি খানিকটা ভিতুও ছিলেন। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলি। আমরা দুই বন্ধু প্রায়ই বেড়াতে যেতাম বিভিন্ন জায়গায়। একবার সাভারে গিয়েছিলাম। সাভার তখন বন-জঙ্গলঘেরা। আমরা হাঁটছি। হঠাৎ খপ করে কাইয়ুম আমার হাত ধরে বললেন, ‘ওদিকে যাব না, ওদিকে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।’ আমি বললাম কোথায়? দেখলাম, দূরে ঘাসের ওপর একটা লাল ডাকবাক্স। সেটাকেই মেয়ে ভেবেছিলেন। তারপর সেখানে বসেই একটি স্কেচ করলেন তিনি—ঘাসের ওপর দাঁড়ানো একটি মেয়ে!

আমরা একসঙ্গে চার বছর চাকরিও করেছি অবজারভার পত্রিকায়। আমি নয়টার দিকে অফিসে যেতাম। কাইয়ুম পৌঁছাতেন সাড়ে নয়টা নাগাদ। তিনি তখন সদ্য বিবাহিত। নয়া পল্টনের একটা ছোট্ট দোতলা ফ্ল্যাটে থাকেন। অফিস শেষ করে বিকেল পাঁচটার দিকে দুজন রিকশায় উঠতাম। আমাদের একটা বাঁধা রুটিন ছিল। রায়সাহেব বাজার থেকে একটা মুরগি কিনে জবাই করে এবং ছাল ছাড়িয়ে টুকরো করে ব্রিফকেসের ভেতর ভরে নিয়ে যেতাম। তাহেরা রান্না করতেন। কত গল্প হতো। তাহেরার হাতের রান্না ছিল অসাধারণ। ভাত খেয়ে কাইয়ুমের বাড়িতেই ঘুমিয়ে যেতাম কোনো কোনো দিন। এসব কি ভোলার মতো?

কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের স্বামী—আমাদের ফরিদুর রেজা সাগরের বাবা—এ টি এম ফজলুল হক সাহেব একবার একটা প্রকাশনী দিলেন। কাছারিপাড়ায় অফিস ছিল। সেখান থেকে আলাউদ্দিন আল আজাদের বই বের হলো। সেটিই মনে হয় কাইয়ুমের আঁকা প্রচ্ছদে প্রথম কোনো বই। আর ওই যে কৃষকের মাথার মাথাল, সেটা ছিল ইন্ডিয়ান প্রেসের লোগো। আজ ভেবে অবাক হতে হয়, ১৯৫৩ সালে—সেই ঘোর পাকিস্তান আমলে—অনেকে যখন চাঁদ-তারা দিয়ে লোগো বানাচ্ছে, কাইয়ুম তুলে আনলেন কৃষককে, বাংলাকে। সেটাই বোধ হয় কাইয়ুমের আঁকা প্রথম কোনো লোগো। পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধাদের গামছা পরা ছবি আঁকলেন তিনি। তা এখন আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতীকচিত্রে পরিণত হয়েছে।

আমাদের বন্ধুত্ব সম্পর্কে কত কিছুই তো মনে পড়ছে আজ! ১৯৫৪ সালের কথা। তখন আমি রাখতাম নিউজউইক, কাইয়ুম রাখতেন প্লেবয়। আমরা আরও রাখতাম সাটারডে পোস্ট, আমেরিকা থেকে বেরোত। কাইয়ুম পত্রিকাগুলো রাখতেন অলংকরণের জন্য। তখন দেখতাম, কীভাবে গল্পের অলংকরণ করার জন্য কাইয়ুম হাতে আঁকা পেইন্টিং করতেন।

পত্রিকায় গল্পের অলংকরণ করার সময় কাইয়ুম সব সময় বলতেন, এর একটা পেইন্টিং কোয়ালিটি থাকতে হবে। অর্থাৎ শুধুই ইলাস্ট্রেশন হলে চলবে না, তার পেইন্টিং কোয়ালিটিও থাকা দরকার। পরবর্তীকালে তাঁর অলংকরণগুলোতে আমরা এই পেইন্টিং কোয়ালিটিই পেয়েছি—বিশেষত প্রথম আলো এবং কালি ও কলম পত্রিকার অলংকরণে।

