হাসির তিন রাজার কথা

নাসিরুদ্দিন হোজ্জা

প্রথমেই বলা যাক ভিনদেশি সেই হাসির রাজার কথা, যাঁকে আমরা চিনি নাসিরুদ্দিন হোজ্জা নামে। কিন্তু তাঁর একটা নাম নয়, নানা দেশে নানা নামে তিনি পরিচিত। কাজাখস্তান ও উজবেকিস্তানে তিনি খোজা নাসির আলদীন; আফগানিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশজুড়ে মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জা এবং আরবদের কাছে তিনি পরিচিত জোহা আল রুমি নামে। চীন দেশেও তিনি ব্যাপকভাবে পরিচিত। সেখানে লোকে তাঁকে চেনে নাসিরুদ্দিন আফেন্দি নামে।

হোজ্জার জন্মস্থান ও জন্মসাল নিয়েও নানা কথা প্রচলিত। বিতর্কও আছে প্রচুর। তুরস্কের একজন গবেষক গবেষণা করে বের করেছেন, তাঁর জন্ম তুরস্কেই। ১২০৮ সালে। সেখানকার সিভরিহকার প্রদেশে। গ্রামের নাম হরতু।

হোজ্জা তাঁর গ্রাম হরতুতেই লাভ করেন প্রাথমিক শিক্ষা। স্থানীয় কয়েকটি মাদ্রাসায়ও পড়াশোনা করেন। ১২৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর বাবার মৃত্যু হলে তিনি চলে আসেন আকশিরে। এখানে কাজির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মাদ্রাসায় শিক্ষকতার দায়িত্বও পালন করেন একই সঙ্গে। তিনি কবি ও দার্শনিক মওলানা জালালুদ্দিন রুমির সমসাময়িক ছিলেন। রুমির সুফি মতবাদের তিনি ছিলেন গভীর অনুরাগী।

তুরস্কের এবং এর বাইরের দেশের অনেক পণ্ডিত ও গবেষকের অভিমত, হোজ্জার গল্পের সঙ্গে আরও অনেকের গল্প যোগ হয়। সেগুলো এখন প্রচলিত তাঁরই নামে। হোজ্জার এসব গল্প মুখে মুখেই প্রথমে প্রচলিত ছিল। তাঁর গল্পের পাণ্ডুলিপির প্রথম সন্ধান পাওয়া যায় ১৪৮০ খ্রিষ্টাব্দে।

নিজের গল্পগুলোতে হোজ্জা কখনো খুব চালাক-চতুর, স্পষ্টবাদী, ন্যায়পরায়ণ, জ্ঞানী, দার্শনিক, আবার কখনো বোকা দ্য গ্রেট।

এমন যে মানুষটি, তিনি আজ বিশ্বসাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইউনেসকো ১৯৯৬-১৯৯৭ সালকে আন্তর্জাতিক নাসিরুদ্দিন বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। তাঁর জন্ম শহরে প্রতিবছর ৫ থেকে ১০ জুলাই পালিত হয় হোজ্জা উত্সব।

এই বিশ্বসেরা হাসির রাজার মৃত্যু হয়েছিল তাঁর জন্ম শহরে ১২৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর মৃত্যুর পর তুরস্কসহ বিশ্বের বহু দেশে তাঁর স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য গড়ে উঠেছে বহু ধরনের স্মারক-সৌধ। নিচে হোজ্জার একটি গল্প তুলে দেওয়া হলো। গল্পটির নাম ‘চাঁদ ও সূর্য’।

হোজ্জাকে একদিন গ্রামের লোকজন জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা ভাই, চাঁদ উপকারী, না সূর্য উপকারী?’

হোজ্জা জবাবে বললেন, ‘চাঁদই উপকারী।’

লোকজনের প্রশ্ন, ‘কেন?’

হোজ্জার সোজা-সাপটা জবাব, ‘কেননা, দিনের বেলায় সূর্য যদি না থাকে, তাহলেও আমাদের আলোর অভাব হয় না। কিন্তু চাঁদ যদি রাতে না থাকে, তাহলে পৃথিবী আঁধারে ঢেকে যায়।’

এই হলেন নাসিরুদ্দিন হোজ্জা!

বীরবল

এবার আমরা আসি দ্বিতীয় হাসির রাজার কথায়। তাঁর নাম বীরবল। আসল নাম মহেশ দাস। তাঁর জন্ম ভারতের বর্তমান উত্তর প্রদেশের কালপি নামের এক গ্রামে—১৫২৮ খ্রিষ্টাব্দে। পারিবারিক ঐতিহ্যের সূত্রেই মহেশ (পরে বীরবল) সাহিত্য ও সংগীত সাধনার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি শিখেছিলেন বেশ কয়েকটি ভাষাও। এগুলো ছিল হিন্দি, সংস্কৃত ও ফারসি। তিনি এসব ভাষায় গদ্য রচনা লিখতেন। আর ব্রজবুলিতে লিখতেন কবিতা। ছোটবেলা থেকেই প্রখর মেধা ও বুদ্ধির পরিচয় দিতে থাকেন তিনি। চারদিকে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে।

