দিশাহীনতায় পথের দিশা

চিন্তাশীল লেখকের মূল ধর্ম তাঁর চিন্তার ধারাকে এক জায়গায় আটকে না রাখা, অবরুদ্ধ না করা। চিন্তাকে গতিশীল রাখাই তাঁর প্রধান প্রবণতা। এ রকম ধারণার প্রেক্ষাপটেই হয়তো সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর অবিরাম পথ খোঁজা বইয়ের ভূমিকায় বলেছেন, ‘মানুষের চলার যে বিরাম নেই সেটা যেমন সত্য, সংলগ্ন সত্য তেমনি এটাও যে মানুষকে পথ চলার জন্য সঞ্চয় এবং পথের সন্ধান অবিরাম গতিতেই করতে হয়েছে। বৃত্তের বন্ধনটা যদিও বাস্তবতা, তবু তাকে ভাঙা না হোক অন্তত ডিঙানোর চেষ্টা না করে উপায় থাকে না। এ বইতে অত্যন্ত উঁচুমানের কিছু মানুষের চিন্তা, কয়েকটি ঘটনা, এবং সেসব মূল্যবান চিন্তা ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার তাৎপর্য অনুধাবনের চেষ্টা করা হয়েছে।’ তাঁর এই উচ্চারণ অনুষঙ্গেই বইটি পড়ার প্রেরণায় উদ্দীপ্ত যে হয়েছি, এ কথাও স্বীকার করা দরকার।

বইয়ে আছে মোট নয়টি প্রবন্ধ। প্রবন্ধগুলোতে বিষয়গত বিচ্ছিন্নতা থাকলেও লেখকের দর্শন-ভাবনায় প্রতিটি প্রবন্ধই অবিচ্ছেদ্য।

প্রথম প্রবন্ধ ‘দর্শনের সুখানুসন্ধান’-এ লেখক বিশ্বের প্রধানতম দার্শনিকেরা মানুষ বা মানবজাতির সুখের ভাবনায় কীভাবে ভাবিত হয়েছেন, কোন পথে সুখ আসতে পারে তাদের জীবনে, সে বিষয়ে তাঁদের দর্শনের মূল কথাটি তুলে ধরেছেন। এবং শেষে এই           সিদ্ধান্তে আসছেন যে ‘এটা পরিষ্কার যে সামাজিক বিপ্লব না ঘটলে সুখ সর্বজনীন হবে না। উদারনীতিকেরা এই সর্বজনীনতায় আগ্রহী নয়। উদ্যোগ নিতে হবে তাঁদেরই, যাঁদের ভেতর রয়েছে ন্যায়-অন্যায়ের বোধ ও সৃষ্টিশীলতা এবং যাঁরা নিজেদের ও অন্য মানুষের দুঃসহ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আর্তনাদ করে না, উদাসীন বা হতাশও হয় না, সচেষ্ট হয় ব্যবস্থাটাকে বদলাতে। সংঘবদ্ধভাবে।’

দ্বিতীয় প্রবন্ধের শিরোনাম ‘মাইকেলের বাঙালিত্ব’। এতে লেখক মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রায় সামগ্রিক সাহিত্যজীবন তুলে ধরে দেখিয়েছেন, বিদেশি ভাষা মাইকেলকে মহাকবি করেনি, সেটা তাঁকে করেছে তাঁর মাতৃভাষা বাংলা। তাঁর বাঙালিত্বের ভিত্তি প্রধানত তাঁর বাংলা ভাষায় রচিত মহাকাব্য, কবিতা, প্রহসন ইত্যাদি।