আফসোস হয় এই ভেবে যে, এখন গল্পের অধিকাংশ অলংকরণ অযৌক্তিকভাবে বিমূর্ত হয়। অনেক ক্ষেত্রে একেবারে কাঁচা হাতে বাস্তবধর্মী অলংকরণ করা হচ্ছে বটে, কিন্তু সেই পেইন্টিংয়ে কোয়ালিটি হারিয়ে গেছে।

কাইয়ুম বলতেন, ‘হক, যেদিন আমরা পেইন্টিংকে আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনে, জানালা-দরজার পর্দায়, আমাদের শার্টের কাপড়ে দেখতে পাব, সেদিন বুঝব, জাতি সত্যিই শিল্পবোধে এগিয়ে গেছে।’ তিনি বলতেন ইউরোপ-আমেরিকার কথা। সেখানে তিনি দেখেছেন, দরজা-জানালার পর্দায় লুকিয়ে আছে রং ‍ও রেখার কারুকাজ। আশা করতেন, বাংলাদেশেও এমনটা হবে। আজীবন, অনবরত তিনি একটি জিনিসই সন্ধান করেছেন—বাংলার রং, বাংলার রেখা। এই রং ও রেখা ছিল তাঁর সারা জীবনের অনুসন্ধান। তিনি অনেক কিছু পেয়েছিলেন, যা তাঁকে ব্যক্তিমানুষ হিসেবে আলাদা একটি জায়গায়, একটি উচ্চাসনে স্থাপন করেছিল।

কাইয়ুমের কথা বলতে গিয়ে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কথাও মনে পড়ছে। জয়নুল শুধু শিল্পীই ছিলেন না, শিল্পী-সাহিত্যিক-শিক্ষক—সবাইকে এক জায়গায় জড়োও করতেন। কদিন আগে তাঁর শতবর্ষের অনুষ্ঠানে বলেছিলাম, বছরে আমাদের একটা দিন থাকা দরকার, যেদিন শিল্পী-গায়ক-লেখক-সাংবাদিক-অধ্যাপক—সবাই একত্র হবেন, কোথাও ঘুরতে যাবেন। সবাই মিলে আড্ডা হবে।

১৯৫০-এর দশকে ভাবতাম, সাহিত্যিকদের সঙ্গে তো বন্ধুত্ব হচ্ছে, এবার চিত্রকরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করব। এটাও শিল্পের একটা মাধ্যম। এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমি যেন সমৃদ্ধ হতে পারি। সেই সূত্রেই আমিনুল ইসলাম, দেবদাস চক্রবর্তী, মুর্তজা বশীর, আবদুর রাজ্জাক, রশিদ চৌধুরী—এই চিত্রকরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব। তবে এঁদের সবাইকে ছাপিয়ে কাইয়ুমের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের বন্ধন      ছিল অন্য রকম। সেই সময় আমার            মতো কাইয়ুমও ভাবতেন, শুধু আঁকা  কেন, লেখার জগতেও বন্ধু থাকা  দরকার।

এভাবে একে-অপরের সঙ্গে সুখ-দুঃখে আমরা কাটিয়েছি দীর্ঘ জীবন। একজীবনে কম কাজ করেননি কাইয়ুম। বাংলা হরফে আমাদের যে লেখা ছাপা হয়, সেই হরফ সম্পর্কে তাঁর কিছু সমালোচনা ছিল। শেষ দিকে বাংলা হরফ নিয়েও কাজ করছিলেন তিনি।

একবার রাতে হাতিরঝিল হয়ে কোথাও যাচ্ছিলাম আমরা। হঠাৎ লোডশেডিং বা অন্য কোনো কারণে নিভে গেল আলো। নেমে এল অন্ধকার। অকস্মাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন কাইয়ুম। তাঁর ভেতরে তখন হয়তো হানা দিচ্ছিল অন্ধকার। আশপাশে তাকিয়ে আলো খুঁজছিলেন তিনি।

বাস্তব এই ঘটনার মতো জীবনেও সর্বদা এভাবেই আলো খুঁজেছেন কাইয়ুম চৌধুরী। তাঁর সম্পর্কে বলতে বলতে কথা শেষ করি এভাবে, অন্ধকার সময় থেকে আলোর দিকে উত্তরণের জন্য আমাদের যে আন্দোলন ছিল—নানা মতের নানা পথের সেই আন্দোলন—তার স্লোগান কিন্তু ছিল একটাই: বাংলাদেশ।