মহেশ যুবক বয়সে প্রথম চাকরি পান মধ্যপ্রদেশের রেওয়ার রাজা রামচন্দ্রের রাজদরবারে। তখন তাঁর পদবি ছিল ‘ব্রহ্ম কবি’। ১৫৫৬ কিংবা ১৫৬২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সম্রাট আকবরের সঙ্গে দেখা করেন। আকবর তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও গুণপনার পরিচয় পেয়ে তাঁকে রাজদরবারে নিযুক্ত করেন। অল্প দিনের মধ্যেই মহেশ ‘সম্মানিত কবি’ উপাধিতে ভূষিত হন। সম্রাট আকবর এরপর তাঁকে প্রথমে ‘বীরবল’ ও ‘রাজা’ খেতাবে ভূষিত করেন। অল্প দিনের মধ্যেই তিনি সম্রাট আকবরের ‘নবরত্নের’ একজন হয়ে ওঠেন। দরবারের বিচারকাজে যেমন, তেমনি সম্রাট আকবরের ঘোর বিরুদ্ধবাদীদের নির্মূল করার কাজে যোদ্ধা বা সেনাপতি হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও বীরবল গ্রহণ করেছিলেন আকবর প্রবর্তিত ‘দিন-এ-এলাহি’ ধর্ম।

বীরবল মারা যান ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে, বর্তমান পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকায় মোগল শাসনের বিরুদ্ধে একদল বিদ্রোহীকে দমন করতে গিয়ে। বীরবল শুধু একা নন, তাঁর সঙ্গে মারা যায় তাঁর অধীন আরও ৮ হাজার সৈন্য। সম্রাট আকবর বীরবলের মৃত্যুর শোকে দুই দিন এক ফোঁটা পানি পর্যন্ত পান করেননি।

বীরবলের গল্পের বেশির ভাগই সম্রাট আকবরকে কেন্দ্র করে। এসব গল্পে যেমন হাসির উপাদান আছে, নিছক হাস্যকৌতুক বা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ আছে, তেমনি আছে বীরবলের প্রখর বুদ্ধির পরিচয়। ‘আকবরের প্রশ্ন, বীরবলের উত্তর’ গল্পে মিলবে এর উজ্জ্বল উদাহরণ। গল্পটি এ রকম—

‘দিল্লি শহরে কত কাক আছে, বীরবল?’ বীরবলের কাছে বাদশা আকবরের প্রশ্ন। অদ্ভুত এই প্রশ্নটি শুনে বীরবল সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘জাহাঁপনা, বর্তমানে শহরে নয় লাখ নয় হাজার নয় শ নিরানব্বইটা কাক আছে। আপনি নিজে গুণে দেখতে পারেন, যদি আপনার সন্দেহ হয়। আর যদি দেখেন, এই সংখ্যা থেকে কিছু কাক কম আছে, তাহলে বুঝবেন দিল্লির চারপাশে বন্ধুদের সঙ্গে তারা বেড়াতে গেছে। আবার যদি দেখেন ওই সংখ্যা থেকে বেশি কাক আছে, তাহলে জেনে রাখবেন, তাদের বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজন মফস্বল এলাকা থেকে তাদের দেখতে এসেছে।’

বীরবলের শাণিত কথার মুখে আকবর তো একেবারে থ।

গোপাল ভাঁড়

আমাদের তৃতীয় হাসির রাজা গোপাল ভাঁড়। আসল নাম গোপালচন্দ্র ভান্ডারি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণিতে তাঁর জন্ম। অষ্টাদশ শতকে। তাঁর জন্ম তারিখ পাওয়া যায়নি।

গোপাল ছোটবেলা থেকে খুবই বুদ্ধিমান ছিলেন। হাসি-তামাশায়ও কম যেতেন না। যুবক বয়সে পা দিতেই তাঁর নাম-ডাক চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। নদীয়া জেলার তখনকার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র গোপালকে দরবারে ডেকে পাঠালেন। বললেন, তুমি দরবারের সবাইকে হাসাবে। হাসানোই তোমার কাজ। তোমাকে একই সঙ্গে দরবারের ভাঁড় ও সভাসদের মর্যাদা দেওয়া হলো। সেই থেকে গোপালচন্দ্র ভান্ডারি ‘গোপাল ভাঁড়’ হলেন এবং শুরু হলো তাঁকে ও রাজাকে ঘিরে গল্পের পর গল্পের সৃষ্টি। বাংলা সাহিত্যে তাঁর এসব গল্প চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছে। গোপাল ভাঁড়ের আবক্ষমূর্তি এখনো দেখতে পাওয়া যায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাসাদ চত্বরে এবং কৃষ্ণনগর শহরের ঘূর্ণিতে। তবে কোনো কোনো গবেষক, এমনকি সুকুমার সেনের মতো পণ্ডিত ব্যক্তিও বলেছেন, গোপাল ভাঁড় একটি কল্পিত চরিত্র। আবার এর বিপক্ষেও মতামত আছে।

যত যা-ই হোক, গোপাল ভাঁড় আমাদের কাছে জীবন্ত একটি চরিত্র। আর সেটা তাঁর গল্পের জন্যই। ‘মামা-ভাগনে সমাচার’ তেমনি একটি গল্প। নিচে তুলে দেওয়া হলো গল্পটি।

একদিন ঠাট্টা করে গোপালের মামা গোপালকে বললেন, ‘তোর কী বিশ্রী চেহারা রে! ভূতের চেহারাও তো তোর চেয়ে ভালো। আয়নায় একবার নিজেকে দেখেছিস?’

ছাড়বার পাত্র নন গোপালও। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘কী আর করা যাবে বলো, শাস্ত্রেই আছে, মামার চেহারাই তো ভাগনে পায়। তুমি যেমন তোমার মামার মতো দেখতে, আমিও তেমনি তোমার মতো দেখতে। তাই এর জন্য আমি আর কোনো আক্ষেপ করি না।’

আমার গল্প ফুরাল। নটে গাছটি মুড়াল।