তৃতীয় প্রবন্ধ ‘চীন দেশে রবীন্দ্রনাথ’। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার অনেক পরে, ১৯২৪ সালে চীন সফরে গিয়েছিলেন রবিঠাকুর। ছিলেন ৪৯ দিন। চীনে তখন চলছিল ক্রান্তিকাল। ফলে তাঁর এই সফর ছিল মিশ্র অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, ভালো ও মন্দ মেশানো—এসবই প্রবন্ধটির মাধ্যমে তুলে ধরেছেন লেখক।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আমাদের সেই চিন্তাবিদ, যিনি শিকড় খুঁড়ে সবকিছু দেখেন। ‘সামন্তবাদের মুখোমুখি শরৎচন্দ্র’ প্রবন্ধ এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই প্রবন্ধে শরৎচন্দ্রের শক্তিময়তা ও জনপ্রিয়তার কথা, তাঁর সাহিত্যকর্মের আলোচনার পাশাপাশি এইা কথাশিল্পীর সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গিও বিধৃত হয়েছে। যে শিরোনামের এই প্রবন্ধ, সেই প্রসঙ্গকে সামনে রেখে প্রাবন্ধিক চৌধুরী অতঃপর এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাচ্ছেন যে ‘শরৎচন্দ্রের সাহিত্য মধ্যবিত্তকে সামন্তবাদের আওতা থেকে বের করে আনার ব্যাপারে সাহায্য করবে বলে মনে হয়েছিল, কার্যক্ষেত্রে কিন্তু করেনি।’

‘একাত্তরের যুদ্ধ ও পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের সীমা’ প্রবন্ধে কিছু একান্ত ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ উল্লেখের পাশাপাশি রাজনৈতিক নানা প্রসঙ্গ তুলে ধরে লেখক বলেছেন, ‘পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ পুঁজিবাদী ছিল, বাঙালি জাতীয়তা-বাদীদের অন্তরাত্মাতেও পুঁজিবাদ আগ্রাসন শুরু করে দিয়েছিল। ফলে লুণ্ঠন সমানে চলেছে, একদল সরে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে অন্যদল এসে হাজির হয়েছে। সহ্য করেছে দেশবাসী।’

‘খেলারাম থেকে নূরলদীন’ নিবন্ধে আলোচনা হয়েছে সৈয়দ শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ও নাটক নিয়ে। এখানে মূল্যায়িত হয়েছে তাঁর উপন্যাস খেলারাম খেলে যা, নিষিদ্ধ লোবাননীল দংশন এবং কাব্যনাট্য পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, নূরলদীনের সারাজীবনসহ অন্যান্য সাহিত্যকর্ম। এ লেখায় সৈয়দ হক নতুন এক আর্শিতে বিম্বিত হয়েছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মূল্যায়নে।

‘ভয় পেতে নেই’ প্রবন্ধে নানা দৃষ্টান্ত হাজির করে এমন এক সংকটের কথা বলেছেন লেখক, যার মূলে আছে ধনবাদ। সে মারমুখী। তবে শুধু সংকট নয়, ধনবাদ নামের মারমুখী, ধ্বংসাত্মক ব্যবস্থাকে ঠেকাতে পথের দিশাও দিয়েছেন তিনি।

 এই বইয়ের অন্যতম আলোকিত প্রবন্ধ ‘ট্রাম্প, সু চি এবং কাস্ত্রো’। বর্তমান বিশ্বের সর্বাধিক আলোচিত এই তিন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে প্রাবন্ধিক যেসব যুক্তি ও তথ্য-প্রমাণসহকারে হাজির করেছেন, তার পাঠ সত্যিই নতুন ভাবনায় উদ্দীপিত করে আমাদের।

শেষ প্রবন্ধ ‘পথ জানি কি’। পুঁজিবাদের প্রকৃত স্বরূপ নানাভাবে তুলে ধরা হয়েছে এতে।  সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বইয়ের শেষ লেখায় উপসংহার টেনেছেন এই বলে, ‘ভরসা বামপন্থীরাই। তাঁদের অবশ্যই পুঁজিবাদবিরোধী হতে হবে, কেবল অসাম্প্রদায়িক নয়, হওয়া চাই ধর্মনিরপেক্ষও এবং যেতে হবে মেহনতিদের কাছে—শ্রেণিচ্যুত হয়ে।’

অবিরাম পথ খোঁজার মধ্য দিয়ে এভাবেই সমাজ ও মানুষের মুক্তির পথ অনুসন্ধান করে পথের দিশা দিয়েছেন তিনি।

অবিরাম পথ খোঁজা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

 প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৭

২৩২ পৃষ্ঠা, দাম: ৪০০ টাকা।